শেরপুর প্রতিনিধি : ‘আউশ ফসলডাই আমাগরে অরিজনাল ফসল। এইডা চাষ কইরা কইরাই আমগরে কিছুডা আয় উন্নতি অয়। গরের খাবার যোগাড় অয়। অহন এইডাই পানিতে তলাই গেলোগা। আমরা অহন আতংক অইয়া গেছি।’ কথাগুলো বলছিলেন বন্যাকবলিত চরপক্ষীমারী ইউনিয়নের ডাকাতের গোপ এলাকার কৃষক সাহেব আলী (৫২)। তিনি সাড়ে তিন একর জমিতে আউশ আবাদ করেছিলেন।

ধানগুলো প্রায় পেকে ওঠেছিলো। কয়েকদিন পরেই এসব ধান কাটার কথা ছিলো। কিন্তু আকস্মিক বন্যায় তার সব ধানক্ষেত তলিয়ে গেছে। সেসব ধান ক্ষেতের ওপর দিয়ে এখন বন্যারপানির প্লাবন বইছে। তিনি বলেন, ‘অনেক ঋণ দফা কইরা ফসল নাগাইছিলাম। আল্লায় বন্যা দিয়া সব শেষ কইরা দিলো। অহন কিবায় চলমু চিন্তাভাবনা কইরা অকুল অইয়া গেছি।’

চরমোচারিয়া ইউনিয়নের টানকাছার গ্রামের কৃষক সুমন মিয়া (৩৮) জানালেন, র্বষার ভরা মৌসুমেও বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় তার ৪ একর জমি তিনি পানি সেচ দিয়ে আবাদ করেছিলেন। এতে তার অতিরিক্ত টাকা খরচ হয়। এত কষ্টের পরও অনেক আশা নিয়ে ধান কাটার অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু বন্যার পানিতে তার প্রায় পাকা আউশ ধানের ক্ষেত তলিয়ে যাওয়ায় তিনি এখন কোন কিছুই ভাবতে পারছেন না। তিনি বলেন, অহন কি করমু, কিবাই চলমু, একেবারে দিশাহারা অবস্থা। মাঝপাড়া গ্রামের কৃষক আনিসুর রহমান (৪২) বলেন, আমার চাইর একর জমির ধান ক্ষেত পুরাডাই পানির নীচে। প্রায় ৪০ হাজার টাকা খরচ কইরা রোপা আমুন নাগাইছিলাম। অহন কোন কিছুই ভাববার পাইতাছি না।

পুরাতন ব্রহ্মপত্র নদে পানি বৃদ্ধির ফলে আকস্মিক বন্যায় শেরপুরে চরাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকার রোপা আমন, সব্জী এবং পাকা আউশ আবাদ বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় সম্ভাব্য ক্ষতির আশংকায় এসব এলাকার কৃষকরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, শেরপুর সদর, নকলা ও শ্রীবরদী উপজেলার চরাঞ্চলের শত শত একর জমির পাকা আউশ ধানের ওপর দিয়ে বন্যার পানির প্লাবন বইছে। একেবারে ধান কাটার মুহুর্তে বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় আউশ আবাদকারী কৃষকদের মাথায় হাত পড়েছে। ইতোমধ্যে কামারের চর এলাকায় বন্যার পানিতে নিমজ্জিত আউশ ধান কেটে আনার সময় এক কৃষক বন্যার পানিতে ডুবে মারা গেছে।

চরাঞ্চলের কৃষকরা জানান, আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময় পর্যন্তও বৃষ্টিপাতের অভাবে তারা স্যালোমেশিনে পানি সেচ দিয়ে রোপা আমন আবাদ করেছেন। কিন্তু এখন বন্যায় সদ্য রোপন করা আমন আবাদ তলিয়ে গেছে। এখন কবে পানি নামবে, কোথায় বীজতলা পাবেন, কিভাবে ক্ষতি কাটিয়ে ওঠবেন এই চিন্তায় তারা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। অনেক কৃষকের সব্জীর আবাদও তলিয়ে গেছে। এসব সব্জী আর হবেনা। কৃষকরা বলেন, ধার-কর্জ করে তারা অনেক আশা নিয়ে ফসল আবাদ করেছিলেন। কিন্তু আকস্মিক বন্যা একেবারে তাদের মাজা ভেঙ্গে দিয়েছে। এখন তারা সরকারের নিকট সহায়তার দাবী জানিয়েছেন। চরমোচারিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম শিপন জানান, আমার এলাকার ১৪/১৫ টি গ্রামে বন্যার পানিতে ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তিনি কৃষকদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বন্যার পানি নামার সাথে সাথে দ্রুত কৃষি পূণর্বাসন কার্যক্রম শুরুর তাগিদ দিয়েছেন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাব মতে, ১ সেপ্টেম্বর সোমবার পর্যন্ত শেরপুর জেলার সদর, শ্রীবরদী ও নকলা উপজেলায় ৬৫ হাজার ৮০০ হেক্টর রোপা আমন আবাদের মধ্যে চলমান বন্যায় ৮ হাজার ৩৭৭ হেক্টর জমির রোপা আমন বন্যার পনিতে নিমজ্জিত রয়েছে। একই সাথে ৩৫৫ হেক্টর জমির আউশ আবাদের মধ্যে ১১০ হেক্টর এবং ১ হাজার ৩১০ হেক্টর সব্জী আবাদের মধ্যে ৭৭ হেক্টর জমির সবজি ফসল বন্যার পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে। পানি নেমে গেলে ক্ষয়ক্ষতির পূর্নাঙ্গ হিসাব পাওয়া যাবে।

শেরপুর খামার বাড়ির উপ-পরিচালক কৃষিবিদ সুভাষ চন্দ্র দেবনাথ বলেন, বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সাথে আমন আবাদে নাবি জাতের অঙ্কুরিত ধান বীজ ছিটিয়ে বুনার জন্য জন্য ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। তাছাড়া যেসব এলাকায় বীজতলা পাওয়া যাচ্ছে সেসব এলাকা থেকে তা সংগ্রহ করার জন্য চেষ্টা চলছে। বিএডিসির পক্ষ থেকেও জরুরী ভিত্তিতে আপদকালীন ধানবীজ সংগ্রহ করা হচ্ছে।

(এইচবি/এএস/সেপ্টেম্বর ০১, ২০১৪)