স্টাফ রিপোর্টার : বেড়ে ওঠা শিবির ক্যাডারের দেহরক্ষী হিসেবে, এখন নিজেকে দাবি করেন চট্টগ্রামে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের রাজনীতির একজন নিয়ন্ত্রক। গত বুধবার সংবাদ কর্মীর সাথে কথা বলার সময়ও তিনি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) নির্বাচনে সক্রিয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে ছিলেন। নাম তার মোহাম্মদ হাছান। রাউজানের উত্তর সর্ত্তা গ্রামে তিনতলা বিলাসবহুল ডুপ্লেক্স বাড়ি। কক্ষগুলো সাজানো দামি টাইলস ও আসবাবপত্রে। চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের পেছনে আম্বিয়া সেরিন নামের ভবনে রয়েছে বিলাসবহুল ফ্ল্যাটও। ওই ভবনেরই পার্কিংয়ে তার দৃষ্টিনন্দন অফিস। দ্বিতীয় তলায় গড়েছেন ব্যায়ামাগার। আছে তিনটি দামি গাড়ি একটি ল্যান্ড ক্রুজার জিপ, একটি হোন্দাই জিপ ও অন্যটি প্রিমিও কার। অথচ দৃশ্যমান কোনো ব্যবসা বা চাকরি নেই শিবিরের সাবেক ক্যাডার মোহাম্মদ হাছানের।

চট্টগ্রামের অধ্যক্ষ গোপাল কৃষ্ণ মুহুরীর হত্যাকারী শীর্ষ সন্ত্রাসী এই হাছান এখন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে কাউন্সিলর পদপ্রার্থী আতাউল্লাহ চৌধুরীর ঘুড়ি মার্কার পক্ষে প্রচারণায় সরব রয়েছেন। অভিযোগ উঠেছে উক্ত কাউন্সিলরকে অর্থেরও যোগান দিচ্ছেন তিনি।

সবার প্রশ্ন একজন শিবির ক্যাডার কেমনে এমন প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে প্রবেশ করে এবং আওয়ামী লীগের নাম বহন করা আওয়ামীলীগ কর্মীইবা কেমনে এদের সাথে নিয়ে প্রচারণা চালায়!

চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতারা তাকে জামায়াত-শিবিরের ক্যাডার বলে দাবি করলেও স্থানীয় আওয়ামীগে তার কদরও কম নয় শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বোঝাতে তাদের সঙ্গে তোলা একগাদা ছবি দিয়ে সাজিয়েছেন নিজের ফেসবুক পেজ, ফ্ল্যাট ও অফিস কক্ষ। কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও ধারণ করেন নিজের সেলফিতে। এর বাইরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল, সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, প্রয়াত মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী, শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, চসিক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন, চট্টগ্রাম মহানগর মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হাসিনা মহিউদ্দিন, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সংসদ সদস্য মোছলেম উদ্দিন আহমদ, চসিক মেয়রপ্রার্থী রেজাউল করিম চৌধুরী, চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এমএ সালাম, ফটিকছড়ির সংসদ সদস্য খাদিজাতুল আনোয়ার সনি, সংসদ সদস্য পঙ্কজ দেবনাথ, চট্টগ্রামের সাবেক পুলিশ কমিশনার মাহাবুবর রহমান, কেন্দ্রীয় নেতা আমিনুল ইসলামসহ স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের বর্তমান ও সাবেক অনেক নেতা এবং ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গেও রয়েছে তার হাস্যোজ্জ্বল ছবি।

শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল অবশ্য বলেন, ‘কোনো একসময় হজে গিয়ে আমার বাবার (এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী) সঙ্গে একটি ছবি তুলেছিল হাসান। পরে সেটি দেখিয়ে সে কাছে আসে। কোমরে একটি পিস্তল নিয়ে একসময় আমাদের চশমা হিলের বাসায় আসত। কিন্তু তার ব্যাপারে সবকিছু জানার পর তাকে আমার কাছে আসতে, সব ধরনের যোগাযোগ রাখতে মানা করে দিয়েছি। সে মূলত একজন ধূর্ত প্রকৃতির মানুষ। আমি শুনেছি গোপাল কৃষ্ণ মুহুরীর হত্যাকারীদের সে ট্যাক্সি চালিয়ে পালাতে সাহায্য করেছিল। চট্টগ্রামে টিংকু (প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকু) ভাইয়ের সব ব্যবসাই হাসান হাতিয়ে নিয়েছে।’

