চাটমোহর (পাবনা) প্রতিনিধি : শুনেছ কি বন্ধু তোমরা বড়াল নদীর নাম, বড়াল নদীর কূলে দোলে ছায়ায় ঘেরা সবুজ গ্রাম। বড়াল নদীকে নিয়ে অনেক আগে রচিত হয়েছে এ গান। কিন্তু সেই ঐতিহ্যবাহী বড়াল নদীতে এখন ভরা বর্ষা মৌসুমেও পানি নেই।

টানা বর্ষণ, পাহাড়ী ঢল ও অস্বাভাবিক জোয়ারে সারাদেশে নদীর পানি বেড়ে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। বন্যায় বিভিন্ন জেলায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছে লাখ লাখ মানুষ। অনেক স্থানে ডুবে গেছে সড়ক, তলিয়ে গেছে ঘরবাড়ি, বাঁধ ভেঙ্গে প্লাবিত হয়েছে গ্রামের পর গ্রাম। ভাঙ্গনে অনেক পরিবার হচ্ছে গৃহহারা। পদ্মা-যমুনা ব্রক্ষ্মপুত্রসহ বড় নদ-নদীগুলোর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কিন্তু বড়াল নদীর চিত্র ঠিক উল্টো ভরা বর্ষায়ও পানি নেই বড়াল নদীতে। এক সময়ের প্রমত্তা বড়াল এখন মরাখালে পরিনত হয়েছে।


পাবনার চাটমোহর উপজেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীটির নাম বড়াল। এলাকাবাসীর কাছে এখন এটা মরাবড়াল নামেই পরিচিত। প্রমত্তা পদ্মা নদীর রাজশাহীর চারঘাট মোহনা থেকে উৎপন্ন হয়ে নাটোরের বড়াইগ্রাম ও চাটমোহর উপজেলার মধ্যদিয়ে উপজেলার নূরনগরে গুমানী নদীর সাথে মিলিত হয়ে বড়াল নামে ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর, বেড়া উপজেলার মধ্যদিয়ে বাঘাবাড়ি হয়ে হুরাসাগরে মিশে নাকালিয়ার নিকট যমুনায় মিলিত হয়েছে। প্রমত্তা বড়াল নদীতে চাটমোহরে ১৯৮২ সালে আড়াআড়িভাবে দেওয়া চারটি ক্রস বাঁধ নদীটিকে বদ্ধ জলাশয়ে পরিণত করে।


বড়াল নদী সচল করতে সকল ক্রসবাঁধ অপসারণ ও ব্রীজ নির্মাণ করা, গুমানীর সাথে বড়ালের সংযোগস্থলের মাটির বাঁধের প্রতিবন্ধকতা অপসারণ, ৩০ দিনের মধ্যে নদী ও ক্যানেল খননের সিদ্ধান্ত হলেও তা এখন কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ রয়েছে।


জানা যায়, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) বড়াল নদী রক্ষায় হাইকোর্টে একটি রিট পিটিশন দাখিল করলে, হাইকোর্ট চলতি বছর ১৯ ফেব্রুয়ারী সুপারিশ বাস্তবায়নের অগ্রগতি জানতে চেয়ে বিবাদীদের প্রতি রুল জারি করেন। এরপর পাবনা জেলা প্রশাসন চলতি বছরের ১২ মে এক সভায় এক মাসের মধ্যে চাটমোহরের সকল ক্রসবাঁধ অপসারণ ও ব্রীজ নির্মাণ করা, ১৫ দিনের মধ্যে গুমানীর সাথে বড়ালের সংযোগস্থলের মাটির বাঁধের প্রতিবন্ধকতা অপসারণ এবং ৩০ দিনের মধ্যে নদী ও ক্যানেল খননেরও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কিন্তু সেটি এখনও বাস্তবায়ন না হয়ে কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ রয়েছে।
২০১৩ সালের ১৪ নভেম্বর নদী বিষয়ক টাস্কফোর্সের সভায় সুপারিশমালাগুলো গৃহিত হয়েছে। এরপর চলতি বছর ২২ অক্টোবর কমিটি ৬ দফা সুপারিশ পেশ করেন।


পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো), সড়ক ও জনপদ বিভাগ (সওজ), স্থানীয় সরকার প্রকৌশলী (এলজিইডি) কিংবা স্থানীয় হাইকোর্টের নির্দেশ বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিলেও, তা কেবল কাগজে কলমে। ফলে ভরা বর্ষা মৌসুমেও বড়াল নদীতে পর্যাপ্ত পানি নেই। চলমান করা হয়নি এই নদীটিকে। নদী বিষয়ক টাস্কফোর্সে এবং হাইকোর্টের সিদ্ধান্ত ও নির্দেশ কেবল নির্দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।


