রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : বাজার বণিক সমিতির নোটিশ প্রাপ্তির ৫ ঘণ্টার মধ্যে মালামাল বের করে না নেওয়ায় ৩৭ বছরের পুরাতন জুয়েলারী প্রতিষ্ঠানের তালা ও আসবাবপত্র ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়েছে।  

শনিবার সকাল ১০টার দিকে সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার বুধহাটা বাজারের চাউল পট্টীর পিয়া জুয়েলার্সে বুধহাটা বাজার বণিক সমিতি ও বুধহাটা ইউপি চেয়ারম্যানের সহায়তায় নতুন তালা মেরে প্রবানন্দ দে নতুন তালা মেরে ওই দোকান দখলে নেন বলে অভিযোগ।

বুধহাটা বাজারের পিয়া জুয়েলার্সের মালিক নিত্যানন্দ দে এর ছেলে উৎপল দে জানান, বুধহাটা মৌজার বর্তমানে ১নং খতিয়ানের ১৪৩৫ /১০ দাগে সাড়ে পাঁচ ফুট চওড়া ও ২৭ ফুট লম্বা জমিতে তার বাবা নিত্যানন্দ দে দোকান ঘর নির্মাণ করে বৈধ লাইসেন্সের মাধ্যমে সেখানে পিয়া জুয়েলার্স নামের একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে আসছিলেন। ওই জমি এক সময় তার ঠাকুর দাদা রমা পদ দে এর নামে ছিল। পার্শ্ববর্তী ১৪৩৫/৯ দাগ থেকে সামান্য জমি কাকা প্রবানন্দ কিনলেও বর্তমানে ওই দাগও ২০০৯ সালের ২৮ অক্টোবর ১নং খতিয়ানে পেরিফেরিভুক্ত হয়।

প্রবানন্দ নিজের ও তার স্ত্রী কামনা রানী দে এর নামে দু’টি দাগে ৩০ দশমিক ৮০ বর্গমিটার জমি বন্দোবস্ত নেওয়ার জন্য ওই জমি নিজেদের দখলে দেখাতে গত বছরের ৩১ আগষ্ট সাতক্ষীরার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট এর আদালতে পিটিশন ৪৩১/২০ নং মামলা করেন। আদালতের নির্দেশে আশাশুনি সহকারি কমিশনার (ভূমি) শাহীন সুলতানা ওই অফিসের জরিপকারক অমল কান্তি ঘোষের মাধ্যমে তদন্ত করে আদালতে গত বছরের ১০ নভেম্বর একটি প্রতিবেদন দাখিল করেন। মামলায় বর্ণিত প্রবানন্দের জমির আংশিক নিত্যানন্দ জবরদখল করে দোকান ঘর নির্মাণ করে দীর্ঘদিন ব্যবসা করে আসছেন বলে একটি অসত্য প্রতিবেদন দাখিল করা হয়।

সেই প্রতিবেদনকে কাজে লাগিয়ে প্রবানন্দ চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি ১৮ বর্গমিটার নিজের ও ১২দশমিক ৮০ বর্গমিটার জমি তার স্ত্রী কামনা রানী দে এর নামে বন্দোবস্ত নেন। সংশ্লিষ্ট জমিতে থাকা দোকান ঘর সংস্কারের আবেদন করলে ২১ ফেব্র“য়ারি অনুমোদন দেন আরডিসি লিখন বণিক। যাহা ২৪ ফেব্র“য়ারি কার্যকর করার পক্ষে অনুমতি দেন আশাশুনি সহকারি কমিশনার (ভূমি) শাহীন সুলতানা। যদিও ওই জমির মধ্যে ৩৭ বছর দখলে থাকা সাড়ে ৫ ফুট চওড়া ও ২৭ ফুট লম্বা জমি নিজ নামে বন্দোবস্ত নেওয়ার জন্য গত বছরের নভেম্বর মাসে একই অফিসে বাবা নিত্যানন্দ দে আবেদন করলেও তাকে দেওয়া হয়নি। তবে ভূমি অফিসের সঙ্গে যোগসাজসে ওই একই দাগে .০০৫০ একর জমি বন্দোবস্ত পান তার কাকা বিনানন্দ দে।

