রহিম আব্দুর রহিম


অনিবার্য একটি গল্প দিয়েই লেখাটি শুরু করছি। “কোন এক রাতে এক গৃহস্তের বাড়িতে শিয়াল ঢুকেছে তার পোষা মুরগী ধরতে। গভীর রাতের শিকারী শিয়ালের মুখে থাকা মুরগীর কক্ কক্ শব্দে মালিকের ঘুম ভেঙ্গে যায়। বাড়ির মালিকের চিৎকার-চেচাঁমেচিতে আশে-পাশের লোকজন ওঠে আসে। বেগতিক বেচারা শেয়াল মুরগী ছেড়ে জান বাঁচাতে অস্থির। এবার মুরগীর মালিক শেয়ালের কাছ থেকে রক্ষা করা মুরগীটি বাসায় নিয়ে জবাই করছে। পাশে থাকা মালিকের অবুঝ শিশু তার বাবাকে বলছে, বাবা মুরগী জবাই করছো কেনো? বাবা বললো, কেন? রান্না করে মাংস খাবো। এবার সন্তান তার বাবাকে বললো, তাহলে শেয়ালের কাছ থেকে মুরগীটিকে কেনো রক্ষা করলে? বাবা বললো, কেনো? অবুঝ ছেলে উত্তর দিলো, শেয়ালের কাছ থেকে মুরগীটি উদ্ধার করে তুমি নিজে জবাই করলা, এতে মুরগীর কি উপকার হলো?” উপস্থাপিত গল্পের সাথে নিবন্ধের মিল-অমিল খুঁজে বের করার দায়িত্ব একান্তই পাঠক সমাজের। আর ধৈর্যচ্যুতি নয়; এবার মূল আলোচনায়।

১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে নিপীড়িত বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন এক মহানায়কের নেতুত্বে। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর জন্মশত বার্ষিকী গত বছর ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ২৬ মার্চ পর্যন্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে সরকার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন প্রগতিশীল সংগঠন পালন করেছে। যতটুকু জানি, সরকার ঘোষিত যার বর্ধিত সময় ১৬ ডিসেম্বর ২০২১ পর্যন্ত। এর মাঝেই স্বাধীনতার ৫০ বছর অর্থাৎ ‘স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী’ গত ১৭ মার্চ থেকে ২৬ মার্চ পর্যন্ত অত্যন্ত জাঁক-জমকপূর্ণভাবে পালন করা হয়েছে। এই উৎসবে প্রতিবেশী বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের নির্মিত ইতিহাসে বিনির্মান ঘটিয়েছেন।

কিন্তু এই মহান আয়োজনে প্রতিবেশি দেশ ভারতের প্রধানমন্ত্রী’র আগমন ঘিরে একটি উগ্রগোষ্ঠী যে তান্ডব চালিয়েছে, তা শুধু দুঃখজনকই নয়; ইসলাম ধর্ম এবং মুসলিম জাতির জন্য কলংকও বটে। কলংক এই জন্যই বলছি; শৈশব-কৈশোরে শ্রেণিকক্ষে ধর্মীয় শিক্ষাগুরুর কাছে শুনেছিলাম, “অতিথি এমন একজন ব্যক্তি, যাকে কদর, আদর, সম্মান করা নৈতিক দায়িত্ব। শুধু তাই নয়, অতিথি যদি পিতার হত্যাকারী হয়, তবু তাকে অতিথির মর্যাদা দেওয়া ইসলামের বিধান।” আমার ওই শিক্ষাগুরুর এই উক্তি যদি মনগড়া হয়ে থাকে, তবে ওই শিক্ষক আমাকে মিথ্যা বা ভুল শিখিয়েছেন। যে কারণে তাঁকে (শিক্ষক) একজন ধর্মান্ধ বলে ধিক্কার জানাচ্ছি। আর যদি তাঁর শিক্ষাটা ইসলাম বিধিসম্মত হয়ে থাকে, তবে মোদীর আগমন ঘিরে যারা জ্বালাও-পোড়াও বা ভাংচুর করেছে, তারা নির্দ্বিধায় উগ্র-সাম্প্রদায়িক এবং সত্যিকারের ইসলাম বিরোধী একটি দেশদ্রোহী গোষ্ঠী। ‘ইসলাম’ ধর্ম কখনও কোন ধর্মের সাথে অন্য ধর্মের তুলনা করে না। বরং সকল ধর্মের অনুসারীদের শান্তি কামনা করে।

