আবীর আহাদ


বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ক্ষমতার ভিত্তি মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সাধারণ জনগণ । কিন্তু ক্ষমতায় থাকা এবং হারানোর অমূলক সন্দেহ ও ভীতির কারণে দলটি বর্তমানে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি রাজাকার জামায়াত শিবির বিএনপি ফ্রিডমপার্টির ভেতরকার অপরাধীচক্র ও হেফাজতে ইসলামের মতো জঙ্গিবাদী পাণ্ডা এবং রাষ্ট্রের দুর্নীতিবাজ আমলাতন্ত্র, লুটেরা ও মাফিয়াদের সমর্থন নিতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি ও মুক্তিযোদ্ধাদেরকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে ! বিভিন্ন স্বাধীনতাবিরোধী পক্ষের অপরাধীচক্রকে অর্থের বিনিময়ে আওয়ামী লীগ তার দলে যাদের ঠাঁই দিয়েছে, তারা এসেছে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে নয়-----তারা এসেছে অতীতের নানান অপকর্মের মামলা থেকে বাঁচার পাশাপাশি দলের মধ্যে অবস্থান করে ভাগ দিয়ে আরো লুটপাট করতে । এ-কথা দলের হাইকমান্ড ও নিচের কেউ একবারও ভেবে দেখেছেন বলে মনে হয় না !

আওয়ামী লীগ হয়তো ভেবে নিয়েছে যে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি দুর্বল । কিন্তু আসলে তা নয় । মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি চায়, মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব প্রদানকারী দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকুক, কিন্তু তারা যেনো বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অঙ্গীকারের পথে থাকে । তারা যেনো দুর্নীতি লুটপাট ও মাফিয়াতন্ত্রকে প্রশ্রয় না দেয় । তারা যেনো স্বাধীনতাবিরোধী ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক অপশক্তির সাথে আপোস না করে । রাষ্ট্রটি হবে ধর্মনিরপেক্ষ, জনকল্যাণমূলক ও বাঙালি জাতীয়তাবাদে সিক্ত । তারা যেনো এমন রাজনৈতিক পদক্ষেপ নেয় যাতে রাষ্ট্রক্ষমতায় চিরকাল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি থাকবে-----পাশাপাশি বিরোধী দলেও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি থাকবে ।

কিন্তু দু:খজনক সত্য এই যে, আওয়ামী লীগ আত্মাহমিকায় তাড়িত হয়ে নিজেদেরকে দেশের মালিক ভেবে নিয়েছে । তারা দল ও শুভানুধ্যায়ীদের মধ্যের সৎ মেধাবী সাহসী ও ত্যাগী লোকদের সরিয়ে দলে ও সরকারে দুর্নীতিবাজ লুটেরা মাফিয়াসহ ধান্দাবাজ চাটুকার অপদার্থ ও সুযোগসন্ধানীদের জামাই আদরে অবস্থান দিয়েছে । তাদের এ-অপরিণামদর্শি পদক্ষেপের ফলে মাফিয়া-ক্যাসিনো সম্রাট, ব্যাঙ্কিং দরবেশ ও গণিকা সম্রাজ্ঞীদের উত্থান ঘটেছে । দুর্নীতি ও লুটপাট এবং মাফিয়াতন্ত্রের করালগ্রাসে জাতীয় নৈতিক চরিত্র ও সামাজিক মূল্যবোধে চরম অবক্ষয় ঘটেছে । তাদের মূল চিন্তাধারা হলো, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ভোগের পাশাপাশি লুটপাট করে উদোরভর্তিকরণ । তারা একনাগাড়ে দীর্ঘকাল ক্ষমতায় থাকার সুবাদে দুর্নীতিবাজ আমলাতন্ত্র ও লুটেরাদের যোগসাজশে সড়ক, ব্রিজ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রভৃতি অবকাঠামোগত বিশাল উন্নয়ন করলেও উন্নয়নের অন্তরালে এক টাকার ব্যয়কে দশ/বারো গুণ দেখিয়ে যে সাগরচুরি করা হয়েছে, সেই সাগরচুরি মহা-ঢেউয়ে তাদের উন্নয়নের যাবতীয় কৃতিত্ব ম্লান হয়ে গিয়েছে !

