রাজারহাট (কুড়িগ্রাম) প্রতিনিধি : ১৯৭৩ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ মাঠে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পাঠ, মুদ্রিত কপির উম্মোচন ও আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ২৬ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার রাতে উত্তরবঙ্গ জাদুঘর ও কুড়িগ্রাম প্রেসক্লাবের আয়োজনে সৈয়দ শামসুল হক মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের কপি উম্মোচিত করা হয়। 

এসময় উপস্থিত ছিলেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম, কুড়িগ্রামে প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলনকারী বীর প্রতিক আব্দুল হাই, কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজের উপাধ্যক্ষ প্রফেসর মীর্জা নাসির উদ্দিন, উত্তরবঙ্গ জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা এসএম আব্রাহাম লিংকন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার উৎপল কুমার রায়, কুড়িগ্রাম প্রেসক্লাবের সভাপতি অ্যাড: আহসান হাবীব নীলু ও সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান বিপ্লব প্রমুখ।
কুড়িগ্রামে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ভাষণের কপি হুবহু তুলে ধরা হলোঃ

কুড়িগ্রামের ভাই ও বোনেরা,আমি জানি যে অনেক দূরের থেকে আপনারা কষ্ট করে আসছেন। অনেকে দূর দূরান্ত থেকে কালকের থেকে এসে বসে আছেন। আপনারা আমাকে দেখতে চান। তাই সামনের দিকে এগিয়ে আসতে চান, সেটা আমি বুঝি। আপনাদের কাছে আমার বলার কি আছে, যখন আমি দেখি যে,দূর দূরান্ত থেকে আপনারা শুধু আমাকে দেখবার জন্য ছুটে আসেন। যে ভালোবাসা আপনারা জীবন ভরে আমাকে দিয়েছেন, সেই ভালোবাসা যে কত বড় জিনিস যা জীবনে কেউ পেয়েছি কিনা বা কোন নেতা পেয়েছে কিনা আমার জানা নাই। কুড়িগ্রামের ভায়েরা বোনেরা গত স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আপনারা যে কষ্ট স্বীকার করেছেন, যে অত্যাচার সহ্য করেছেন, যে গ্রামকে গ্রাম পাকিস্তানের বর্বর বাহিনী জ্বলিয়ে দিয়েছিল, তখন এ কুড়িগ্রামের ভায়েরাও সাড়ে সাত কোটি মানুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পাকিস্তান বর্বরদের বিরুদ্ধে আপনারা রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। পঁচিশ বছর পর্যন্ত পাকিস্তানের বর্বর শোষকরা আমার সোনার বাংলাকে লুট করে শেষ করে দিয়েছে। আমার সম্পদ লুট করেছে, আমার অর্থ লুট করেছে, আমার যা কিছু ছিল তা লুট করেছিল। তার পরে গত যুদ্ধেও সময় আমার সমস্ত জ¦ালিয়ে পুড়িয়ে ঝাড়খার করে দিয়েছে।

হ্যাঁ, সব নিতে পারে কিন্তু বাংলার মাটি নেবার পারে নাই। সব নিতে পারে কিন্তু বাংলার সোনার মানুষকে ধ্বংস করতে পারে নাই। সব নিতে পারে বাংলার মানুষের আদর্শ কে ধ্বংস করতে পারে নাই। ইনশাল্লাহ দেশ যখন স্বাধীন হয়েছে, দেশ যখন মুক্ত হয়েছে, পঙ্গপালের দলকে যখন আমরা শেষ করতে পেরেছি, দুঃখ কষ্ট আমাদের আছে। কারোর কিছুই নাই, জেলের থেকে বের হয়ে এসে যখন আমি দেখলাম যে কিছুই নাই, কি করে আমার সাড়ে সাত কোটি লোক বাঁচবে? কোথায় কাপুড়, কোথায় তেল, কোথায় খাবার, কোথায় পেট্রোল, কোথায় বীজ, কোথায় আমার মানুষের লাঙ্গল, কোথায় আমাদের মানুষের গরু, যার যেখানেযা পেয়েছে সবকিছু শেষ করে দিয়ে গেছে। তবুও মানুষকে বাঁচাতে হবে। কি করে আল্লাহ আপনাদেও বাঁচিয়ে রেখেছে সত্যি আমি বলতে পারি না। বোধ হয়ে আল্লাহর মেহেরবাণী ছিল তাই কোন মতে দুমুঠো করে এনে বাংলার গ্রামে কাছে পৌঁছে দিয়েছি। কোটি কোটি টাকার রিলিফ, ১০০ কোটি টাকা আমি গ্রামে দিয়েছি। দুঃখ হয় চরিত্রের পরিবর্তন হয় নাই।

