আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ভ্যাকসিন নিয়ে ধনী এবং দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে বৈষম্য স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ধনী দেশগুলো যখন কোটি কোটি ডোজ ভ্যাকসিন সংগ্রহ করে রাখছে তখন দরিদ্র দেশগুলো আশঙ্কায় আছে তারা ভ্যাকসিন পাবে কীনা। তবে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব আর তা হচ্ছে চীন, রাশিয়া এবং ভারতের তৈরি করোনার ভ্যাকসিন। সম্প্রতি নিউ ইয়র্ক টাইমসের একটি মতামত কলামে এ বিষয়টি উঠে এসেছে।

পশ্চিমা এবং বিশ্বের অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রথম দিকে চীন ও রাশিয়ার তৈরি করোনা ভ্যাকসিনকে পাত্তা দেয়া হয়নি। সে সময় মনে করা হয়েছিল মডার্না, ফাইজার-বায়োএনটেক অথবা অ্যাস্ট্রাজেনেকার তৈরি ভ্যাকসিনের তুলনায় এগুলো হয়তো নিম্নমানের। চীন ও রাশিয়া স্বৈরাচারী রাষ্ট্র হওয়ার কারণেও হয়তো তাদের তৈরি ভ্যাকসিন নিয়ে এমন ধারণা তৈরি হয়ে থাকতে পারে।

তবে সম্প্রতি কিছু প্রমাণ পাওয়া গেছে যে, এই দুই দেশের তৈরি করোনা ভ্যাকসিনও বেশ কার্যকর। চলতি সপ্তাহে মানবদেহে রাশিয়ার স্পুতনিক-ভি ভ্যাকসিন পরীক্ষার অন্তর্বর্তী ফলাফল প্রকাশ করেছে শীর্ষস্থানীয় চিকিৎসা বিষয়ক সাময়িকী ল্যানসেট। সেখানে এই ভ্যাকসিন ৯১ দশমিক ৬ শতাংশ কার্যকর বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

গত ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে রাশিয়ার গামালেয়া রিসার্চ ইনস্টিটিউট এবং রাশিয়ান ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড তাদের ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা নিয়ে একই ধরনের দাবি করেছিল। তবে সে সময় তাদের এই দাবি খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য হয়নি। কিন্তু ল্যানসেটের প্রকাশিত তথ্য নিয়ে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না।

তবে চীনের তৈরি সিনোফার্ম ভ্যাকসিনের অনুমোদন দিয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, মিসর, জর্ডান, ইরাক, সার্বিয়া, মরক্কো, হাঙ্গেরি এবং পাকিস্তান। এছাড়া চলতি বছরের জানুয়ারির মাঝামাঝিতে আমিরাতে এই ভ্যাকসিন গ্রহণ করেছে ১৮ লাখ মানুষ।

অপরদিকে চীনেরই অন্য একটি প্রতিষ্ঠানের তৈরি সিনোভ্যাক ভ্যাকসিনের অনুমোদন দিয়েছে বলিভিয়া, ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক, ব্রাজিল এবং চিলি। শুধু অনুমোদনই নয় বরং এসব দেশে সিনোভ্যাকের ব্যবহারও শুরু হয়েছে। এছাড়া ইউরোপ মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার ডজনখানেক দেশে স্পুতনিক-ভি ভ্যাকসিনের প্রয়োগ শুরু হয়েছে।

চীন এবং রাশিয়ার কাছ থেকে ভ্যাকনির নেয়ার সময় এসব দেশ অবশ্যই তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নিরাপত্তা এবং কার্যকারিতা যাচাই না করেই নিশ্চয় তারা ভ্যাকসিন নেয়নি। এসব তথ্যের বেশির ভাগই ল্যানসেট ও দ্য জার্নাল অব দ্য আমেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (জেএএমএ) মতো বিজ্ঞানবিষয়ক সাময়িকীতে প্রকাশ হয়েছে অথবা স্বাধীনভাবে ট্রায়ালের পর ফলাফল জানানো হয়েছে।

বিশাল আকারে ভ্যাকসিনের স্বল্পতা এবং সরবরাহে বিলম্ব হওয়ার কারণে ফ্রান্স, স্পেন এবং জার্মানির মতো দেশগুলো এখন বিকল্প হিসেবে চীন এবং রাশিয়ার ভ্যাকসিন নেওয়ার বিষয়ে কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, ভ্যাকসিন নিয়ে যে সঙ্কট তৈরি হয়েছে তাতে আর কোনো উপায় না দেখে তারা পশ্চিমা দুনিয়ার প্রতি পক্ষপাতিত্ব থেকে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হচ্ছে।

তবে চীন এবং রাশিয়ার ভ্যাকসিন নিয়ে কিছু সংশয় কিন্তু রয়েই গেছে। ইরানে রাশিয়ার টিকা নিয়ে এবং পাকিস্তানে চীনের টিকা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এছাড়া কেনিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকাতে চীন এবং রাশিয়া উভয় দেশের টিকা নিয়েই প্রশ্ন রয়ে গেছে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক বাজার গবেষণা ও তথ্য বিশ্লেষণ প্রতিষ্ঠান ইউগভ সম্প্রতি ১৭টি দেশের ১৯ হাজার স্বেচ্ছাসেবীর ওপর একটি জরিপ চালিয়েছে। তাদের আস্থার তালিকায় রাশিয়া, চীন ও ভারতে উদ্ভাবিত করোনার টিকা তলানিতে রয়েছে।