উৎপল দে অভিযোগ করে বলেন, এক বছরেরও বেশি সময় আগে বাবার দোকান ঘরে তালা মেরে কাকা প্রবানন্দ ও বিনানন্দ দখলে নেওয়ার চেষ্টা করলে করলে পুলিশের সহায়তায় স্থানীয় শালিসের মাধ্যমে তালা খুলে দেওয়া হয়। কিন্তু গত ২ এপ্রিল দুপুর একটার দিকে বুধহাটা বাজার বণিক সমিতির সভাপতি মঞ্জুরুল ইসলাম মহিদ ও সাধারণ সম্পাদক মোঃ ফারুক ঢালী সাক্ষরিত একটি নোটিশ তাদের বাসায় পৌঁছে দেওয়া হয়। তাতে বাজারের গলিপথে তার বাবার অবৈধভাবে দখলে থাকা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালামাল ওই দিন সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে সরিয়ে নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। এর ব্যত্তয় ঘটলে আইননানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়।

তারা দোকান থেকে মালামাল সরিয়ে না নেওয়ায় বাজার কমিটির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, ইউপি চেয়ারম্যান এর সহায়তায় বাবার দোকান পিয়া জুয়েলার্সের ১০টি তালা ভেঙে ফেলা হয়। পরে প্রবানন্দ ও বিনানন্দ লোকজন নিয়ে ভাঙচুর ও লুটপাট শেষে বাজার কমিটি ও জনপ্রতিনিধিদের সহায়তায় নতুন তালা লাগিয়ে বাবার দোকান ঘরে তালা লাগিয়ে জবরদখল করে নেন। পরে উপপরিদর্শক কাওছার আলীসহ কয়েকজন পুলিশ সদস্য ঘটনাস্থলে আসেন। বিষয়টি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে ভাঙচুর ও লুটপাট কারিরাই থানায় যেয়ে ওই জমি প্রবানন্দের কাছ থেকে নিত্যানন্দ তালা ভেঙে কয়েক বছর আগে দখলে রেখেছে মর্মে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন।

এ ব্যাপারে প্রবানন্দ দে বুধবার দুপুরে সাংবাদিকদের বলেন, দাদা নিত্যানন্দ দে ৩৭ বছর ওই স্থানে ব্যবসা করলেও ঘরটি তার। জোর করে দাদা তার কাছ থেকে ওই দোকানের তালা ভেঙে দখলে নিয়েছিল। এক সময় ওই জমি তাদের পৈত্রিক হলেও পরবর্তীতে পেরিফেরি হওয়ায় তিনি নিজের ও স্ত্রীর নামে বন্দোবস্ত নিয়ে সংস্কারের অনুমোদন নিয়েছেন। দাদা নিত্যানন্দ স্থানীয় ইউপি চেয়য়ারম্যানের শালিস ও বাজার কমিটির নোটিশ না মানায় সংশ্লিষ্টদের সহায়তায় তিনি শনিবার ওই ঘর দখলে নিয়েছেন। তবে ওই দিন সন্ধ্যায় থানায় যেয়ে বাজার কমিটির সুপারিশে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় তিন ভাই এক শতক করে বড় ভাই নিত্যানন্দকে দিতে রাজী হলেও মঙ্গলবার বড় ভাইয়ের ছেলে উৎপল দে দোকানের তালা ভেঙে মালামাল লুটপাটের অভিযোগ করায় তিনিসহ বাজার কমিটি ও চেয়ারম্যান ক্ষুব্ধ হয়েছেন।