এখনো একদল লোক আছে যারা গরীবকে লুট করে খায়, রিলিফের মাল চুরি করে খায়, এদের আমি বাংলার মাটি থেকে উৎখাত করতে চাই। ধ্বংস করতে চাই। এরা মানুষ না, এরা মানুষের অযোগ্য, এরা পশুর চেয়েও অধম। মানুষকে ভালোবাসতে হবে, মানুষকে ভালো না বেসে মানুষের সেবা করা যায় না। মানুষকে ভালোবাসার মধ্যে যদি কৃপণতা আর স্বার্থ থাকে সে স্বার্থ নিয়ে মানুষকে ভালোবাসা যায় না। আর ভালোবাসা পাওয়াও যায় না। আমার দুঃখ হয়, আজও পাকিস্তানি বর্ববরা আমার তিন-চার লক্ষ বাঙ্গালিকে আটকায় রেখেছে, তারা ছাড়ছেনা। তারা ত্রিশ লক্ষ লোকের জীবন নিয়েও শান্তি পায় নাই। আমি বার বার অনুরোধ করছি।

আমি বিশ্ব দুনিয়ায় বিবেকের কাছে অনুরোধ করেছি। সমস্ত দুনিয়ার বড় বড় দেশের কাছে অনুরোধ করেছি এবং বলেছি, তোমরা আমার বাংলার মানুষকে ফেরৎ আনার বন্দোবস্ত করে দাও। তোমরা যখন এই যুদ্ধ হয়, যখন আমার বাংলার মানুষকে হত্যা করে, তখন তোমরা অনেকেই দেখেও দেখো নাই। কিন্তু এই সাউথ ইস্ট এশিয়ার, এই উপমহাদেশে শান্তি বজায় করতে হলে, আমি শান্তিতে বাস করতে চাই। কারো সঙ্গে আমি দুশমনি করতে চাই না। আমি চাই আমার এই সোনার দেশের মানুষ কাজ করুক, খাক। কারো সাথে আমার দুশমনি নাই। যদি আমার গায়ে এসে কেউ পড়ে, যদি কেউ আঘাত করার চেষ্টা করে, আমার দেশ এতো ছোট নয়, মানুষ যতটুকু মনে করুক না কেন আমার দেশের সাড়ে সাত কোটি লোক, আমার দেশ দুনিয়ার অষ্টম বৃহৎ রাষ্ট্র।

আমার মানুষ একতাবদ্ধ, আমার দেশ সংগঠিত, আমার দেশ, দেশের জনসাধারণ যা আমি বলি তাই শোনে। বাংলার মানুষকে নিয়ে ভূট্টো সাহেব আর খেলার চেষ্টা করোনা। আপনাাদের কাছে আমি আবেদন করবো-যা আপনারা সত্য পথে চলবেন, ন্যায়ের পথে চলবেন, অন্যায়ের মোকাবেলা করবেন, দেশকে ভালোবাসবেন এবং দেশকে গড়বেন এবং আপনারা যদি পয়দা করতে পারবেন তা সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে বাস করতে পারবেন। ভবিষ্যতে আমরা যারা আছি আমাদের বয়স হয়েছে, আমরা ভোগ করতে না পারি কিন্তু এমন কিছু করে যাই যাতে আমাদের ভবিষ্যত বংশধররা আর মানুষের কাছে হাত পাততে না হয়। ওরা সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে বাস করতে পারে। সোনার দেশ, সোনার বাংলা হয়ে যায়। খোদা হাফেজ। জয় বাংলা।

(পিএস/এসপি/ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০২১)