শিতাংশু গুহ


পাকিস্তান আমলে কাজী নজরুলের কবিতায় ‘সজীব করিব মহাশ্মশান’ কথাটি পাল্টে দিয়ে ‘গোরস্থান’ শব্দটি আমদানি করা হয়েছিলো। টেকেনি। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ নিষিদ্ধ হয়েছিলেন, ঢাকায় সাহিত্য-সাংস্কৃতিক জগত তখন সংগ্রামী ভূমিকা রেখেছিলো। ওসব এখন ইতিহাস। বাংলাদেশ জন্ম নিলে সবাই আশা করেছিলো, এবার মনের মাধুরী মিশিয়ে মহাকাব্য রচিত হবে! সবাই ভেবেছিলো, ঢাকা হবে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দু। মোল্লাদের ভয়ে ওই কথা এখন আর কেউ মুখে আনে না? বাংলাদেশে তৌহিদী জনতা বর্তমান সময়ে পাকিস্তানের চেয়ে ঢের শক্তিশালী। তাঁরা পাঠ্যবই পাল্টিয়ে দেয়, প্রগতিশীল ও অ-মুসলমানের লেখা বিনাক্লেশে বাদ দিয়ে দেয়; প্রয়োজনে ওঁরা মুক্তমনাদের ওপারে পাঠিয়ে দেয়! আগের মত প্রতিবাদ কোথাও নেই? 

বাংলাদেশে আমরা কি আসলে এখন বাঙ্গালী, না বাঙ্গালী মুসলমান? মাতৃভাষা বাংলা হলে বা বাংলায় কথা বললেই কি বাঙ্গালী হওয়া যায়? কঠিন প্রশ্ন? আমরা যাঁরা পশ্চিমা দেশে থাকি তাঁরা জীবিকার প্রয়োজনে ইংরেজীতে কথা বলি, আমরা ইংরেজ নই? ইংরেজীতে কথা বলে আমরা যেমন ইংরেজ নই, তেমনি বাংলায় কথা বললে সবাই বাঙ্গালী নন? তোতাপাখি বাংলায় কথা বলে, পাখিটি বাঙ্গালী নয়! প্রবাসে বাংলা মায়ের গর্ভে যে সন্তান জন্ম নিচ্ছে, টুকটাক বাংলা বলছে, এরা কি বাঙ্গালী? দেশে মনেপ্রাণে বাঙ্গালীর সংখ্যা কি খুব বেশি? নাকি বাঙ্গালী মুসলমান সংখ্যাধিক্? মুখে বাংলা, বুকে ‘মরু-সংস্কৃতি’ ধারণ করে বাঙ্গালী হওয়া কঠিন, কিন্তু ‘বাঙ্গালী মুসলমান’ হওয়াটা সহজ। এতে খুব যে সমস্যা তা নয়, বরং এটি অনেকটা ‘ধর্মকর্ম সমাজতন্ত্রের’ মত!

বঙ্গবন্ধু ভাষা ভিত্তিক ‘বাঙ্গালী জাতি’ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। তখনো আদিবাসী, চাকমা বা অন্যান্য ক্ষুদ্র-নৃতাত্বিক শ্রেণীভুক্ত মানুষ বাঙ্গালী হতে চায়নি, তাঁরা বলেছিলো, ‘আমরা বাঙ্গালী নই’? শুধু ভাষা দিয়ে কি জাতি হয়? সংস্কৃতি, ভাষা ও ভূখণ্ড নিয়ে জাতি গঠিত হয়। সংস্কৃতি’র পরিসর ব্যাপক। বৃহত্তর ব্যাখ্যায় সংস্কৃতির ভেতরে ‘ভাষা ও ধর্ম’ অন্তর্ভুক্ত। বঙ্গ সংস্কৃতি ভারতীয় সংস্কৃতি’র অংশ। ভারত আমাদের অ-পছন্দ। তাই পুরোপুরি বাঙ্গালী হওয়া আমাদের পক্ষে কষ্টকর! বাংলা সংস্কৃতির ইতিহাস বেশ পুরানো। মহাকবি কালিদাস, রামায়ণ, মহাভারত, বিষ্ণুপুরান, কৃষ্ণলীলা, পদাবলী এর উপাদান। এসবই হিন্দুধর্মীয় উৎস থেকে উৎসারিত এবং সাধারণ মুসলমানদের পক্ষে মেনে নেয়াটা বেশ কঠিন। বাঙ্গালী মুসলমানের ইতিহাস মাত্র কয়েক’শ বছরের। ফলে বাংলা ভাষায় মুসলমানের প্রভাব কম।