মোহাম্মদ হাছানের আছে দুটি বৈধ আগ্নেয়াস্ত্র। একটি পিয়েত্রো বেরেতা ব্র্যান্ডের ইতালির তৈরি পিস্তল; অন্যটি শটগান। তবে একসময় নিজের ফেসবুক ওয়ালে পিস্তল হাতে তার একটি ছবি দিয়েছিলেন, যেটি ২০১৫ সালে কেনা লাইসেন্সকৃত দুই অস্ত্রের কোনোটিই নয়। সেটি মূলত ওয়ালথার পিপিকে ব্র্যান্ডের পিস্তল।

আগ্নেয়াস্ত্র লাইসেন্স প্রদান, নবায়ন ও ব্যবহার নীতিমালা ২০১৬-এর ৩(ঘ) ধারা অনুযায়ী, একটি পিস্তলের লাইসেন্স পেতে গেলে কমপক্ষে পূর্ববর্তী তিন করবর্ষে টানা ৩ লাখ টাকা এবং শটগানের জন্য ১ লাখ টাকা আয়কর দিতে হয়। সে ক্ষেত্রে টানা তিন বছর মোহাম্মদ হাসানের সব মিলিয়ে কমপক্ষে ৪ লাখ টাকা করে আয়কর দেওয়ার কথা। অথচ অস্ত্র কেনার করবর্ষে অর্থাৎ ২০১৪-১৫ অর্থবছরে তিনি শর্ত অনুযায়ী কর না দিয়েও পেয়ে গেছেন লাইসেন্স। আর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে হাসান কর দিয়েছেন ৮১ হাজার ৪৪৮ টাকা। যদিও আয়করের কোনো পর্যায়েই তিনটি বিলাসবহুল গাড়ি ও অফিসের কথা উল্লেখ নেই।

চট্টগ্রামের কিশোর গ্যাংয়ের মাধ্যমে এলাকা নিয়ন্ত্রণেরও অভিযোগ রয়েছে সাবেক শিবির ক্যাডার হাসানের বিরুদ্ধে।
এলাকায় রীতিমতো শক্তি সঞ্চয় করে তা আশপাশের লোকজনকে নিয়মিত জানানও দেন। ২০১৮ সালের ২০ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম কলেজের সামনে একদল যুবক প্রকাশ্যে বন্দুক ও বিদেশি পিস্তল উঁচিয়ে বিক্ষোভ করে। ওইদিন সন্ধ্যায় পুলিশ সদরঘাটের শাহজাহান হোটেল থেকে ঘটনায় ব্যবহৃত বিদেশি ওই পিস্তলসহ ইমরান ও শফিউল আজম নামে দুই যুবককে গ্রেপ্তার করে। পরে তারা পুলিশকে জানিয়েছিল, বিক্ষোভে ব্যবহৃত অবৈধ পিস্তলটি মোহাম্মদ হাছানের।

কে এই হাছান : প্রথম যৌবনে রাউজান এলাকায় বেবিট্যাক্সি চালাতেন মোহাম্মদ হাছান। বাবা শামসুল আলম ছিলেন চান্দের গাড়ির লাইনম্যান। ওই সময়েই হাসানের ঘনিষ্ঠতা বাড়ে দুর্ধর্ষ শিবির ক্যাডার তসলিম উদ্দিন মন্টুর সঙ্গে। এর পর বেবিট্যাক্সি ছেড়ে মন্টুর আশ্রয়ে চলে আসেন হাছান। জড়িয়ে পড়েন সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে। মন্টু ১৯৯৭ সালে পাঁচটি একে-৪৭, দুটি জি থ্রি রাইফেল, একটি এসএমজিসহ মোট আট অস্ত্রসহ শিবির অধ্যুষিত চকবাজার থেকে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। অধ্যক্ষ গোপাল কৃষ্ণ মুহুরী হত্যা মামলায় আপিল বিভাগের রায়ে ভোগ করছেন যাবজ্জীবন কারাদ-। অধস্তন আদালত অবশ্য তাকে ফাঁসির আদেশ শুনিয়েছিলেন।

এদিকে মন্টু গ্রেপ্তারের পর হাছান চকবাজার ছেড়ে চলে যান রাউজানের আরেক সন্ত্রাসী শরণ বড়–য়ার আশ্রয়ে। একদিন তারা দুজন মিলে নিউমার্কেট মোড়ে তৎকালীন চট্টগ্রাম উত্তর জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমানে ফটিকছড়ি উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান হোসাইন মোহাম্মদ আবু তৈয়বকে গুলি করেন। কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে আবু তৈয়বকে বহনকারী রিকশাচালক বিদ্ধ হন সেই গুলিতে। ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। এ ছাড়া ১৯৯৮ সালে রাউজানে যুবলীগ নেতা কাজল হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত তিন নম্বর আসামি ছিলেন মোহাম্মদ হাছান। তদন্ত শেষে পুলিশ তার নামে আদালতে অভিযোগপত্রও দেয়। তবে প্রধান আসামি সন্ত্রাসী শরণ বড়ুয়া খুন হওয়ায় পরবর্তী সময়ে নানা ঘটনায় মামলাটি ক্রমেই গুরুত্ব হারায়। পর্যাপ্ত সাক্ষী-প্রমাণের অভাবে আসামিদের বেকসুর খালাস দেন আদালত।