আইয়ামে জাহেলিয়া যুগে মহানবী (সাঃ) বিপথগামী মক্কাবাসীদের সত্যগ্রহনের পরামর্শ দিলেন। মক্কাবাসী কোনভাবেই তা গ্রহণ করল না। পরে তিনি (সাঃ) তায়েফে পৌঁছালেন, তায়েফের নেতারা মহানবী (সাঃ) এর সঙ্গে দেখা করার জন্য আসতে লাগলো ঠিকই কিন্তু কেউ মহানবী (সাঃ) এর কথায় রাজী হল না। বরং উল্টো পথ অনুসরন করল। তায়েফের সব ভবঘুরেদের একত্রিত করল, যারা প্রত্যেকেই ঝোলা ভর্তি পাথরের টুকরো নিল এবং নির্মমভাবে মহানবী (সাঃ) এর ওপর অবিরাম পাথর ছুড়ে মারলো। অবিশ্রান্তভাবে পাথর মারতে মারতে মহানবী (সাঃ) কে শহর থেকে বাইরে নিয়ে গেল। এতেকরে রাসূলের দু’টি পা রক্তাক্ত হয়ে ওঠলো। মহানবী (সাঃ) আকাশের দিকে নজর দিলেন এবং কাতর হয়ে প্রার্থনা করলেন, “হে আল্লাহ তুমি এদেরকে ক্ষমা করে দাও! কেননা এরা জানে না এরা কি করছে।” রাসূলের এই মানবিক শিক্ষা কি কাওমী কারখানা থেকে আবিস্কৃত মামুনুল-রফিকুল রা কেনাদিনই জানেনি, শোনেনি? ধিক্, ধর্মের নামে এরা যে উগ্র সাম্প্রদায়িকতা উস্কে দিচ্ছে, তা নরেন্দ্র মোদী কিংবা তার ধর্মের ক্ষতি না হলেও, ইসলাম ধর্মের অপুরনীয় ক্ষতি হচ্ছে।

স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও দেশে এখনও স্বাধীনতা বিরোধীদের আস্ফালন সত্যি দুঃখজনক। সেই পাকিস্তান জমিনের ‘জামায়াতে ইসলাম’ বর্তমানের ‘হেফাজতে ইসলাম’; কি অপূর্ব মিল! একটি শিরোনামে ‘ইসলাম’ ঢুকেছে একটি জামায়াতের মধ্যে, অন্য শিরোনোমটি ‘ইসলাম’ হেফাজত করছে একটি গ্রুপ। অর্থাৎ ‘ইসলাম’ ধর্মটা একটি গোষ্ঠী কেন্দ্রীয় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ‘জামায়াতে ইসলাম’ ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতার বিরোধীতা করেছে। মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী’র বিরোধীতা করার বিষয়টি ‘হেফাজতে ইসলাম’ নামের সংগঠনটির নেতাকর্মীরা ফরজে আইন হিসেবে ধরে নিয়েছে।ভারতের নরেন্দ্র মোদীর দল কিংবা গোষ্ঠী যে ভারতের মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর সাম্প্রদায়িক আক্রমন চালায়নি, তা আমি বলছি না; বলছি, ‘ইসলাম’ ধর্ম প্রতিশোধের নয়। ‘ইসলাম’ ধর্ম ধৈর্যের, ন্যায়ের এবং শান্তির।

মোদীর আগমন ঘিরে যারা শহিদি উস্কানী দিয়েছে তারা কারা? এই সুযোগ এরা কোথা থেকে পেলো? মোদীর আগমন ঘিরে বিক্ষোভ, হরতাল, সংঘর্ষে যারা আহত হয়েছে তারা সবাই মাদ্রাসার শিক্ষার সাথে জড়িত। অথচ সরকারের দায়িত্বশীল একজন মন্ত্রী বলেছেন, “সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর তান্ডবে পৃষ্ঠপোষক বিএনপি।” (তথ্যসূত্র : সমকাল, ২৮ মার্চ ২০২১।) অথচ সাইনবোর্ড সর্বস্ব কয়েকটি সংগঠন হেফাজতে ইসলামের ছাতার নিচে ডুগডুগি বাজাচ্ছে। হরতাল, বিক্ষোভ, ভাংচুরের ঘটনা যেমন ন্যাক্কারজনক, তার চেয়েও ন্যাক্কারজনক রক্তপাত ও হত্যাকান্ড। প্রশ্ন, যে আলেম সমাজ আজ পথে নেমেছে মুসলিম রক্ষায়, তারা এর আগে কখনও যুদ্ধদেহীং ভাবে মাঠে নামে নি। যখন ‘কাওমী’ শিক্ষার মর্যাদা বর্তমান সরকার এমএ পাশের মর্যাদা দিয়েছে, শুধু তাই নয় আশ্চার্যজনক বিষয় করোনাকালে যখন দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ, তখনও ‘কাওমী মাদ্রাসা’ চালু রাখা হয়েছে। এতে করে কাওমী ধর্মান্ধরা সরকারের দুর্বলতা খুঁজে পেয়েছে। ফলে ‘মামুনুল’ কিংবা তথা কথিত শিশু বক্তা রফিকুল ইসলাম মাদানী’রা ধর্মের নামে মনগড়া বক্তব্য দিয়ে দেশে অস্থিরতা ছড়িয়ে দিচ্ছে।