সংস্কৃতি’র সাথে জলবায়ু’র নীবিড় সংযোগ। হিন্দুধর্ম ভারতীয় সংস্কৃতি’র মধ্যে জন্ম ও বেড়ে ওঠা, তাই অনুকূল পরিবেশে সনাতন ধর্মের অনেক কিছু সহজেই ভাষার মধ্যে ঢুকে পড়েছে। ইসলামের জন্যে বিষয়টি একটু কঠিন। কারণ শুষ্ক মরু সংস্কৃতিতে জন্ম ও বেড়ে ওঠা ইসলাম আদ্র জলবায়ুতে বাংলা ভাষায় ঠিক অতটা সহজে ঢুকতে পারেনি বা পারছে না? ধর্মীয় সংঘাতের কারণে বাংলাদেশের মানুষের পক্ষে পুরোপুরি বাঙ্গালী হওয়া বেশ কঠিন। প্রবাসী লেখক শর্বরী জোহরা আহমদ পহেলা জানুয়ারি ২০২০ ‘দি হিন্দু’ পত্রিকাকে বলেছেন, ‘ইউ আর অরিজিনালি হিন্দুজ’- একথা বলে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, বাংলাদেশের মুসলমান মূলত: হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত। এ সত্য মানলে তো হিন্দুধর্ম নির্ভর বাঙ্গালী সংস্কৃতি মেনে নেয়া আরো কঠিন।

তাহলে বাঙ্গালী কারা? বাংলা ভাষা’র উৎস সংস্কৃত ভাষা। হিন্দু নামে তাই তৎসম শব্দের প্রভাব লক্ষ্যণীয়, যদিও কালের আবর্তে বাঙ্গালী সহজ তদ্ভব শব্দের দিকে ধাবিত হচ্ছে। একইভাবে মুসলমান নামে আরবি বা উর্দু ভাষার প্রাধান্য বিদ্যমান। এটাই বাস্তবতা। ‘কৃষ্ণচূড়ার ডালে ডালে আগুন লেগেছে’ -এখানে ‘কৃষ্ণচূড়া’ একটি শব্দ, পাল্টানো কঠিন; পাল্টালে এটি বাংলা থাকবে না, এবং সৌন্দর্য্য হারাবে। রাষ্ট্রপতি এরশাদ বাংলা ক্যালেন্ডারের ইসলামীকরণ করেছেন, কিন্তু বাংলা ভাষার ইসলামীকরণ এতটা সহজ বা সম্ভব নয় বা সম্ভব হয়নি। তবে চেষ্টা আছে? মতান্তরে, বাঙ্গালী মানে বাড়িতে তুলসীতলা থাকবে, সন্ধ্যা আরতি হবে, পহেলা বৈশাখ, ভাইফোঁটা, চড়ক, গাঁজন, দোল, দুর্গাপূজা থাকবে। মুসলমান বাড়ীতে এসবের বালাই নেই, তাহলে কি মুসলমান বাঙ্গালী নয়? কলকাতার নায়িকা নুসরাত বিয়ে করেছেন হিন্দুকে, নাচগান, দুর্গাপূজায় হৈচৈ সবই করেন, অঞ্জলী নেন, কিন্তু ধর্মে তিনি মুসলমান, তিনি কি বাঙ্গালী নন?

বঙ্গে ‘লক্ষীমেয়ে’ শব্দটি বেশ প্রচলিত। এক ওয়াজে হুজুর বলেন, ‘লক্ষী’ বলা যাবেনা, কারণ লক্ষী হিন্দু’র দেবতা। সমস্যা হচ্ছে, ‘লক্ষীর’ বদলে আপনি কি শব্দ ব্যবহার করবেন? অথবা ‘রামছাগল’ এর সমার্থক শব্দ কি? রামধনু-কে ‘রংধনু’ করা গেছে, মা-কে আম্মা; বাবাকে আব্বা, দিদিকে আপা, বা কাকাকে চাচা করা যায়, কিন্তু সপ্তাহে সাতটি দিনের নাম তো আর পরিবর্তন করা যাবেনা? শনিবার শনি ঠাকুরের নামে, রবিবার সূর্য্য দেবতার নামে, ইত্যাদি। এমনকি নদীর নাম যেমন যমুনা, সরস্বতী, ব্রহ্মপুত্র নাম তো আর পরিবর্তন করা যাবেনা? এসব কারণে হয়তো একজন ভালো মুসলমানের পক্ষে বাঙ্গালী হওয়াটা বেশ কঠিন। এর চাইতে ‘বাঙ্গালী মুসলমান’ হওয়াটা ঢের সহজ।

বাংলাদেশে ‘জল’ শব্দটি’র ব্যবহার কমে গেছে। ‘জল’ বাংলা শব্দ। বাঙ্গালী হিন্দু এই শব্দ ব্যবহার করতো। যেহেতু হিন্দুরা ‘জল’ বলতো মুসলমানরা তাই ফার্সী শব্দ ‘পানি’ বলতো। আরো কারণ আছে, যেমন মুসলমানরা নিজেদের শাসক শ্রেণীর মানুষ ভাবতে পছন্দ করতো, এবং তখনকার দিনে মুসলমান শাসকেরা ফার্সি বা উর্দু ব্যবহার করতো। এর প্রমান পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান? অধিকাংশ পশ্চিমবঙ্গীয় মুসলমান বাংলাদেশী মুসলমানের কিছুই পছন্দ করেনা, তাঁরা বাংলায় প্রায়শ: কথা বলেনা, রাজনীতি করে জামাতের, আচার-আচরণ অবাঙ্গালীর, কিন্তু তাঁরা বাঙ্গালী? বাংলাদেশের মুসলমানরা কলকাতা গিয়ে তাদের বাড়ীতে ওঠেনা, ওঠে হিন্দু বাঙ্গালীর বাড়িতে। ধর্ম ভিন্ন হলেও এটি সাংস্কৃতিক বন্ধন। এই বন্ধন থাকেনা, যখন ধর্ম সামনে এসে পড়ে! ভারতের একশ’ কোটি বা তার বেশি মানুষ ধর্ম নির্বিশেষে ‘পানি’ বলে। বাঙ্গালী হিন্দু ‘জল’ বলে, তাই মুসলমান বলে ‘পানি’।

