সিনিয়র রিপোর্টার : প্রতীক্ষার তিন যুগে এই প্রথম অগ্নিপরীক্ষার মুখে বিএনপি। দেশের অন্যতম প্রধান দল বিএনপি আজ সোমবার ৩৭ বছরে পা রাখল। তিন যুগের এ দলটি আজ কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি। দীর্ঘ আট বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির সর্বস্তরের নেতা-কর্মীই হামলা-মামলায় জর্জরিত।

খোদ দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া, তারেক রহমানসহ দলের সিনিয়র ও তৃণমূলের নেতাদের সবাই বিচারের সম্মুখীন। এ অবস্থায় নিজেদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি, সন্দেহ-অবিশ্বাস, শত্রু শত্রু খেলায় সাংগঠনিকভাবে বিপর্যস্ত দলটি।

দেশজুড়ে বিস্তৃত সাংগঠনিক শক্তি আর জনসমর্থন থাকলেও একেবারে মুখ থুবড়ে পড়েছে বিএনপি। এরশাদ যুগে দলে বড় ধরনের ভাঙনের মুখে পড়লেও বিএনপি আজকের মতো এমন বৈরী পরিস্থিতির মুখে পড়েনি। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে নেতা-কর্মীদের আন্দোলন তাকে আপন নেত্রীর ইমেজ এনে দেয় আর ’৯১-এর নির্বাচনে বিএনপি আসে ক্ষমতায়। নেতা-কর্মীরা যদিও মনে করেন এবারও খালেদা জিয়াই আন্দোলনের পথে তাদের লক্ষ্য অর্জন করবেন- তবু সন্দেহ, অবিশ্বাস দলে। নির্বাসিত সন্তানদের থেকে দূরে থাকা ৭০ বছরের খালেদা জিয়ার ঘাম ঝরছে।

এদিকে দলের ৩৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে নেতা-কর্মী, সমর্থক ও শুভানুধ্যায়ীদের শুভেচ্ছা জানিয়ে পৃথক পৃথক বাণী দিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর সামরিক শাসনামলে ক্ষমতায় থেকে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠা করেন জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি। তার প্রতিষ্ঠিত এ দলটি নানা চড়াই-উৎরাই ও ভাঙাগড়ার মধ্য দিয়ে চার বার দেশ শাসন করেছে। অবশ্য এর মধ্যে বেশ কয়েকবার ভাঙনের কবলেও পড়ে দলটি।

প্রথমে হুদা-মতিন, দ্বিতীয়বার শাহ আজিজ, তৃতীয়বার কে এম ওবায়দুর রহমান, চতুর্থবার অধ্যাপক একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, পঞ্চমবার কর্নেল (অব.) অলি আহমদ এবং ষষ্ঠবার আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে ভাঙনের মুখে পড়ে দলটি।

২০০৭ সালের ওয়ান-ইলেভেনে চরম দুঃসময় নেমে আসে বিএনপিতে। এ সময় দলটি ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হলে খোদ বেগম খালেদা জিয়ার সুদৃঢ় নেতৃত্ব ও তৃণমূল নেতা-কর্মীদের সংগঠনের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় এ যাত্রায় তা সম্ভব হয়ে উঠেনি। এরপর বিপর্যস্ত দলটি ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিলে নতুনভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিলেও তা সম্ভব হয়নি।

বিগত ৫ বছরেও দলটি কেন্দ্রীয় কাউন্সিল করতে পারেনি। দলের নেই পূর্ণাঙ্গ মহাসচিব। অঙ্গ-সংগঠনসহ সাংগঠনিক জেলার অধিকাংশই মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি। অগোছালো দল নিয়ে কয়েকবার আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়েও হোঁচট খায় বিএনপি।

তবে তৃণমূল বিএনপির দাবি, ঢাকা মহানগরের ব্যর্থতার কারণেই সারা দেশের অপ্রতিরোধ্য আন্দোলনে তারা সফলতার মুখ দেখতে পারেননি। বিএনপির সিনিয়র নেতারা মনে করছেন, এত হামলা-মামলা, জুলুম-নির্যাতনের পরও বাংলাদেশে এখনো বিএনপি জনপ্রিয়তার শীর্ষে। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে বিএনপি আবারও ক্ষমতায় আসবে। তবে নেতা-কর্মী-সমর্থকদের সুসংগঠিত করে ঐক্যবদ্ধভাবে সরকারবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি আদায় করাই বিএনপির সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জ।

