অরিত্র কুণ্ডু, ঝিনাইদহ : সবাই আমাকে শুধু মারে। আমার মাকে আপনারা দেখেছেন। আমার মা নাকি পাগলি। মাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করে। কয়েকদিন আগে শিশু আব্দুল্লাহ গণমাধ্যমকর্মীদের মাকে দেখার এ ইচ্ছার কথাগুলো বলেন।

আব্দুল্লাহ, পাগলী মায়ের সন্তান। সে জানতো না কে তার বাবা। তবে মাকে দেখার শেষ ইচ্ছা ছিল তার। শেষ ইচ্ছাটাও হলো না পূরণ। অতৃপ্তির চিরন্তন বেদনা নিয়েই পরপারে পাড়ি জমালো আব্দুল্লাহ। মাকে আর দেখা হলো না আব্দুল্লাহ’র। তবে শেষ যাত্রায় সঙ্গী হয়েছেন পালিত মা জোশেদা বেগম। আর ফরিদপুর মেডিকেল হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন আব্দুল্লাহ’র পালিত বাবা আব্দুর রশিদ।

আব্দুল্লাহ জন্মের পর থেকে মহেশপুর উপজেলার ভারতীয় সীমান্তের ভৈরবা বাজারপাড়ার আব্দুর রশিদের স্ত্রী জোসেদার কাছে বড় হয়ে আসছিল।

ঘটনাটি ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার মাঝকান্দি এলাকায় মর্মান্তিক এক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন তারা। এ দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ১০ জন। যাদের সকলের বাড়ি ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলায়।

ছোট আব্দুল্লাহ সকলের কাছে টোকাই নামেই পরিচিত ছিলেন। ভদ্র সমাজের মানুষেরা যেন ঘৃণার চোখে দেখতো আব্দুল্লাহকে। তার পরেও আব্দুল্লাহ’র বিচরণ ছিল মহেশপুরের ভৈরবা বাজারের পাশে ঝুপড়ি একটি ঘরে।

আব্দুল্লাহ জন্মের পর থেকে মহেশপুর উপজেলার ভারতীয় সীমান্তের ভৈরবা বাজারপাড়ার আব্দুর রশিদের স্ত্রী জোসেদার কাছে বড় হয়ে আসছিল।

স্থানীয়রা জানান, পাঁচ ছয় বছর আগে ওই এলাকায় গর্ভবতী এক পাগলি আসেন। কিছুদিন পর পাগলির ঘরে ফুটফুটে এক পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। এর কিছুদিন পর ওই পাগলি এলাকা ছেড়ে চলে যান। এরপর থেকে জোসেদা বেগম শিশুটিকে লালন পালন করে আসছিলেন। জোসেদা বেগম তার নাম রাখেন আব্দুল্লাহ। ঠিকানাহীন পথশিশু আব্দুল্লাহ বেড়ে উঠছিল সেখানেই।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নিহত জোসেদা বেগমকেও এলাকার সবাই পাগলি বলেই জানে। ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার সীমান্তবর্তী ভৈরবা বাজারের পাশে একটি ঝুপড়ি ঘরে তাদের বসবাস। স্বামী আব্দুর রশিদ কখনো ভ্যান চালায়, কখনো কাঠখড়ি কুড়িয়ে বিক্রি করেন। স্বামীর সামান্য আয় আর অন্যের দেয়া সাহায্যে কোনরকমে চলে তাদের সংসার। আব্দুর রশিদ তার দ্বিতীয় স্বামী। জোসেদার প্রথম স্বামী মারা যাওয়ার পর বিয়ে হয় আব্দুর রশিদের সঙ্গে। তাদের সংসারে আরেক সদস্য আব্দুল্লাহ। যাকে বছর পাঁচ আগে কুড়িয়ে পেয়েছিলেন জোসেদা।

সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুত্বর আহত হওয়ার পর আব্দুল্লাহকে ভর্তি করা হয় ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পায় সে। এরপর আব্দুল্লাহকে ঢাকায় রেফার্ড করা হয়। এ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে যাওয়ার পথে ফেরীঘাটে আব্দুল্লাহ মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়ে। বিষয়টি জানায় আব্দুল্লাহ’র সাথে থাকা গণমাধ্যমকর্মী রিজভি ইয়ামিন।

মহেশপুর উপজেলার বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল মালেক মন্ডল জানান, সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত মিয়াজান বিবির ছেলে মোহর আলী ২০১৪ সালে স্ত্রী, ছেলে মেয়ে রেখে ঢাকার সাভারে বসবাস করতেন। সেখানে তিনি হিজড়াদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলে তাদের মতোই জীবন যাপন শুরু করেন। হিজড়াদের দলে থেকে বিপুল সম্পদের মালিক হন মোহর আলী। ব্যাংকে এই টাকা গচ্ছিত আছে। ২০২০ সালে মোহর আলী মারা যান। ছেলের এই টাকার মালিকানা দাবী করেন বৃদ্ধা মিয়াজান বিবি।

তিনি আরো জানান, আইনগত প্রক্রিয়া শেষ করে দুইজন আইনজীবী নিয়ে রোববার মিয়াজন বিবির পরিবার ঢাকার সাভারে যাচ্ছিলেন। সকাল ৭টার দিকে তাদের বহনকৃত মাইক্রোবাসটি মধুখালী উপজেলার মাঝকান্দি এলাকায় দুর্ঘটনায় পতিত হয়। একটি ট্রাকের সঙ্গে মাইক্রোবাসটির সংঘর্ষে দুমড়ে মুচড়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। এতে ঘটনাস্থলেই ৫ জন ও হাসপাতালে নেয়ার পর আরো ৫ জনের মৃত্যু হয়।

নিহতরা হলেন- মাইক্রোচালক বিল্লাল হোসেন (৩০), মরিয়ম (২৫), তার শিশু পুত্র ইয়াছিন (৮ মাস), মা চায়না খাতুন (৬০), দাদী জোশেদা বেগম (৬৫), ফুফু আমেনা খাতুন (৩৫) ও আমেনার শিশু সন্তান (৭), সামেদুলের ছেলে নজরুল (৫০) কেরামত আলীর ছেলে ঝিনাইদহ জজ কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আব্বাস আলী (৫৫), আব্দুল্লাহ (৫) নিহত হয়।

ভৈরবা বাজারের ব্যবসায়ী শহিদুল ইসলাম জানান, একসঙ্গে এত মানুষ মারা যেতে পারে প্রথমে আমরা বিশ্বাস করছিলাম না। পরে টেলিভিশনে সংবাদ দেখে বিশ্বাস হয়। তাদের মৃত্যুর সংবাদ পাওয়ার পর এলাকা যেন মৃত্যুপুরী মনে হচ্ছে। সবার মধ্যে শোক ছড়িয়ে পড়েছে।

(একে/এসপি/মার্চ ২২, ২০২১)