শিতাংশু গুহ


একদা নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগে আলী আহমদ চুনকা ছিলেন একটি সংগ্রামী নাম। মেয়র সেলিনা হায়াত আইভী তাঁর কন্যা। পিতা চুনকা’র বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিলো তিনি হিন্দুর জমি দখল করেছেন, এবং এজন্যে একবার তিনি নির্বাচনে পরাজিত হ’ন? মেয়র আইভী’র বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ উঠেছে? বন্দর শহর নারায়ণগঞ্জে মেয়র আইভী ও শামীম ওসমান, এমপি’র ‘ঝগড়া’ সবার জানা। তাই যে কেউ ভাবতে পারেন ‘লক্ষী-নারায়ণ জিউ টেম্পল/ জিউস পুকুর’ দেবোত্তর সম্পত্তি দখলের বিষয়টি আসলে আওয়ামী লীগের দুই গ্রূপের মধ্যেকার অভ্যন্তরীণ কোন্দল, অথবা শামীম ওসমান-আইভী দ্ধন্ধের বহি:প্রকাশ? হতে পারে, আবার নাও হতে পারে! তবে আইভী’র বিরুদ্ধে হিন্দুদের আন্দোলনে শামীম ওসমান লাভবান হচ্ছেন, তা মেয়র ভালোই বুঝেন। 

আইভীর পিতা দেবোত্তর সম্পত্তি দখলের অভিযোগে নির্বাচনে পরাজিত হয়েছেন, কিন্তু হিন্দুরা সম্পত্তি ফেরত পায়নি। আন্দোলনরত হিন্দুদের লক্ষ্য থাকতে হবে সম্পত্তি উদ্ধার, শামীম ওসমান-আইভী ফাইটে দাবার ঘুঁটিতে পরিণত না হওয়া। সম্পত্তিটি দেবোত্তর, অতএব বিক্রয়যোগ্য নহে। কেউ যদি তা বিক্রী বা ক্রয় করেন, সেটি তাঁদের দায়িত্ব, এবং আইনের দৃষ্টিতে তা অবৈধ ও অকার্যকর। ফরিদপুরে মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন যখন গায়ের জোরে অরুন গুহ মজুমদারের ‘দয়াময়ী হাউস’ কেনেন বা দখল করেন, তখন আবদুল গাফফার চৌধুরী নিউইয়র্কে ছিলেন, তাকে ঘটনা জানালে তিনি বলেন, ‘হিন্দুর সম্পত্তি গনিমতের মাল’---। নারায়ণগঞ্জে ‘জিউস পুকুর’ দেবোত্তর সম্পত্তি কি গনিমতের মাল?

জানা যায়, ২২শে আগষ্ট ১৯৭৯ তে একই দিনে ‘জিউস পুকুর’ দেবোত্তর সম্পত্তি, নিয়ে ৬টি দলিল সম্পাদিত হয়? এতে মেয়র সেলিনা হায়াত আইভী’র নাম নেই, তাঁর জ্ঞাতি-গোষ্ঠী অনেকের নাম আছে! এরমধ্যে তাঁর নানা, মা, চাচা, মামা, ভাই’র নাম জড়িত। এঁরা জিউস পুকুর শুধু দখল করেছেন তা নয়, বরং মানুষ যে ঘাটগুলো ব্যবহার করতো পুকুরের সেই ঘাটগুলো সব বন্ধ করে দিয়েছেন। অন্য একটি সূত্র জানায়, আইভীর যখন ৭ বছর তখন তার নানা মৃত মাহাতাবউদ্দিন (মাতাব মিয়া) প্রায় ৪৫ বছর আগে কৌশলে মন্দিরের মহারাজের কাছ থেকে অবৈধ উপায়ে জিউস পুকুরের কিছু অংশ ক্রয় করেন। মাতাব মিয়া’র তিন স্ত্রী, অসংখ্য ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনী। আরো একজন জানান, চুনকা’র দূর-সম্পর্কিত ভাই জম্মু (জমির আহমদ) জোর করে পুকুরের কিছু অংশ দখল করেন।