তবে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, বিএনপির সামনে এখন অগ্নিপরীক্ষা। একদিকে আন্দোলন, আরেকদিকে সংগঠন গোছানো। দল বা ২০-দলীয় জোটে ভাঙনের শঙ্কা তো রয়েছেই। আগামীতে ক্ষমতায় যেতে হলে বিএনপিকে যেমন দুর্বার আন্দোলন-সংগ্রাম করতে হবে ঠিক তেমনই শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে আস্থাহীনতা ও নিজেদের মধ্যে সন্দেহ অবিশ্বাস দূর করে তৃণমূল নেতা-কর্মীদের আস্থায় এনে দলকে শক্তিশালী করতে হবে। ক্ষমতাসীনদের নিরপেক্ষ নির্বাচনে বাধ্য করাতে হলে ঢাকা মহানগর বিএনপিকে শক্তিশালী আন্দোলন গড়তে হবে যা এক কঠিন বিষয়। জনগণকে সম্পৃক্ত করতে বিত্তদের আকার বাড়িয়ে সরকারের দমননীতি এড়িয়ে আন্দোলনের নতুন পথ ও কলাকৌশল বের করতে হবে।

মামলা জর্জড়িত জিয়া পরিবার : বর্তমানে জিয়া পরিবারের বিরুদ্ধে মোট ২৭টি মামলা দেশের বিভিন্ন আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া, তার দুই ছেলে তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকো এবং তারেক রহমানের স্ত্রী ডা. জোবায়দা রহমানের বিরুদ্ধে এসব মামলা করা হয়। জিয়া পরিবারের বিরুদ্ধে এসব মামলার মধ্যে সাতটি বর্তমান সরকার আমলে করা। বাকিগুলো গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে করা।

একইভাবে সারা দেশে হাজার হাজার বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে হামলা-মামলা, জেল-জুলুমের খড়গ বইছে। এ নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় বিএনপির সর্বস্তরের নেতা-কর্মীরা। আদালতের নথিপত্র পর্যালোচনায় করে দেখা গেছে, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মোট পাঁচটি, তার বড় ছেলে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মোট ১৭টি, ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর বিরুদ্ধে মোট সাতটি এবং তারেক রহমানের স্ত্রী জোবায়দা রহমানের বিরুদ্ধে একটি মামলা রয়েছে। এসব মামলার মধ্যে দুটিতে খালেদা জিয়ার সঙ্গে তার দুই ছেলেকে এবং একটিতে তারেক ও কোকোকে আসামি করা হয়েছে। এই হিসাবে জিয়া পরিবারের বিরুদ্ধে মোট মামলা রয়েছে ২৭টি। যদিও মামলাগুলোর মধ্যে বেশির ভাগের কার্যক্রমই উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত রয়েছে।

নিঃসঙ্গ খালেদা জিয়া : ওয়ান-ইলেভেনের খড়গ শেষ হতে না হতেই নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভরাডুবিতে ফের বিপর্যয়ে পড়ে বিএনপি। এর পরপরই ৪০ বছরের স্মৃতিবিজড়িত সেনানিবাসের বাড়িটিও হাতছাড়া হয়। দুই ছেলে তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকোর সপরিবারে দেশের বাইরে থাকায় মা হিসেবে বেগম খালেদা জিয়ার চিন্তা কম নয়। এ ছাড়া দলের সিনিয়র থেকে শুরু সব পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের জুলুম-নির্যাতনেও বেগম জিয়াকে দুশ্চিতা বাড়িয়ে দিয়েছে। এরপরও তিনি দলকে শক্তহাতে ধরে রেখেছেন। যদিও বিগত কয়েক বছরে আন্দোলন করতে গিয়ে হোঁচট খেয়েছে বিএনপি।