বড়ালের দু’টি জল কপাটের (স্লুইস গেট) নিচের নির্গমনপথ (ভেল্ট) ভেঙে দিয়ে অথবা প্রশস্থ করে পানি ছাড়া, চাটমোহর এলাকার ক্রসবাঁধ অপসারণ করে পাকা ব্রীজ নির্মাণ করা, গুমানী নদীর সাথে বড়ালের সংযোগস্থলের মাটির বাঁধ অপসারণ করা, বড়ালের উৎসমুখ খনন করে নদীর প্রশস্থতা বৃদ্ধি করা এবং বড়ালসহ সকল শাখা নদী ও ক্যানেলের খনন করার জন্য সুপারিশ করে নদী বিষয়ক টাস্কফোর্স গঠিত কমিটি।


গত ২০১৩ সালের ৩ এপ্রিল সভায় তৎসময়ের ভূমি মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান এবং বর্তমান মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক এমপিকে প্রধান করে কমিটি গঠিত হয় ।


২০১৩ সালের ৬ অক্টোবর কমিটির সদস্যরা বড়াল নদীর শাহজাদপুর থেকে রাজশাহীর চারঘাট পর্যন্ত এলাকা পরিদর্শন করেন।


পাউবো সূত্র জানায়, বড়ালের ৪৬ কিলোমিটার এলাকায় সেচের পানি ধরে রাখার উদ্দেশ্যে ১৯৮৫ সালে রাজশাহীর চারঘাটে একটি এবং পরে নাটোরের আটঘরিতে আরেকটি রেগুলেটর বসানো হয়। এরপর থেকেই বড়ালের পানি প্রবাহ থেমে গেছে। আগে যেখানে ৩১ থেকে ৩৫ হাজার কিউসেক পানি প্রবাহিত হতো, এখন সেখানে ৫ হাজার কিউসেক পানি প্রবাহিত হচ্ছে। বড়াল নদী মূলত মৃতপ্রায়।


বড়ালকে বাঁচাতে ২০০৮ সালের ২ আগষ্ট চাটমোহরে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় পাবনা-৩ আসনের বর্তমান সাংসদ আলহাজ্ব মোঃ মকবুল হোসেন, বাপা’র সাধারণ সম্পাদক ডা. আব্দুল মতিনসহ বড়াল পাড়ের সকল উপজেলার মানুষ উপস্থিত ছিলেন।
সভায় বড়াল রক্ষা আন্দোলনের আহবায়ক ভাষা সৈনিক অ্যাডভোকেট গৌর চন্দ্র সরকারকে ও বাপা’র কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য এসএম মিজানুর রহমানকে সদস্য সচিব করে বড়াল রক্ষা আন্দোলন কমিটি’ গঠণ করা হয়। এরপর থেকেই বড়াল রক্ষা আন্দোলন কমিটির ব্যানারে বাপা’র সহায়তায় বড়াল নদীকে অবমুক্ত করা ও বহমান করার দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। বড়াল পাড়ের সকল উপজেলায় সভা-সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। একই সাথে ঢাকাকে চলনবিল কনভেনশনে বড়াল রক্ষার দাবি উপস্থাপিত হয়।


সর্বশেষ বড়াল রক্ষা আন্দোলন কমিটির নেতৃবৃন্দ ও বাপা’র সাধারণ সম্পাদক পানি সম্পদমন্ত্রীর সাথে গত ১৮ জুন’১৪ বৈঠক করেন। বৈঠকে পানি সম্পদমন্ত্রী বড়াল চালু করার বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের রাজশাহীর প্রধান প্রকৌশলীকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ দেন। এছাড়া বড়াল রক্ষা আন্দোলন কমিটি পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের সাথেও বৈঠক করেন।


‘বাঁধ-স্লুইসগেট ভেঙ্গে ব্রিজ করো, বড়াল নদী চালু করো’ দাবিতে ২০১৩ সালের ১৪ মার্চ বিশ্ব নদী দিবসে রাজশাহীর চারঘাট থেকে সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ি পর্যন্ত বড়াল নদী পাড়ে ২২০ কিলোমিটার দীর্ঘ মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), বড়াল রক্ষা আন্দোলন, চলনবিল রক্ষা আন্দোলন ও রিভারাইন পিপলস্ এই মানববন্ধনের আয়োজন করে। এছাড়া বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে বড়াল রক্ষা আন্দোলন কমিটি আন্দোলন করে আসছে।