চট্টগ্রামে হিন্দু-মুসলমান সবাই পানি বলে। আমার ঘরেও তাই জল পানি হয়ে গেছে। দৈনিক সংবাদে বাসুদেব ধর একজন সাংবাদিক, তিনি চট্টগ্রামের। তাদের বাড়ীতে ‘পানি’ শব্দটি প্রচলিত ছিলো। তাঁরা তাদের ছোট্ট ছেলেকে নিয়ে একবার কলকাতা যান। বাচ্চাটি সেখানে ‘জল’ শব্দের সাথে পরিচিত হয়। বাসুদেব ধর গল্প করে বলতেন, আমার ছেলে কলকাতা থেকে এসে ‘পানিজল’ বলে! মুখ্যত, পানি বা জলের সাথে ধর্মের কোন সম্পর্ক নেই, কিন্তু ব্যবহারিক কারণে এরমধ্যে ধর্ম ঢুকে গেছে? আসলে ধর্মীয় গোঁড়ামী’র বাইরে যেতে না পারলে, একটি ‘বাঙ্গালী’ জাতি গঠন অসম্ভব। আজকাল অনেকে বলেন, ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’? আল্লামা কাসেমী বলেছেন, ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’ এ উক্তি ইসলাম বিরোধী। আসলে কি তাই? একই পাঠাগারে গীতা ও কোরান পাশাপাশি থাকে, এঁরা লড়াই করেনা। লড়াই করে এর অন্ধ অনুসারীরা! এ লড়াই বন্ধ না হলে ‘সকলি গড়ল ভেল’।

ভাষা এক হলে জাতি এক হবে এ তত্ত্ব সঠিক নয়? আমেরিকা-ইংল্যান্ডের ভাষা ইংরেজী, তাঁরা ভিন্ন জাতি। মধ্যপ্রাচ্যের অনেকগুলো দেশের ভাষা আরবী, এরা সবাই পৃথক পৃথক জাতি। এমনকি ধর্ম এক হলেও জাতি এক হয়না, তাহলে এতগুলো মুসলমান দেশের প্রয়োজন হতো না, বা খৃস্টানদের এতগুলো দেশ হতোনা। জাতি গঠনে ভাষা ও ধর্ম সহায়ক শক্তি, নিয়ামক নয়? যুগোশ্লাভিয়ার তিনটি বৃহৎ জাতিগোষ্ঠী হচ্ছে, সার্ব, ক্রোট ও বসনিয়াক। সার্ব ও ক্রোটদের ভাষা এক, সার্ব; ধর্মে সার্বরা অর্থডক্স খৃষ্টান, ক্রোটরা ক্যাথলিক, এঁরা ভিন্ন জাতি। বসনিয়ানদের ভাষা তুর্কি, ফার্সি, আরবি মিশ্রিত, ধর্মে এঁরা মুসলমান, পৃথক জাতি! সুতরাং ভাষা এক হলেই এক জাতি হবে, বিষয়টি তা নয়? কেউ চাইলে আভাষ চ্যাটার্জি’র জাতির সংজ্ঞা দেখে নিতে পারেন।

সুতরাং, বাঙ্গালী ও বাংলাদেশীদের ভাষা এক হলেও দু’টি জাতি হওয়া সম্ভব। এ সম্পর্কে হুমায়ুন আজাদ লিখেছিলেন, ‘সাম্প্রদায়িকতাকে ভদ্রজনিত করতে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের আমদানী’। হয়তো তাই, তবে বাঙ্গালী মুসলমান তাঁদের পৃথক অস্তিত্ব বজায় রাখতে বা ভাষা এক হলেও হিন্দু-মুসলমান এক জাতি নয়, একথা বোঝাতে নিজেদের ‘বাংলাদেশী’ পরিচয় দিতে স্বাছন্দ্য বোধ করেন। বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছরের ইতিহাসে এটি মোটামুটি প্রমাণিত যে, বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ বাঙ্গালী হিন্দু ও বাঙ্গালী মুসলমানকে একত্রে ধরে রাখতে ব্যর্থ, এরা জাতি হিসাবে ভিন্ন। ধর্ম এই বিভাজন টেনে দিয়েছে, এর থেকে বেরুবার সহজ উপায় নেই? বাংলাদেশে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ ‘লাইফ সাপোর্টে’ আছে; নব্বই শতাংশ মুসলমানের দেশে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ টিকে থাকার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই?

লেখক : আমেরিকা প্রবাসী।