আইভি’র বাবা সাবেক মেয়র আলী আহমদ চুনকা এবং শামীম ওসমানের বাবা ভাষা সৈনিক সামসুজ্জামান জোহা। স্বাধীনতার পর থেকে নারায়ণগঞ্জ আওয়ামীলীগের রাজনীতি এই দুই পরিবারের মধ্যে বিভক্ত। সেই ধারা আজো চলছে। আলী আহমদ চুনকা’র বিরুদ্ধে যখন হিন্দু সম্পত্তি দখলের অভিযোগ ওঠে তখন তিনি তা অস্বীকার করে বলেছিলেন, জিউস পুকুরে আমাদের কোন সংশ্লিষ্টতা নেই। মেয়র আইভি এখন ঠিক বাবা’র কথাই পুনরাবৃত্তি করছেন। এতে কি কাজ হবে? প্রশ্ন হচ্ছে, এতদিন পর আইভী’র বিরুদ্ধে একই অভিযোগ উঠছে কেন? এজন্যে আইভী দায়ী কিনা, অথবা তিনি দায়িত্ব নেবেন কিনা? মেয়র আইভী ইতিমধ্যে দু’জনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল আইনে মামলা করেছেন। হিন্দুরা মন্দিরের সম্পত্তি উদ্ধারে আন্দোলনে নেমেছেন।

নারায়ণগঞ্জের উন্নয়নে আইভী’র অবদান ব্যাপক। সামনে মেয়র নির্বাচন, হেফাজতীরা মাঠে নেমেছে, হিন্দুরাও যদি আইভী’র বিরুদ্ধে যায়, তাহলে কি হবে? নাতনী কি নানা’র অপকর্মের দায় শোধ করে এ সমস্যার সমাধান করবেন? আইভী’র হিন্দু সমর্থক অনেক, এঁরা সরে গেলে তিনি বিপাকে পড়বেন। লাভবান হবেন শামীম ওসমান। শিক্ষক শ্যামল ভক্ত লাঞ্ছনা ঘটনায় সেলিম ওসমান বা ওসমান পরিবারের প্রতি মানুষের, বিশেষত: হিন্দুদের ক্ষোভ ছিলো, তাতে লাভবান হন আইভী। এবার আইভী’র প্রতি ক্ষোভ বাড়লে উপকৃত হবেন শামীম ওসমান। মেয়র আইভী চুপ করে থাকলে সমস্যা বাড়বে। ‘রাজনৈতিক’ মামলা সুফল বয়ে আনবে বলে মনে হয়না। অভিযোগের তীর যখন স্বয়ং মেয়রের পরিবারের দিকে, দায়িত্ব তো তাকে নিতেই হবে!

সাধারণ হিন্দুরা এসব হিসাব-নিকাশ নিয়ে ভাবছে না, তারা দেবোত্তর সম্পত্তি ফেরত চায়। মেয়র আইভী দায় এড়াতে পারেন না? চট্টগ্রামে মেয়র মহিউদ্দীন ‘পশুশালা’ নিয়ে বিপাকে পড়েছিলেন, তিনি নির্বাচনে পরাজিত হ’ন। সদ্য ‘বাঘা যতীন’-র বাড়ী নিয়ে সমস্যা দেখা দিলে সরকার এটি উদ্ধার করেন। হিন্দুদের আন্দোলন যদি অব্যাহত থাকে, সরকার যদি দেবোত্তর সম্পত্তি উদ্ধারে এগিয়ে আসেন, তাহলে কি হবে? মেয়র সামলাতে পারবেন তো? প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি গেছে এবং আরো যাচ্ছে, দেশে-বিদেশে এনিয়ে কথা হচ্ছে। একজন মেয়রের বিরুদ্ধে এমত অভিযোগ কাম্য নয়। মেয়র আইভী’র হাত পরিচ্ছন্ন, তা প্রমান করার দায়িত্ব কিন্তু স্বয়ং মেয়র-এর।

লেখক : আমেরিকা প্রবাসী।