চারঘাট স্লুইস গেটের তিনটি ভেল্টের দুটিই বন্ধ রয়েছে। একটি সামান্য খোলা রাখা হয়েছে, যা দিয়ে কোন রকমে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। গেটের পশ্চিম পাশে উজানে পানি ফুলে উঠেছে।
এদিকে এই ভরা বর্ষা মৌসুমেও বড়ালে পানি নেই। ফলে চারঘাট, বাঘা, বাগাতিপাড়া, গুরুদাসপুর, বড়াইগ্রাম, চাটমোহর উপজেলার নদীপাড়ের মানুষ পানি পাচ্ছে না। ব্যাহত হচ্ছে সেচ কার্যক্রম। জমির উর্বরা শক্তি হারিয়ে যাচ্ছে। বেকার হয়ে পড়েছে শত শত জেলে পরিবার। বড়ালে পানি না থাকায় প্রায় ১৬ প্রজাতির দেশী মাছ বিলুপ্তির পথে। বড়াল নদী কচুরিপানাতে ভরে গেছে, বেড়েছে মশার উৎপাদন। বড়াল নদী কেন্দ্রিক বিভিন্ন প্রকল্পে ব্যাপক হরিলুট করা হয়েছে। বড়ালকে অবক্ষয়িত জলাশয় হিসেবে চিহ্নিত করে মৎস্য দপ্তর ৬৫ লাখ টাকার প্রকল্প দিয়ে লুটপাট করেছে। এনিয়ে বড়াল রক্ষা আন্দোলন কমিটির পক্ষ থেকে আদালতে মামলাও করা হয়। সেখানে বিবাদীরা বড়ালকে নদী হিসেবে মুচলেকা দিয়ে আসেন, অবক্ষয়িত জলাশয় হিসেবে নয়।


বড়াল রক্ষার বিষয়ে বাপার সাধারণ সম্পাদক ডা. আব্দুল মতিন বলেন, বড়ালকে কেন্দ্র করে পাউবো যত প্রকল্প করেছে, তা কেবল বড়ালকে ধ্বংসই করেছে। স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ পাউবো বড়ালকে হত্যা করে প্রকল্পের নামে লুটপাট করেছে।


নাটোরের পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী বাবুল আক্তার বলেছেন, শুধু ভেল্ট ভেঙ্গে দেওয়ায় আংশিক প্রকল্প ফলপ্রসূ হবে না। বড়ালের সাথে যুক্ত আরও ছোট ছোট নদী রয়েছে, সবগুলোকে নিয়ে একটি সমন্বিত প্রকল্প করতে হবে। এ জন্য তারা মন্ত্রণালয়কে জানাচ্ছে।
বড়াল রক্ষা আন্দোলন কমিটির সদস্য সচিব এসএম মিজানুর রহমান জানান, বড়াল মুক্ত করার যে সকল সিদ্ধান্ত হয়েছে, তা বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে শুরু করে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, কমিটি বড়াল অবমুক্ত করতে নির্দেশনা দিয়েছেন। হাইকোর্টও এ ব্যাপারে রুল জারি করেছেন। স্থানীয় সংসদ সদস্যসহ বড়ালপাড়ের সংসদ সদস্যগণ বড়াল নদী মুক্ত করতে সর্বদা সহযোগিতা করছেন।


তিনি বলেন, আমাদের আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে। আমরা ৯ আগস্ট থেকে এক লাখ মানুষের স্বাক্ষর সংগ্রহ করছি, যা আমরা দ্রুত সকল সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন চাই।
বড়াল রক্ষা আন্দোলন কমিটির উদ্যোগে শনিবার থেকে বড়াল নদী উদ্ধার ও সংরক্ষণের দাবিতে গণস্বাক্ষর সংগ্রহ শুরু হয়েছে।

এই স্বাক্ষর সংগ্রহের উদ্বোধন করেন পাবনা-৩ আসনের এমপি আলহাজ্ব মো. মকবুল হোসেন। নদী বিষয়ক টাস্কফোর্সের সভায় গৃহিত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন না হওয়ায় এবং সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নের দাবিতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়ে গণস্বাক্ষর অভিযান শুরু হয়েছে বলেও তিনি জানান।


(এসএইচএম/এএস/আগস্ট ২৬, ২০১৪)