রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার নাটানা গ্রামের গ্রাম ডাঃ সুদয় মণ্ডলের নির্মাণাধীন বসতবাড়ি, রান্না ঘর ও গোয়ালঘর ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছে জামায়াত কর্মী মতিয়ার গাজী। এর আগে দীর্ঘদিনের কালী মন্দির ভেঙে গুড়িয়ে দিয়ে তিন শতক জমি দখলে নিয়েছে বিএনপি ক্যাডার শাহীন। প্রশাসনের রহস্যজনক ভূমিকার কারণে হামলাকারি ও জবরদখলকারিরা আজো বেপরোয়া। নিরাপত্তাহীনতায় ডাঃ সুদয় মণ্ডলের পরিবার।

সরেজমিনে মঙ্গলবার সকালে আশাশুনি উপজেলার হাড়িভাঙা বাজারের পাশে নাটানা গ্রামে গেলে মৃনাল মণ্ডলের স্ত্রী সুধা রানী মণ্ডল বলেন, গত ৫ মার্চ ভোর ৫টার পরপরই রাস্তার দিকে ভাঙচুরের শব্দ শুনে তিনি এক মাত্র ছেলে জিৎ মণ্ডলকে(৬) নিয়ে ঘরের বাইরে আসেন। জামায়াত কর্মী মতিয়ার, তার ছেলে তুহিন, শাহীন, স্ত্রী আছিয়া খাতুন, বিএনপি ক্যাডার শাহীন, হাড়িভাঙার ফজলে করিম, পামরুজ খাঁ, কবীর খাঁ, কামরুল ঢালীসহ ১২/১৪জন হাতে দা, শাবল, কুড়াল, গাইতি ইত্যাদি নিয়ে তার শ্বশুর ডাঃ সুদয় মণ্ডলের সংস্কারাধীন বসতঘর, রান্না ঘর ও গোয়ালঘর ভেঙে গুড়িয়ে দিচ্ছে।

এগিয়ে যেয়ে প্রতিবাদ করায় তাকে ও তার ছোট বাচ্চাকে উদ্দেশ্য করে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করা হয়। এমনকি হত্যার হুমকিও দেওয়া হয়। শ্বশুর ও স্বামী বাড়িতে না থাকায় মোবাইল ফোনে তাদেরকে অবহিত করে আশাশুনি থানায় ফোন করা হয়। থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ফোন না ধরায় ৯৯৯ এ ফোন করলে উপপরিদর্শক জাহাঙ্গীর হোসেনের নেতৃত্বে পুলিশ এসে মতিয়ার, তার স্ত্রী আছিয়া খাতুন ও ছেলে শাহীনকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। এ সময় অন্য হামলাকারিরা পািলয়ে যায়।

মৃণাল কান্তি মণ্ডল জানান, থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার পরামর্শ অনুযায়ি ুিতনি ৫ মার্চ বিকেলে আটককৃত তিনজনসহ সাত জনের নাম উল্লেখ করে থানায় একটি এজাহার দাখিল করেন। এ সময় মতিয়ারের জামাই ডুমুরয়িা থানার সহকারি উপপরিদর্শক রবিউল ইসলামের উপস্থিতিতে এজাহার ফিরিয়ে দিয়ে আটকৃতদের ছেড়ে দেওয়া হয়। এ সময় মামলা না করে ৮ মার্চ থানায় বসে মীমাংসা করে নেওয়ার জন্য বলেন ওসি। পরবর্তীতে তিনি বসাবসি না করে টালবাহানা করে একপর্যায়ে তাকে হেঁকে দেন ও আদালতে মামলা করতে বলেন। উপায় না দেখে বাবা বাদি হয়ে মঙ্গলবার সাতক্ষীরার আমলী আদালত -৮ এ মামলা দায়ের করেন। জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম বিলাস কুমার মণ্ডল মামলাটি তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য পুলিশ ব্যুরো ইনভেস্টিগেশনকে নির্দেশ দিয়েছেন।