একদিকে হেফাজতে ইসলামের জ¦ালাও-পোড়াও, অন্যদিকে ২০১৯ সালের চীনের উহানে আবিস্কৃত ‘করোনা’ নামক মহামারী’টি পৃথিবীর এক ভয়ংকর আতংক হিসেবে বিরাজ করছে। গতবছর ২০২০ এর ১৭ মার্চ থেকে বাংলাদেশের স্কুল-কলেজ মাদ্রাসাসহ সকল প্রকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে। কারণ, দেশের সরকার সংশ্লিষ্টরা চান না শিক্ষার্থীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসা-যাওয়া করুক। সরকার এ বিষয়ে একটি পরামর্শক কমিটি গঠন করেছেন। যে কমিটির আলোচনা-পর্যালোচনা করে যখন গ্রীণ সিগনাল দেবে তখন দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু করবে। এটাই হওয়া উচিত। দুঃখজনক হলেও সত্য গঠিত পরামর্শ কমিটি এমন কোন উপায় বের করতে পারে নি, যে স্কুল-কলেজ চালু রেখে মহামারী থেকে বাঁচা যায়। এই পরামর্শক কমিটি যদি ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের মত পরিস্থিতির মধ্যে কখনও পড়ে, তখন কি হবে? যে জাতি ঘুর্নিঝড়, জলোচ্ছাস, খরা, বন্যা, কলেরা, ডায়ারিয়া, বসন্তসহ মহামারী দুর্যোগ মোকাবেলা করে দেশটাকে উন্নয়নের স্বর্ণ শেখরে পৌঁছে দিচ্ছে, সেই দেশের শিক্ষার মত একটি মৌলিক অধিকার খাঁচায় বন্দি করে মহামারী সামাল দেওয়ার মন্ত্রের ফানুশ উড়ানো কতটা যুক্তিযুক্ত?

সরকার চাচ্ছে যাতে শিক্ষার্থীরা রিক্স নিয়ে বাইরে না যায়; তা কি আদৌ হচ্ছে? জরিপ করে দেখুন, দেশের কত শতাংশ শিক্ষার্থীরা অনলাইন ক্লাস করার সুযোগ পাচ্ছে? কত শতাংশ শিক্ষার্থীরা শিক্ষা থেকে ঝড়ে পড়ছে? দীর্ঘ সময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের নৈতিক, সামাজিক এবং স্বাস্থ্যগত নানাবিধ সমস্যার পাশাপাশি সমাজের ভাবি প্রজন্মের একটি বড় অংশ অপরাধজগতে যে প্রবেশ করছে না, তা কিন্তু হলফ করে বলা যাচ্ছে না।যে ছাত্রসমাজ সকল মহামারী, দুর্যোগে সৈনিকের ভূমিকা রেখেছে, আজ তাদের খাঁচায় রেখে মহামারীর দোহাই দিয়ে জাতির যে অপূরনীয় ক্ষতি করা হচ্ছে এর খেসারতও যুগ যুগ ধরে জাতিকেই দিয়ে যেতে হবে। রাষ্ট্রের দায়িত্বশীলরা না হয় ‘অন্ধকারে সাপ, ঘর শুদ্ধ সাপ’-এর আতংকে রয়েছে; কিন্তু বৃটিশের শাসন, পাকিস্তানের শোষণের বিরুদ্ধে যে ছাত্র সমাজ বুকের তাজা রক্ত দিয়ে সত্য প্রতিষ্ঠা করেছে, সেই ছাত্রসমাজ কেনো হুঙ্কার দিচ্ছে না! “দ্বার বন্ধ করে ভ্রমটারে রুখি, সত্য বলে আমি তবে কোথা দিয়ে ঢুকি।” অথচ ধর্মান্ধরা ধর্মের দোহাইয়ে শহিদি যুদ্ধ অব্যাহত রেখেছে। অদৃশ্য এক রোগের ভয়ে গোটা জাতির মেরুদন্ড নড়ে বড়ে করা, কিংবা লেখাটির প্রারম্ভিক গল্পের মিল-অমিল খুঁজবে কে?

লেখক : শিক্ষক, কলামিস্ট, নাট্যকার ও শিশু সংগঠক।