আওয়ামী লীগ মনে করেছে, দুর্নীতিবাজ লুটেরা ও মাফিয়াচক্রকে হাতে রাখতে পারলে তারা তাদের অপকর্মের নিরাপত্তার স্বার্থে বুক দিয়ে তাদের পক্ষে থাকবে, পাশাপাশি তারাও নিরাপদে ক্ষমতা ভোগ করে চেটেচুটে খেতে থাকবে । আর এ-লক্ষ্যটি অর্জন করার জন্যই মুক্তিযুদ্ধের শক্তির বাইরে যে অপশক্তির কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে তাদের সাথে মিলেমিশে থাকা । তারা ঐ অপশক্তির মধ্যেই তাদের যাবতীয় নিরাপত্তা বলে ভেবে নিতে যেয়ে তারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অঙ্গীকার থেকে যোজন যোজন মাইল দূরে সরে গিয়েছে । এ-প্রক্রিয়ায় তারা মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তিকে বন্ধু বানিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তিকে শত্রু বানিয়ে ফেলছে । এ-যেনো নিজের ছায়াকে অবিশ্বাস করার মতো অবস্থা ! এটা যে কতো বড়ো আত্মবিনাশী পদক্ষেপ যার পরিণতি ভয়াবহ হতে বাধ্য । আর এটাই সত্য যে, এই ভয়াবহ পরিণতিতে আজকে আওয়ামী লীগ যাদের বন্ধু ভেবে বুকে ঠাঁই দিয়েছে, তারাই হবে সেই করুণ পরিণতির কারণ । তারাই সবার আগে তাদের পরিত্যাগ করবে ।

এতোকিছুর পরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি ও মুক্তিযোদ্ধারা বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রীর প্রতি প্রবল আস্থা রাখেন ।
সবকিছু পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে যে, দলীয়ভাবে আওয়ামী লীগ ও তার সরকারের জন্য নয়----দেশটি এখনো দাঁড়িয়ে রয়েছে একা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনারই ব্যক্তিগত সততা সাহস মেধা ও দেশপ্রেমের ভাবমূর্তির ওপর । এটা একটা দেশ ও জাতির জন্য মোটেই সুখকর নয় । দেশ, দল ও সরকার পরিচালিত হওয়া উচিত আদর্শিক ও চেতনানির্ভর একটি একক মননশীল টিমওয়ার্কের মাধ্যমে । চারদিকে অসৎ ও দুর্নীতিবাজচক্র পরিবেষ্টিত থেকে কোনো একক সৎ ব্যক্তির পক্ষে দেশকে নেতৃত্ব দিয়ে কাঙ্ক্ষিত পথে এগিয়ে নেয়া যায় না । অন্যদিকে একক ব্যক্তির পক্ষে অগণন দুর্নীতিবাজ ও লুটেরাচক্রের বিরুদ্ধে কঠোর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করাও সম্ভব নয় । কিছু কিছু ক্ষেত্রে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান শুরু করেও তাঁকে আবার পিছু হটতে হচ্ছে । এ-যেনো কালসাপের লেজে বাড়ি দিয়ে ভয় দেখানোর মতো অবস্থা । কিন্তু সাপের লেজে বাড়ি দিতে যেয়ে একসময় ছোবলও খেতে হয় । তাই লেজে নয়, সাপের মাথা গুড়িয়ে দেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ ।

এজন্য কৌশলে ক্ষমতার গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে দল ও দলের বাইরে অবস্থানরত শুভানুধ্যায়ীদের মধ্য থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শাণিত সৎ মেধাবী সাহসী ও ত্যাগী লোকদের বসিয়ে দিয়ে দুর্নীতিবাজ লুটেরা ও মাফিয়াচক্রকে ধরাশায়ী করার কঠিন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে । এরপর দলের জন্য ক্ষতিকর দুর্নীতিবাজ লুটেরা হাইব্রিড ও সুযোগসন্ধানীদের বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান চালিয়ে বের করে দিয়ে সৎ সাহসী ও ত্যাগী নেতাকর্মীদের দলে প্রতিস্থাপন করতে হবে । তৃতীয়ত: বঙ্গবন্ধুর আদর্শ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অঙ্গীকারের ভিত্তিতে দেশকে পরিচালিত করার লক্ষ্যে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে পরিহার করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তিকে রাষ্ট্র ক্ষমতার সাথে সম্পৃক্ত করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি করতে হবে । এসব কার্যক্রম শুরু করার পূর্বে শেখ হাসিনাকে তাঁর ব্যক্তিগত নিরাপত্তার ব্যাপারে সবিশেষ সজাগ থাকতে হবে ।

লেখক :চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।