সরেজমিনে বুধবার সকালে বুধহাটা বাজারে গেলে আহছান দর্জি, অভিজিৎ দেবনাথ , ভাড়ায় চালিত মোটর সাইকেল চালক শহীদুল ইসলাম, বাবুর আলীসহ কয়েকজন শনিবার পিয়া জুয়েলার্সের তালা ভাঙচুর ও জিনিসপত্র বের করে দেওয়ার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে ঘটনার বর্ণনা দেন।

সাতক্ষীরা জজ কোর্টের আইনজীবী অ্যাড. আবুল কালাম বলেন, ৩৭ বছরের দখলীয় ব্যবসা প্রতিষ্টান কারো ব্যক্তি মালিকানা বা বন্দোবস্ত পেলে তাকে আদালতে উচ্ছেদের মামলা করে আইন মোতাবেক ঢোল সহরত করে দখলে নিতে হবে। এর ব্যত্তয় হয়ে তিনি আইন আমলে আসবেন। তাছাড়া পেরিফেরি জমি যারা বন্দোবস্ত দেবেন দখল দেওয়ার দায়িত্ব তাদের। এখানে জনপ্রতিনিধি বা বাজার কমিটির কোন এক্তিয়ার নেই।

বুধহাটা বাজার কমিটির সাধারণ সম্পাদক মোঃ ফারুক হোসেন ২ এপ্রিল নিত্যানন্দ দে কে নোটিশ দিয়ে ওই দিন সন্ধ্যার মধ্যে মালামাল বের করে নেওয়ার নির্দেশ দেওয়ার কথা স্বীকার করেই বলেন, এ নিয়ে বুধহাটা ইউপি চেয়ারম্যান মোছাদ্দেক আলী শালিস করে মীমাংসা করে দিয়েছিলেন। সেটা নিত্যানন্দ মানেননি। তাই শনিবার সকাল ১০টার দিকে তিনিও বাজার কমিটির সভাপতিসহ ৫১ সদস্যের সকলে ও পুলিশের উপস্থিতিতে বুধহাটা ইউপি চেয়ারম্যান মোছাদ্দেক আলী পিয়া জুয়েলার্সের তালা ভেঙে নিত্যানন্দের মালামাল বাইরে বের করে দিয়ে প্রবানন্দের তালা লাগিয়ে দিয়েছেন।

বুধহাটা ইউপি চেয়ারম্যান মোছাদ্দেক আলী জানান, তিনি এক বছর আগে শালিস করে দিয়েছেন যাতে রমাকান্ত দে এর ছয় ছেলের সাক্ষর রয়েছে। দু’টি দাগের সীমান্তবর্তী গলির অংশে নিত্যানন্দ জোরপূর্বক দখল করে ছিল। শনিবার তিনি বাজার থেকে চলে আসার পর প্রশাসন পিয়া জুয়েলার্সের তালা ভেঙে ওই ঘর প্রবানন্দকে বুঝিয়ে দিয়েছেন।

আশাশুনি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা গোলাম কবীরের কাছে জানতেক চাইলে বুধবার দুপুর ১২টার দিকে তিনি আইন শৃঙ্খলার মিটিং এ আছেন বলে জানান।

তবে আশাশুনি থানার উপপরিদর্শক জুয়েল হোসেন জানান, গত ৫ এপ্রিল উৎপল দে এর অভিযোগের ভিত্তিতে তিনি মঙ্গলবার বুধহাটা বাজারে যান। কনোরা পরিস্থিতির কারণে সেখানে তেমন লোকজন না থাকায় বৃহষ্পতিবার সকাল ১০টায় বিবাদমান দু’পক্ষকে কাগজপত্র ও সাক্ষী সহকারে আসতে বলা হয়েছে।

আশাশুনি সহকারি কমিশনার (ভূমি) শাহীন সুলতানার সঙ্গে বুধবার দুপুর সাড়ে ১২টায় তার ০১৭৩৯-১৪৭১৭২ নং মুঠোফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।

(আরকে/এসপি/এপ্রিল ০৭, ২০২১)