আন্তর্জাতিক ডেস্ক : যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের ৪৫ বছরের দ্বন্দ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছায়াযুদ্ধ চলেছিল প্রায় সারা বিশ্বেই। তবে স্নায়ুযুদ্ধের তীব্রতা সবচেয়ে ছিল ইউরোপে। সেখানে সোভিয়েতের ভয় ছিল প্রভাব হাতছাড়া হওয়া নিয়ে; আর মার্কিনিরা সারাক্ষণই খোঁচাচ্ছিল, মিত্ররা নরম হয়ে পড়েছে বলে। এখনকার চীন-যুক্তরাষ্ট্র দ্বন্দ্ব তার থেকে অনেকটাই আলাদা। তাইওয়ান-উত্তর কোরিয়া ইস্যু বাদ দিলে অন্তত কোনো পক্ষই সামনাসামনি একে অপরের দিকে অস্ত্র তাঁক করে নেই। তারপরও এ দুই পরাশক্তির প্রতিযোগিতা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে একটি অঞ্চলে: দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া। যদিও এ অঞ্চলে প্রত্যক্ষ যুদ্ধের কোনও চিহ্ন নেই, তবে সেটি পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার লোকেরা ইতোমধ্যে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রকে দুটি পৃথক মেরু হিসেবে দেখে। উদাহরণস্বরূপ, যারা সম্প্রতি মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছেন, তাদের হাতে থাকা প্ল্যাকার্ডগুলোতে সেনাশাসকদের সমর্থন করায় চীনকে আক্রমণ এবং এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে হস্তক্ষেপের আহ্বান জানানো হচ্ছে।

এ অঞ্চলের সরকারগুলো চীন না যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ নেবে, তা নিয়ে মারাত্মক চাপের মুখে রয়েছে। ২০১৬ সালে ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট রড্রিগো দুতের্তে অবশ্য পরিষ্কার ঘোষণা দিয়েছিলেন, তারা যুক্তরাষ্ট্রকে দূরে ঠেলে চীনের দিকে আগাচ্ছেন। দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের একচ্ছত্র আধিপত্য দাবি নিয়ে এ অঞ্চলের প্রধান জোট আসিয়ানেও বেশ উচ্চবাচ্য হয়েছে।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আধিপত্যের এই লড়াই আরও জোরদার হবে মূলত দু’টি কারণে। প্রথমত, চীনের কাছে কৌশলগতভাবে এ অঞ্চলের গুরুত্ব ব্যাপক। এটি চীনাদের একেবারে দোরগোড়ায়, তারওপর একদিকে তেল ও অন্য কাঁচামাল আমদানি, অন্যদিকে তৈরি পণ্য রফতানির বড় রুট। পূর্ব দিকে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইয়ানের মতো মার্কিন মিত্রদের জন্য চীনের অবস্থা বেশ খারাপ। সেই তুলনায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অনেকটাই শান্তশিষ্ট। এই পথ দিয়ে চীনারা সহজেই ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরে প্রবেশ করতে পারে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তি হয়ে ওঠার মাধ্যমেই এই ‘অবরোধাতঙ্ক’ থেকে মুক্তি পেতে পারে চীন।

তবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া শুধু অন্যত্র যাওয়ার পথে সামান্য স্টেশন নয়। এ অঞ্চল ঘিরে প্রতিযোগিতা তীব্র হয়ে ওঠার দ্বিতীয় কারণ ধারণার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। এখানে প্রায় ৭০ কোটি লোকের বসবাস, যা ইউরোপীয় ইউনিয়ন, লাতিন আমেরিকা বা মধ্যপ্রাচ্যের চেয়েও বেশি। সম্মিলিতভাবে একে যদি একটি অর্থনৈতিক শক্তি ধরা হয়, তাহলে সেটি হবে বিশ্বের মধ্যে চতুর্থ। চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের পরেই বৃহত্তম অর্থনীতি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার। এটি বাড়ছেও অত্যন্ত দ্রুত।

এক দশক ধরে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার অর্থনীতি বাড়ছে পাঁচ থেকে ছয় শতাংশ হারে, ফিলিপাইন ও ভিয়েতনামে এর পরিমাণ ছয় থেকে সাত শতাংশ। মিয়ানমার-কম্বোডিয়ার মতো এ অঞ্চলের দরিদ্র দেশগুলোর অর্থনীতি বাড়ছে আরও দ্রুত। চীনবিমুখ বিনিয়োগকারীদের প্রধান ব্যবসায়িক কেন্দ্র হয়ে উঠেছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া। এ অঞ্চলের ভোক্তারাও এখন লোভনীয় বাজার ধরতে প্রস্তুত।