ফটিকছড়ি উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান হোসাইন মোহাম্মদ আবু তৈয়ব আমাদের সময়কে বলেন, ‘হাসান ছিলেন একজন দুর্ধর্ষ শিবির ক্যাডার। এই বেবিট্যাক্সিচালক মূলত শিবির ক্যাডার তসলিম উদ্দিন মন্টুর সহযোগী। দুজন মিলে অধ্যক্ষ গোপাল কৃষ্ণ মুহুরীকে খুন করেন। অধ্যক্ষ মুহুরীকে খুন করে পালানোর সময় হাসান নিজেই বেবিট্যাক্সি চালিয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। যুবলীগ নেতা কাজল হত্যার সঙ্গেও তিনি সরাসরি জড়িত।’ ১৯৯৮ সালের ঘটনা স্মরণ করিয়ে দিয়ে আবু তৈয়ব বলেন, ‘সেদিন হাছান আমাকে খুন করার লক্ষ্যে খুব কাছ থেকে গুলি করেছিলেন। কিন্তু আল্লাহ সহায় ছিলেন বলে প্রাণে বেঁচে যাই। সেই গুলিতে বিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান আমাকে বহন করা রিকশাচালক।’

জানা যায়, ১৯৯৯ সালের ১১ ডিসেম্বর নগরীর সদরঘাট ডিলাইট রেস্তোরাঁ থেকে মার্ক-ফোর কাটা রাইফেল ও আটটি গুলিসহ গ্রেপ্তার হয়েছিলেন মোহাম্মদ হাছান। পরবর্তী সময়ে জামিনে বের হয়ে তসলিম উদ্দিন মন্টু, গিট্টু নাছিরসহ শিবির সন্ত্রাসীরা ২০০১ সালের ১৬ নভেম্বর অধ্যক্ষ গোপাল কৃষ্ণ মুহুরীকে নগরীর জামালখানের বাসায় হত্যা করেন। মুক্তিযোদ্ধা ও নাজিরহাট কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ গোপাল কৃষ্ণ হত্যা মামলায় সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে ২০০২ সালের ২০ আগস্ট নগর গোয়েন্দা পুলিশ হাটহাজারীর উত্তর মাদার্শা থেকে গ্রেপ্তার করে হাছানকে। এ নিয়ে পরদিন স্থানীয় ও বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় ছবিসহ সংবাদও প্রকাশিত হয়।

হাছানের বক্তব্য : নিজেকে প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকুর অনুসারী দাবি করে মোহাম্মদ হাছান বলেন, ‘একসময় রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকে কিছু মানুষ আমার পেছনে লেগেছিল। তারাই আমাকে কখনো গোপাল কৃষ্ণ মুহুরী হত্যা, কখনো কাজল হত্যার সঙ্গে জড়ানোর চেষ্টা করে। আমি বেবিট্যাক্সি চালাতাম, এটা তো অপরাধ হতে পারে না।’ ফটিকছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান আবু তৈয়বকে হত্যা করতে গিয়ে রিকশাচালক খুন হওয়া প্রসঙ্গে হাছান বলেন, ‘আবু তৈয়ব এ কথা বললে তো আমার কিছু করার নেই। তখন তো তিনি আমার বিরুদ্ধে মামলা করেননি? অবৈধ পিস্তল হাতে ছবির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এটা ঢাকার একটি পিস্তলের দোকানে তোলা।’ কিন্তু ছবিতে দেখা যাচ্ছে ওটা কোনো বাসার ড্রইংরুম, সে কথার জবাব না দিয়ে তিনি প্রতিবেদকের সঙ্গে দেখা করার প্রস্তাব দেন।

রাউজানের এক শীর্ষ নেতা জানান, হাছান উল্টো লাইনের মানুষ। তাই তার রাউজানে প্রবেশ নিষেধ। অন্যদিকে জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকুর এক ঘনিষ্ঠজন জানান, হাছান ছিলেন টিংকুর বাড়ির দারোয়ান। পরে সেই বাড়ি থেকে তিনি সোনাদানা আত্মসাৎ করে ও নানা অবৈধ্য উপায়ে এতো অর্থ সম্পদের মালিক হয়েছে হাছান।

(আর/এসপি/জানুয়ারি ২৫, ২০২১)