মির্জা ফখরুলের মূল্যায়ন : ৩৬ বছরে বিএনপি আজ কোথায় দাঁড়িয়ে- এমন প্রশ্নের মুখোমুখি দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তিনি এ প্রতিনিধিকে বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া, সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ সারা দেশের হাজার হাজার নেতা-কর্মী আজ সরকারের মিথ্যা মামলায় জর্জরিত। নেতা-কর্মীরা হামলা-মামলা, গুম, খুনের পরও বিএনপি সবচেয়ে জনপ্রিয় দল। বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা বিএনপি এখন গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলন করছে। বিজয় না হওয়া পর্যন্ত আমরা জনগণকে নিয়ে এ আন্দোলন চালিয়ে যাব।

বিএনপির মুখপাত্র বলেন, বিএনপি আজ বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে। প্রতিষ্ঠার ৩৬ বছরে জনগণের আশা-আকাক্ষা পূরণে দেশের জনগণের অপ্রতিদ্বন্দ্বী দলে পরিণত হয়েছে। এ মুহূর্তে দেশের মানুষের মৌলিক অধিকার, গণতন্ত্র ও আইনের শাসন জনগণকে ফিরিয়ে দেওয়ায় বিএনপির সামনে বড় চ্যালেঞ্জ।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি আজ যে অবস্থানের ওপর দাঁড়িয়ে তার সূচনা করে বিএনপি। ৩৬ বছরে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের সুযোগ্য নেতৃত্বে বিএনপি আজ সুদৃঢ় অবস্থানে। আজকে অবৈধ সরকার গণতন্ত্রের সব প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে দিয়ে সংবিধানের মৌলিক পরিবর্তন এনে ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার স্বপ্ন দেখছে। এ জন্য তারা বিএনপির ওপর চরম জুলুম নির্যাতন, গুম, খুনের মধ্য দিয়ে নির্মূল করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। মিথ্যা মামলা দিয়ে বেগম খালেদা জিয়া, তারেক রহমান এবং সিনিয়র নেতাদের নির্বাচন ও রাজনীতি থেকে দূরে সরানোর চক্রান্ত করছে সরকার। এত জুলুম নির্যাতনের পরও বিএনপি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে।

দলের সাংগঠনিক অবস্থা সম্পর্কে মির্জা ফখরুল বলেন, বড় বড় দলগুলোতে কিছু সাংগঠনিক সমস্যা থাকতেই পারে। আমরা সময়সূচি ঘোষণা করেও সরকারের কারণে কাউন্সিল করতে পারিনি। কাউন্সিলের আগমুহূর্তে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে হামলা-ভাঙচুর চালিয়ে ১৫৪ জন নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় কাউন্সিলের সব কাগজপত্র ও ডকুমেন্ট নিয়ে যায় পুলিশ। তবে শীঘ্রই আমরা কাউন্সিল করার চিন্তাভাবনা করছি। তা ছাড়া ছোটখাটো সাংগঠনিক সমস্যা আন্দোলনের কোনো অন্তরায় হয় না। এ অবৈধ ও অনৈতিক সরকারের বিরুদ্ধে বিএনপি জোট যে আন্দোলন করে আসছে তাতে আগামীতে আরও ঐক্যবদ্ধভাবে জোরালো করা হবে। দেশবাসীকে সঙ্গে নিয়ে এই আন্দোলনে আমরা বিজয়ী হবই ইনশাআল্লাহ।

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচি : দলের ৩৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে দুই দিনব্যাপী কর্মসূচি হাতে নিয়েছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি। আজ সোমবার ভোরে ঢাকায় নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে। সকাল ১০টায় শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মাজার জিয়ারত, দোয়া মাহফিল ও স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচি পালন করা হবে। এ সময় বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া উপস্থিত থাকবেন। এ ছাড়াও আজ বিকালে বিএনপির উদ্যোগে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। গতকাল সকাল ১০টা থেকে দিনব্যাপী জাতীয় প্রেসক্লাবের তৃতীয় তলায় প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এ পর্যন্ত নানাবিধ কর্মকাণ্ডের ওপর প্রামাণ্য আলোকচিত্র প্রদর্শন করে জাসাস। একইভাবে সারা দেশে বিএনপির সব সাংগঠনিক জেলা-উপজেলায় অনুরূপ কর্মসূচি পালিত হবে। দিবসটি উপলক্ষে সংবাদপত্রে ক্রোড়পত্র প্রকাশ এবং দেশব্যাপী পোস্টার ও লিফলেট বিতরণ করা হয়।

(ওএস/এটিআর/সেপ্টেম্বর ০১, ২০১৪)