আবীর আহাদ


মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের ৩০ লক্ষ এবং ভারতের ১৪ হাজার সৈন্যের মিলিত রক্তধারায় সৃষ্ট আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ । সেই রক্তের মধ্যে বিশেষ কোনো ধর্মের মানুষের রক্ত ছিলো না------ছিলো হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খৃস্টান শিখ জৈন ইহুদিসহ অন্যান্য সম্প্রদায়ের রক্ত । এছাড়া আরেকটি বিষয়ের ওপর সবিশেষ গুরুত্বারোপ করতে চাই যে, সেদিন মুক্তি ও মিত্র বাহিনীসহ বাংলাদেশের সাতকোটি মানুষ কোনো ধর্মীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নয়, কোনো ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নয়,বা কোনো অধর্মীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে কোনো ধর্মকে উৎখাত করার জন্য রক্ত দেয়নি ; সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেনি । সম্পূর্ণ মানবিক মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে ভারতীয়রা আমাদের পাশে এসে তাদের সবকিছু নিয়ে অকৃত্রিম বন্ধুর ভূমিকা পালন করেছিলো । তাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিলো বাংলাদেশের স্বাধীনতাপ্রিয় মানুষ স্বাধীনতা লাভ করুক ।

তবে আমাদের বাংলাদেশের মানুষের লক্ষ্য ছিলো বহুমুখী । আমরা চেয়েছিলাম, ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খৃস্টানের মিলিত একক সার্বজনীন সত্তা-----আমরা বাঙালি । আমাদের লক্ষ্য ছিলো একটি ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক শোষণহীন সমৃদ্ধ শান্তিময় বাঙালি সমাজ নির্মাণ, যে সমাজে ধর্মের ব্যাপারে কোনো বিভেদ হানাহানি থাকবে না-----সবাই স্বাধীনভাবে বাধ্যবাধকতাহীন যার যার ধর্ম পালন করবে; আবার কেউ ধর্ম পালন না-করতেও পারবে । আর একটা লক্ষ্য ছিলো এই, ধর্ম যার যার রাষ্ট্র ও উৎসব সবার । অর্থাৎ আবহমানকালের চিরায়ত শাশ্বত বাঙালি জাতির লোকজ সংস্কৃতি ও কৃষ্টির অবাধ প্রবাহের ফল্গুধারায় সিক্ত থাকবে আমাদের সবার প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ; এদেশের বাঙালিরা । দেশভিত্তিক নাগরিক অর্থে আমরা বাংলাদেশী, কিন্তু জাতিগতভাবে বাঙালি । এ-ভূখণ্ডে বসবাসকারী সব ধর্মীয় সম্প্রদায়ের লোকেরা জাতিগতভাবে প্রথমে বাঙালি, মানুষ, তারপর যে-যার ধর্মীয় সম্প্রদায়ের পরিচয় দিতে পারবে ।

বাঙালি জাতিরাষ্ট্রের জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উনিশশো বাহাত্তর সালের দশ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে স্বদেশের মাটিতে প্রত্যাবর্তন করে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রায় লক্ষ লক্ষ মানুষের সামনে আমাদের জাতীয় পরিচয় প্রদান করে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেছিলেন : আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান ! এটাই সব বাঙালির প্রাণের কথা । বিশ্বাসের কথা । আদর্শের কথা ।

কিন্তু অতীব দু:খের বিষয় এই যে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত ধর্মান্ধশক্তি মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলাম, নেজামে ইসলাম, পিডিপিসহ বিভিন্ন মাদ্রাসার অধিকাংশ আলেম উলামা পীর তথা পাকিস্তানের পদলেহী দালাল শান্তিকমিটি রাজাকার আলবদর আলশামস আলমুজাহিদ বাহিনীর সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত অপশক্তিসমূহ উনিশশো পঁচাত্তর সালে বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাযজ্ঞের পর জেনারেল জিয়া, পরবর্তীকালে জেনারেল এরশাদ ও বেগম খালেদা জিয়ার আশ্রয়-প্রশ্রয়-পৃষ্ঠপোষকতায় এবং হাল আমলে জামায়াত বিএনপি ও ইসলামি ঐক্যজোটের মিলিত আরেক ধর্মীয় জঙ্গিবাদী হেজাজতে ইসলাম, ইসলামি শাসনতন্ত্র আন্দোলন, জেএমবি, হুজি, আনসারুল্লাহ বাংলাটিম, হিজবুত তাহেরি প্রভৃতি কিংভূতকিমাকার ইসলামি জঙ্গিদের যে উত্থান ঘটেছে------তারা একযোগে একাত্তরের পরাজয়ের গ্লানিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও বাঙালির চিরায়ত আদর্শ ও মূল্যবোধের ওপর উপর্যুপরি আঘাত হেনে চলেছে ।

