মানিক সরকার মানিক, রংপুর : রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিশেষ উন্নয়ন প্রকল্পে উপাচার্য অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অনিয়ম-দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের গঠিত তদন্ত কমিটি। তদন্ত প্রতিবেদনে সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়া লঙ্ঘনসহ অনৈতিক কর্মকান্ডের জন্য সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ারও সুপারিশ করা হয়েছে। 

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে জন্য ২০১৫ সালের ১৩ জানুয়ারি একনেক সভায় ৯৭.৫০ কোটি টাকা অনুমোদন দেওয়া হয়। এরমধ্যে ছাত্রীদের আবাসনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর নামে ‘শেখ হাসিনা হল এবং প্রধানমন্ত্রীর স্বামীর নামে প্রতিষ্ঠিত ড. ওয়াজেদ রিসার্চ এন্ড ট্রেনিং ইন্সটিটিউট-এর জন্য একটি স্বতন্ত্র ভবন নির্মাণের জন্য ৭৮ কোটি ২২ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। প্রকল্পের মেয়াদ নির্ধারণ করা হয় ১ জানুয়ারি ২০১৫ থেকে ৩০ জুন ২০১৮ পর্যন্ত। দরপত্রের মাধ্যমে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আর্কিটেক মনোওয়ার হাবিব ও প্রাকৃত নির্মাণ লিমিটেড যৌথভাবে অংশগ্রহণকারী কোম্পানিকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়।

১৪ জুন ২০১৭ ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাাহ নতুন উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর প্রকল্পের নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন কাজ তদারকি করার জন্য উপাচার্যের ঘনিষ্ঠ প্রকৌশলী মঞ্জুর কাদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা, উন্নয়ন ও ওয়ার্কস কমিটি সদস্য নিয়োগ দেওয়া হয়। প্রকৌশলী মঞ্জুর কাদের ওই দরপত্রের মাধ্যমে অংশগ্রহণকারী পরামর্শক প্রতিষ্ঠান প্রফেশনাল অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেড এর স্বত্বাধিকারী। আইন ও চুক্তি লঙ্ঘন করে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান আকির্টেক্ট মনোওয়ার হাবিব ও প্রাকৃত নির্মাণ লিমিটেড এর কার্যাদেশ বাতিল করে প্রকৌশলী মঞ্জুর কাদেরকে ২য় পরামর্শক নিয়োগ দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে আর্কিটেক্ট মনোওয়ার হাবিবকে নানাভাবে ভয়ভীতিও প্রদর্শন করা হয়। শেখ হাসিনা ছাত্রী হলের মূল আর্কিটেক্ট বলেন, নকশা পরিবর্তন করে একটি অস্বাস্থ্যকর ও অনিরাপদ ভবন নির্মাণের চেস্টা চলছে।

অনুমোদিত ডিপিপির তোয়াক্কা না করেই ভবন দুটির নকশা পরিবর্তন করা হয়। পাশাপাশি নির্মাণে ব্যয় বাড়ানো হয় দুই গুণেরও বেশি। ড. ওয়াজেদ রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ভবনে নির্মাণ ব্যয় ২৬ কোটি ৮৭ লাখ থেকে বাড়িয়ে ব্যয় ধরা হয় ৬১ কোটি টাকা। আর ৫১ কোটি ৩৫ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে শেখ হাসিনা ছাত্রী হল নির্মাণে ব্যয় ধরা হয় ১০৭ কোটি টাকা। অন্যদিকে মূল ডিপিপিতে পরামর্শক ফি না থাকলেও বর্তমান উপাচার্য সেই খাতে ব্যয় করেছেন ৪০ লাখ টাকা। অপরদিকে ২০১৯ সালের ১২ ডিসেম্বর শিক্ষামন্ত্রীর সভাপতিত্বে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকল্প পরিচালকদেরকে নিয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন প্রকল্পের নানা অসঙ্গতি নজরে আসলে ইউজিসিকে তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়। মঞ্জুরি কমিশন ২০২০ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারী ইউজিসির সদস্য প্রফেসর ড. মুহাম্মদ আলমগীরকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের পরিচারক ড. ফেরদৌস জামান এবং অতিরিক্ত পরিচালক ড. দুর্গারানী সরকার।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, পরামর্শক প্রতিষ্ঠান জয়েন্ট ভেঞ্চার অব আর্কিটেক্ট মনোয়ার হাবীব এন্ড প্রাকৃত নির্মাণ লিমিটেডের সাথে সমঝোতা না করে প্রফেসর ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ দ্বিতীয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান মেসার্স একিউম্যান আকির্টেক্ট এন্ড প্লানার্স লিমিটেডকে নিয়োগ প্রদান করা পাবলিক প্রকিউরমেন্ট এ্যাক্ট ২০০৬, পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস ২০০৮ এবং প্রকল্প পরিচালকের সাথে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান চুক্তির নিয়মাবলীর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন বলে কমিটি মনে করে।

শেখ হাসিনা ছাত্রী হল এবং ড. ওয়াজেদ রিসার্চ ইনস্টিটিউটের জন্য প্রকৃত নকশা বা ডিজাইনের উপর ভিত্তি করে প্রধানমন্ত্রী ২০১৭ সালের ৪ জানুয়ারি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ভবন নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন। তাছাড়া ইতোমধ্যে উক্ত ভবনটির অর্ধেকের বেশি কাজ সম্পন্ন হয়েছে। তাই এখানে দ্বিতীয় ড্রয়িং বা ডিজাইনের কোন ধরনের প্রয়োজন আছে বলে কমিটি মনে করে না। স্বাধীনতা স্মারকের অসমাপ্ত কাজ কিভাবে সম্পন্ন করা হবে তা সুষ্ঠু সমাধান মূল পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ও আকিটেক্ট মনোয়ার হাবিবই করতে পারবেন। বর্তমানে আর্কিটেক্ট মনজুর কাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন ওয়ার্কস কমিটির সদস্য হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমান উপাচার্য কর্তৃক মনোনীত আছেন।

এই সময়ে দ্বিতীয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত মেসার্স একিউম্যান আর্কিটেক্ট এন্ড প্লানার্স লিমিটেড ভবন সংশোধিত ড্রইং বা ডিজাইন প্রণয়ন করে বর্তমান প্রকল্প পরিচালক উপাচার্যের কাছ থেকে অনুমোদন নিয়েছেন। আর্কিটেক্ট মনজুর কাদের পরিকল্পনা উন্নয়ন, ওয়ার্কস কমিটির সদস্য থাকা সত্বেও এ রকম একটি অগ্রহণযোগ্য এবং ঝুঁকিপূর্ণ ড্রয়িং বা ডিজাইন অনুমোদিত হয়েছে। তাই তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে আর্কিটেক্ট মনজুর কাদেরকে কমিটি থেকে অব্যাহতি দেয়া স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার স্বার্থে প্রয়োজন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি অবকাঠামো নির্মাণের জন্য যে অবহেলা, দীর্ঘ সূত্রিতা, অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে তা বর্তমান প্রশাসনের অনৈতিকতা, অদক্ষতা এবং ব্যক্তিগত ইচ্ছা অনিচ্ছার বহিঃপ্রকাশ। এতে সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তিও চরমভাবে ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাহী প্রধান এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্বে থাকার জন্য বর্তমান উপাচার্য প্রফেসর ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহকে এই দায় দায়িত্ব অবশ্যই বহন করা উচিত।

(এমএস/এসপি/মার্চ ০৩, ২০২১)