বিভিন্ন দেশের তৈরি ভ্যাকসিনের বিষয়ে তারা ইতিবাচক নাকি নেতিবাচক সে বিষয়ে তাদের প্রশ্ন করা হয়। ওই জরিপে রাশিয়া, চীন এবং ভারতের ভ্যাকসিন একেবারে নিচের দিকে রয়েছে। রাশিয়া এবং এবং চীন তাদের নিজেদের তৈরি ভ্যাকসিন নিয়ে যেভাবে প্রচারণা চালিয়েছে সেটাও একটা কারণ হতে পারে। এসব কারণে বিভিন্ন দেশের মানুষ এই ভ্যাকসিনের বিষয়ে বেশ সতর্ক।

সাম্প্রতিক সময়ে চীন এবং রাশিয়ার তৈরি ভ্যাকসিনের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে উল্লেখযোগ্য তথ্য সামনে এসেছে। গত ডিসেম্বরের প্রথমদিকে এক ট্রায়ালের ফলাফলে দেখা গেছে, চীনের তৈরি সিনোফার্মের ভ্যাকসিন ৮৬ শতাংশ কার্যকর এবং অন্যগুলো ৭৯ শতাংশ কার্যকর।

তুরস্কে চীনের সিনোভ্যাকের কার্যকারিতা ৯১ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়া ও ব্রাজিলে যথাক্রমে ৬৫ শতাংশ ও ৫০ দশমিক ৪ শতাংশ বলে প্রমাণ হয়েছে। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, চীন এবং রাশিয়ার তৈরি ভ্যাকসিনের আরও তথ্য প্রকাশ করা উচিত। তবে
একই কথা পশ্চিমা দেশগুলোর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এক্ষেত্রে বলা যায়, ফাইজার-বায়োএনটেক এবং মডার্নার বিস্তারিত তথ্য এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। এমনকি এসব তথ্য গবেষকদেরও দেয়া হয়নি।

সম্প্রতি ধনী এবং দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে ভ্যাকসিন বিতরণে যে বিভাজন দেখা দিয়েছে সে বিষয়টি ‘বেদনাদায়ক’ বলে উল্লেখ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এক বিবৃতিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান তেদ্রোস আধানম ঘেব্রিয়েসুস জানিয়েছেন, তারা দীর্ঘদিন ধরেই কোভিড-১৯ ভাইরাসরোধী ভ্যাকসিন বিতরণে ভারসাম্যের ওপর জোর দিচ্ছেন।

এখন পর্যন্ত বিশ্বের ১শ দেশে প্রায় ৪ কোটি ভ্যাকসিনের ডোজ সরবরাহ করা হয়েছে। এক বছরের কম সময়ে ১৯০ দেশে দুই বিলিয়নের বেশি ভ্যাকসিনের ডোজ সরবরাহের আশা প্রকাশ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স গেভি পরিচালিত কোভ্যাক্স কর্মসূচি। বিশেষ করে তারা চায় ধনী দেশগুলোর পাশাপাশি ৯২টির বেশি দরিদ্র দেশেও ভ্যাকসিন নিশ্চিত করতে।

উচ্চ আয়ের দেশগুলোতে গড়ে প্রায় চারজনের মধ্যে একজন ভ্যাকসিন গ্রহণ পাচ্ছে। অপরদিকে, দরিদ্র দেশগুলোতে ৫শ জনের বেশি মানুষের মধ্যে একজন ভ্যাকসিন পাচ্ছে। এ থেকেই চরম বৈষম্য স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

কোভ্যাক্সের আওতায় মার্চের শেষ দিকে বিশ্বব্যাপী কমপক্ষে ১০ কোটি ভ্যাকসিনের ডোজ বিতরণ করা হবে বলে আশা প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত মাত্র প্রায় চার কোটি ডোজ বিতরণ করা সম্ভব হয়েছে।

চলতি বছর বিশ্বে ভ্যাকসিন বৈষম্যের ক্ষেত্রে ভয়াবহ নৈতিক ব্যর্থতার বিষয়ে সতর্ক করেন তেদ্রোস আধানম। তিনি বলেন, ‘মি ফার্স্ট’ বা আমিই প্রথম এই নীতিই এর জন্য দায়ী। পশ্চিমা দেশগুলোর তৈরি করোনার ভ্যাকসিনের বেশিরভাগ ডোজই কিনে নিয়েছে ধনী দেশগুলো। তাই পশ্চিমা দেশগুলোর বাইরেও যারা ভ্যাকসিন তৈরি করছে এবার তাদেরও গুরুত্ব দেয়া উচিত। এতে করে ভ্যাকসিন সরবরাহে ধনী এবং দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে ভারসাম্য আসবে বলে আশা করা যায়।

(ওএস/এসপি/এপ্রিল ১১, ২০২১)