ডাঃ সুদয় কুমার মণ্ডল বলেন, তারা চার ভাই ও দু’ বোন। বড় ভাই হৃদয় মণ্ডল, মেঝ ভাই উদয় ও ছোট ভাই রবিন ২০০৮ সালের দিকে ভারতে চলে যায়। তবে মেঝ বউদি ভারতে যাননি। বর্তমান সেটেলমেন্টে বাবা গোপাল মণ্ডলের নামে এক একর ২৮ শতক জমি দেখা যায়। তাহলে তাদের প্রত্যেক ভাই পাবে ৩২ শতক। এ জমি বিক্রির সময় দখল পজেশান নিয়ে সমস্যা সৃষ্টি হওয়ায় তিনি(সুদয়) বাদি হয়ে ২০০১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর আশাশুনি সহকারি জজ আদালতে দেঃ ১২৬/২০০১ চিহ্নিত বাটোয়ারা মামলা করেন। এ মামলায় প্রথম থেকে আট নং বিবাদীদের বিরুদ্ধে স্থিতাবস্থা জারির নির্দেশ দেয়। ২০১৬ সালের ১১ এপ্রিল ৭৫ শতক তার পক্ষে রায় দেন। বাকী ১৪ শতকের রায় না পাওয়ায় তিনি সাতক্ষীরা জেলা ও দায়রা জজ আদালতে ২২/১৬ নং আপিল মামলা দাখিল করেন। মামলাটি বর্তমানে বিচারাধীন রয়েছে।

তিনি আরো জানান, জামায়াত কর্মী মতিয়ার রহমান গাজী মামলা চলাকালিন সময়ে বড় ভাই হৃদয়ের কাছ থেকে ২০১৮ সালে ৩১ শতক জমি কিনেছেন মর্মে দাবি করে। আবার মেঝ ভাই এর ছেলে দীপঙ্করের কাছ থেকে ২০ শতক জমি কিনেছে মর্মে দাবি করে। ছোট ভাই রবীন্দ্র নাথ মণ্ডলের স্বনামে কোন রেকর্ড বা কোন বৈধ কাগজপত্র না থাকার পরও মতিয়ার রহমান তার কাছ থেকে ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি ৩১ শতক জমি ৩৯ নং দলিল মূলে কিনেছেন মর্মে দাবি করে। একই দিনে সে রবীন্দ্র নাথের কাছ থেকে ৪০ শতক জমি ওই বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে দলিল করে নেওয়ার শর্তে ৪০ নং রেজিষ্ট্রি বায়না দলিল পত্র করে নিয়েছেন মর্মে দাবি করে।

আপিল মামলা চলাকালিন সময় সৃষ্ট ৩৯ নং কোবালা দলিল ও ৪০ নং বায়নাপত্র দলিলের বিরুদ্ধে তিনি(সুদয়) আদালতে আপত্তি দিলে আদালত তা আমলে নেয়। পরিস্থিতি বেগতিক বুঝে মতিয়ার ভাই রবিন্দ্রনাথ মণ্ডলের কাছ থেকে দাবিকৃত ২০২০ সালের ২ জানুয়ারি ২২ নং রেজিষ্ট্রি বায়না পত্রমুলে ৪১ শতক জমি দাবি করে নির্ধারিত সময়ে ওই বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে লিখে না দেওয়ার অভিযোগ এনে ওই বছরের ১৫ ডিসেম্বর যুগ্ম জেলা জজ -২য় আদালতে দেওয়ানী ১৬৭/২০ নং মামলা করে। জানতে পেরে স্বর্ত থাকায় গত ২৮ ফেব্র“য়ারি তিনি ওই মামলায় বিবাদী শ্রেণীভুক্ত হন।