বাণিজ্যের পাশাপাশি ভূরাজনৈতিক ক্ষেত্রেও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া একটি পুরস্কারস্বরূপ। আপাতদৃষ্টিতে দেখা যায়, দুই প্রধান প্রতিযোগীর মধ্যে সেই পুরস্কার হাতিয়ে নিচ্ছে চীনারাই। চীন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার, এ অঞ্চলে মার্কিনিদের তুলনায় চীনারা অনেক বেশি বিনিয়োগ করে থাকে। এখানকার অন্তত একটি দেশ- কম্বোডিয়া, ইতোমধ্যেই সব দিক থেকে চীনের আওতাধীন। অন্য দেশগুলোর মধ্যেও কেউ চীনকে ডিঙিয়ে সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ নিতে যাবে না।

তবে খুব কাছ থেকে দেখলে লক্ষ্য করা যায়, চীনের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই বন্ধনে অনেক ফাঁক-ফোকর রয়েছে। চীনা বিনিয়োগ বিপুল হলেও তাতে ঘাটতি রয়েছে। দুর্নীতি বা পরিবেশগত ঝুঁকি অগ্রাহ্য করার অভিযোগ রয়েছে চীনের প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে। তাদের অনেকেই আবার স্থানীয়দের বাদ দিয়ে চীনা কর্মী নিয়োগ দিতে আগ্রহী, যাতে অর্থনৈতিক লাভ কমে যাচ্ছে। তাছাড়া, সামান্য মনোক্ষুণ্ন হলেই চীনের বাণিজ্য ও বিনিয়োগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার বদঅভ্যাস অন্য দেশগুলোর জন্য আতঙ্কের কারণ।

প্রতিবেশীদের ওপর চীনা সামরিক বাহিনী ছড়ি ঘোরানোতেও হতাশা বাড়ছে এ অঞ্চলে। দক্ষিণ চীন সাগর দখলের পাশাপাশি আশপাশের জলসীমায় মাছ ধরা বা তেল-গ্যাস অনুসন্ধান নিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় নৌযানগুলোকে চীন নিয়মিত হয়রানি করা উত্তেজনার অন্যতম কারণ। এ নিয়ে চীনের সঙ্গে এখানকার প্রায় প্রতিটি দেশেরই ঝামেলা রয়েছে। মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক সরকারবিরোধীদের সঙ্গেও যোগাযোগ রয়েছে চীনাদের।

এসব কারণে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীন অনেকটাই অজনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ভিয়েতনামে প্রায়ই চীনবিরোধী বিক্ষোভ হয়। বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম জনগোষ্ঠীর দেশ ইন্দোনেশিয়ায় অবৈধ চীনা অভিবাসন ও মুসলিম সংখ্যালঘুদের সঙ্গে চীনের আচরণের বিরোধিতায় বিক্ষোভ হতে দেখা গেছে। এমনকি লাওসের মতো ছোট্ট দেশেও চীনবিরোধী সুর শোনা যায়।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নেতারা হয়তো অর্থনৈতিক পরিণতির ভয়ে সরাসরি চীনের সমালোচনা করতে সাহস পাবেন না, তবে খুব বেশি চীনঘনিষ্ঠ হওয়া নিয়ে জনগণের ক্ষোভের বিষয়টিও মাথায় রাখতে হচ্ছে তাদের। ফলে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীনাদের জন্য আধিপত্যের নিশ্চয়তা এখনও বহুদূর। এ অঞ্চলের দেশগুলো ধনী প্রতিবেশীর বিনিয়োগের লোভ না ছাড়লেও যুক্তরাষ্ট্রের মতো শান্তি, স্থিতিশীলতা ও নিয়মতান্ত্রিক শাসন তারাও প্রত্যাশা করে। দুই পরাশক্তির দ্বন্দ্ব থেকে এখন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো কী সুবিধা বের করে আনতে পারে, সেটাই দেখার বিষয়। দ্য ইকোনমিস্ট।

(ওএস/এসপি/মার্চ ০১, ২০২১)