সাইফুদ্দিন আহমেদ নান্নু, মানিকগঞ্জ : তাঁকে যতই পাঠ করা যায়, বিস্ময় ততই বাড়ে  ! চিন্তা চেতনা, দর্শনে, কর্মে হিমালয়ের মত মানুষ অথচ কত শুভ্র, সরল,সোঁদামাটির গন্ধমাখা প্রাণবনন্ত পুরুষ, হাজারও তরুণের বাতিঘর। পদ্মাপাড়ের এই মানুষটি ৮০ বছর বয়সেও ভীষণ তরুণ, তরুণরাই তাঁর বন্ধু, স্বজন। জ্ঞান প্রজ্ঞা, প্রগতি চিন্তায়, শত শত তরুণের হৃদয়ে নিয়ত প্রজ্জ্বলিত দ্বীপশিখা, ছায়াময় বটবৃক্ষ। নাম তাঁর হরিপদ সূত্রধর। 

জীবনটা কেটেছে শিক্ষকতায়, প্রগতিপন্থী রাজনীতির সুশীতল ধারায়। পাটগ্রাম সরকারি অনাথবন্ধু উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। পদ্মার সর্বগ্রাসী ভাঙনের দুঃসহ অভিজ্ঞতাকে সাথে নিয়ে বড় হয়েছেন। পৈত্রিক নিবাস ছিল হরিরামপুরের হরিণায়। পদ্মার ছোবলে হরিণার ঠিকানা হারিয়ে ঠাঁই নিয়েছিলেন চকিঘাটায়, সেখানেও পদ্মার ছোবল । অবশেষে থিতু হয়েছেন হরিরামপুরেরর বয়রায়।

কত উত্থান,কত পতন,কত সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প,হিংসার হলিখেলা। তবুও হরিরামপুরের মাটিকে ফেলে কোথাও যাননি। পদ্মাপারের মাটি তাঁর "মায়ের মত"। বাম রাজনীতি করেছেন,অভিনয় করেছেন,নাটক লিখেছেন ৩০টি। তাঁর লেখা নাটক ৫ বার জাতীয় শিশু-কিশোর নাট্যোৎসবে জাতীয় শিল্পকলা একাডেমিতে মঞ্চায়িত ও প্রশংসিত হয়েছে । নাটকের নির্দেশনাও দিয়েছেন অনেক।

পদ্মা ও তার ভাঙনের বিভীষিকা নিয়ে লিখেছেন, "বহে পদ্মা নীল রঙ" নাটকটি। তিনি বয়ষ্ক ভাতা সংক্রান্ত একটি বিজ্ঞাপন চিত্রে অসাধারণ অভিনয় করেছেন তাঁরই ছাত্র শুভ ঘোষের অনুরোধে। তবে অভিনয়ে রাজি হবার সময় শর্ত দিয়েছিলেন,অভিনয়ের জন্য কোন পারিশ্রমিক নেবেন না। নেনও নি।

জানা মতে সম্ভবত তিনিই বাংলাদেশের একমাত্র জীবিত ব্যক্তি, যাঁর জীবদ্দশায় তাঁর স্মারকগ্রন্থ " হরিপদ সূত্রধর স্মারকগ্রন্থ" প্রকাশিত হয়েছে। আর এই স্মারকগ্রন্থ সম্পাদনা করেছেন তাঁরই ছাত্র আইন মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা তৈয়েবুল আজহার।

শিক্ষকতায় অবসর তাঁর কাগজে কলমে। প্রতিটি সেকে-,প্রতিটি মিনিটে এখনও তিনি শিক্ষক। প্রতিক্ষণেই শেখান মানবতা, অসাম্প্রদায়িকতা, মাটি, মানুষ, প্রকৃতির পাঠ। তিনি যখন হাঁটেন, মাঠে বসেন, আড্ডা দেন, তখন হটাৎ, দূর থেকে দেখলে মনে হবে শিষ্যপরিবেস্টিত সক্রেটিস।

আসলেই তিনি পদ্মাপারের জনপদ হরিরামপুরের সক্রেটিস। এলাকার মানুষ, তরুণ, শিশু, কিশোর, সবার কি অসীম শ্রদ্ধা তাঁর প্রতি। ডাকসাইটে আমলা,বিচারক, প্রতাপশালী রাজনীতিক, অধ্যাপকসহ খেঁটে খাওয়া মানুষেরাও কি অবলীলায় তাঁর কাছে শ্রদ্ধায় নত হয়, কথা বলে, না দেখলে বোঝানো কঠিন।

হরিরামপুর পাবলিক লাইব্রেরির নবযাত্রার নেপথ্য পুরষ ছিলেন তিনি,হরিরামপুরের আলোচিত ক্রিকেট উৎসব, সবুজায়নে, সামাজিক মূল্যবোধরে জাগরণে হরিপদ সূত্রধর এক অনন্য পুরুষ। বয়স তাঁকে গৃহবন্দী রাখতে পারেনি ।

দুবছর অগের এক শুক্রবারে পদ্মায় অবৈধ ড্রেজিং যখন ভাঙনের আতঙ্ক ছড়িয়েছিল, যখন প্রতাপশালী বালু আর মাটি ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের হুমকির মুখ সবাই যখন সন্ত্রস্থ তখন এলাকার তরুণদের ভরসা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি।

"পদ্মার ভাঙন ঠেকাও হরিরামপুর বাঁচাও" ফেসবুক গ্রুপের ডাকে অনুষ্ঠিত সমাবেশে সবার আগে এসেছিলেন । কারণ যারা এই ডাক দিয়েছে তারা তার আত্মার আত্মীয়, ছাত্র, তিনিই তাদের প্রেরণার বাতিঘর। সেই সমাবেশে কত অনায়াসে বসে ছিলেন ঘাঁসের উপরে, মাটিতে। শত ডাকেও মাটি ছেড়ে চেয়ারে বসেন নি। বলেছেন, "দূর থেকে কষ্ট করে যারা এসেছেন, তাদের আগে বসতে দাও।"

(এস/এসপি/জুন ০৫, ২০২১)