সুদয় মণ্ডল অভিযোগ করে বলেন, বাবার নামে বিএস রেকর্ড অনুযায়ি প্রত্যেক ছেলে ৩২ শতক জমি পেলে ১৪ শতক জমি ১৯৯৫ সালে রবিন তার কাছে বিক্রি করে। বর্তমান রেকর্ডে রবিনের নামে কোন জমি নেই। তাহলে মতিয়ার কোন ভৌতিক কাগজপত্র মূলে ৩১ শতক জমি কোবালা দলিল ও ৮১ শতক জমির রেজিষ্ট্রি বায়না পত্র করলেন? কোন যাদুবলে আশাশুনি সহকারি (ভূমি) কমিশনার মতিয়ারের নামে নামপত্তন করে দেন? মতিয়ার অবৈধভাবে তার ও তার ভাইদের সাড়ে ছয় বিঘা জমি জবরদখল করে রেখেছে।

এদিকে সুদাসী মণ্ডল জানান, তার বাবা গোপাল মণ্ডলের কাছ থেকে দানপত্র মূলে পাওয়া ৬১৩ দাগের ১৬ শতক জমির মধ্যে আট শতক তিনি বিক্রি করেন। লক্ষীখালি গ্রামের নিরোধ বাছাড়ের কাছে এক শতক জমি বিক্রির করতে সম্মত হলে তাকে ২০১০ সালে তিনি নাকতাড়া গ্রামের মানবপাচারকারি শুকলালের বাড়িতে নিয়ে যেয়ে কোন টাকা ছাড়াই গলায় দা ধরে কমিশনের মাধ্যমে অলিখিত কয়েকটি নন জুডিশিয়াল স্টাম্পে সাক্ষর করিয়ে নেওয়া হয়। পরে ৬১৩ দাগে নিরোধ বাছাড়ের নামে এক শতক জমি ও শ্রীউলার আব্দুল হকের ছেলে বিএনপি ক্যাডার আবু সাঈদ ওরফে শাহীনের নামে সাত শতক জমির রেজিষ্ট্রি দলিল দেখানো হয়।

শাহীন ওই জমিতে বাড়ি করার পর সাঈদ ২০১৬ সালে তার(সুদয়) ৬০৮ ও ৬১২ দাগের তিন শতক জমিতে থাকা দীর্ঘ দিনের কালিমন্দিরটি ভেঙে গুড়িয়ে দিয়ে দখলে নেয়। থানায় কোন মামলা না নেওয়ায় শাহীন আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে। ৫ মার্চ তার (সুদয়)সংস্কারাধীন বসতঘর, রান্না ঘর ও গোয়ালঘর ভেঙে দিয়ে ওই জমি নিজের দাবি করে ১১ মার্চ অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে ১৪৫ ধারায় মামলা(পিটিশন-৫৪৯/২১) করেছেন মতিয়ার।

উদয় মণ্ডলের স্ত্রী নমিতা মণ্ডল বলেন, তার স্বামীর নামীয় ৩৯ শতক জমি জোর করে দখলে নিয়ে রেখেছে মতিয়ার রহমান। প্রতিবাদ করলে তার জন্য কবর খুঁড়ে রেখেছে উল্লেখ করে ঘর না বেঁধে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার হুমকি দিয়েছে মতিয়ার। ফলে স্বামীর সব কছিু থাকার পরও তিনি আশ্রয়হীন।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মতিয়ার রহমান বলেন, তিনি কাগজপত্রের বাইরে কোন জমি দখল করেন না।
আবু সাঈদ মোঃ শাহীন বলেন, তিনি কোন মন্দির ভাঙচুর করেননি। সুদয় মণ্ডল জমি পেলে মাপ জরিপ করে দিয়ে দেওয়া হবে।

আশাশুনি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোঃ গোলাম কবীর জানান, বিষয়টি জমিজমা সংক্রান্ত তাই সুদয় মণ্ডলের ছেলেকে আদালতে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বাড়িঘর ভাঙচুর করার সময় অস্ত্রসহ তিনজনকে আটকের বিষয়টি তিনি এড়িয়ে যান।

(আরকে/এসপি/মার্চ ১৬, ২০২১)