জামায়াত ও অন্যান্য জঙ্গিবাদী সংগঠনকে বর্তমান সরকার শক্তহাতে দমন করতে সক্ষম হলেও এমন কী ঘটেছে যে, জামায়াতের নয়া সংস্করণ হেফাজতের মতো স্বাধীনতাবিরোধী জঙ্গিদের সাথে মুক্তিযুদ্ধের মূলধারা আওয়ামী লীগের একটা সখ্যতা গড়ে উঠতে দেখছি ! তারা আমাদের শিক্ষা কারিকুলামে তাদের সাম্প্রদায়িক চিন্তাচেতনার প্রেসক্রিপশন দেয়ার ঔদ্ধত্য দেখাচ্ছে । বানরকে প্রশ্রয় দিলে একলাফে সে মাথায় উঠে গিয়ে যেমন মুখে চপেটাঘাত মারে, তেমনি হেফাজতিরা আমাদের বাঙালিত্ব ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনার ওপর আঘাত হানছে ! মুক্তিযুদ্ধের রক্তস্নাত পবিত্র মাটিতে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী সাম্প্রদায়িক জঙ্গি দল হেজাজতি তেঁতুল হুজুররা সরকারের কী দুর্বলতার সুযোগে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ বাঙালিত্ব সংস্কৃতি কৃষ্টি শিক্ষা ও ঐতিহ্যসহ ঐতিহাসিক সব ভাষ্কর্য এবং রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতিমালার বিরুদ্ধে নতুন নতুন ফতোয়া দিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আসলে একটা যুদ্ধ ঘোষণা করতে উদ্যত হচ্ছে । তারা আমাদের জাতির পিতা, জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সঙ্গীত মানে না । তারা ঠুনকো অজুহাতে সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা সৃষ্টি করে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর ধারাবাহিক হত্যা অগ্নিসংযোগ লুটপাট ও অত্যাচার চালিয়ে আসছে । আমাদের বদ্ধমূল ধারণা, হেফাজতের পেছনে পাকিস্তানি-মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-সিআইএসহ এখানকার জামায়াত-বিএনপির মদদ রয়েছে । এ ব্যতীত সাম্প্রতিককালে আওয়ামী লীগের মধ্যে অবস্থানকারী একটি লুটেরাচক্রসহ দলের মধ্যে বিভিন্ন সময় গ্রহণকৃত জামায়াত শিবির বিএনপি ও ধর্মীয় জঙ্গিরাও হেফাজতকে শক্তিসাহস যুগিয়ে চলেছে । তারা সবাই মনে করে যে, আওয়ামী লীগকে ঘিরে ফেলে পতন ঘটাতে পারলেই বাংলাদেশের পতন ঘটানো যাবে !

এমন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের বক্তব্য পরিষ্কার । ভিন্ন কোনো কারণে আওয়ামী লীগ হেফাজতকে কীভাবে মূল্যায়ন করছে সেটা আমাদের বিচার্য নয় । আমাদের বিচার্য এই, আমরা মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষ-----আমাদের মহান ত্যাগ তিতিক্ষা শৌর্য বীরত্ব ও রক্তে অর্জিত বাংলাদেশ ও হাজার বছরের বাঙালিত্বের জাত্যাভিমানে লালিত বাঙালি জাতি হেজাজতসহ কোনো উগ্রসাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে কোনোভাবেই বরদাস্ত করতে পারি না । হেজাজতসহ ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বুঝা উচিত : বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি----! তারা যদি সত্যই যুদ্ধ করতে চায়, সরাসরি ঘোষণা দিক ! আমরাও মুক্তিযোদ্ধা-জাতি তাদের যুদ্ধ মোকাবিলা করতে প্রস্তুত । তার আগে তেঁতুল হুজুরদের কানে কানে বলি, শেষমেশ তোমাদের পরাজিত হতে হবে, পালিয়ে যাবে কোথায় ? চারদিকে তো ভারত ! যাদের সৈন্যদেরও রক্তে রঞ্জিত বাংলাদেশের বিরুদ্ধে তোমরা যুদ্ধ করতে চাও ? সুতরাং এ দুঃসাহস পরিহার করো ! বাঙালিত্ব ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তথা ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি পছন্দ না হলে অবিলম্বে বাংলাদেশ ছাড়ো ! এটা বঙ্গবন্ধু রবীন্দ্রনাথ লালন নজরুল সুকান্ত জীবনানন্দের আদর্শিক দেশ । বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধের দেশ । মুক্তিযোদ্ধাদের দেশ । বাঙালির দেশ । ধর্মনিরপেক্ষতার দেশ-----বহু ধর্মের সমন্বিত দেশ । অতএব ত্রিশ লক্ষ বাঙালির পবিত্র রক্তাক্ত বাংলায় ধর্মোন্মাদনা চলবে না । চলতে দেয়া যায় না ।

লেখক :চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ।