প্রহলাদ মন্ডল সৈকত, রাজারহাট (কুড়িগ্রাম) : প্রসূতি মা ও শিশু মৃত্যুহার কমাতে সারাদেশে প্রসূতি মায়েদের সার্বিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে  নির্ভরযোগ্য সরকারি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র। দেশের প্রতিটি জেলা শহরের ন্যায় কুড়িগ্রামে মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে মায়েদের জরুরী সময়ে নরমাল ডেলিভারি কিংবা সিজারিয়ান সেকশনের মাধ্যমে সন্তান প্রসবের জন্য ২৪ ঘন্টা প্রস্তুতি রেখে প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ দিয়েছে সরকার। 

কিন্তু মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত এমও ডাঃ মারুফা বিধি বহির্ভূতভাবে প্রাইভেট প্রাকটিস, স্থায়ীভাবে এনেস্থিসিয়া চিকিৎসক না থাকা, স্টাফদের বাণিজ্যিক মনোভাব এবং চিহ্নিত দালালদের অপতৎপরতার কারণে সরকারের গৃহীত এই মহতী পদক্ষেপের প্রকৃত সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে প্রসূতি মায়েরা। ভুক্তভোগীদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে দীর্ঘদিনের অনুসন্ধানে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল সহ বেসরকারি ক্লিনিকগুলিতে গত মার্চ মাসে নরমাল ও সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে সহস্রাধিক শিশুর জন্ম হলেও এদের সিংহভাগই সিজারিয়ান বেবি। অথচ মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে ওই একই মাসে সিজারিয়ান সেকশনের মাধ্যমে মাত্র ৪ জন শিশু, এপ্রিল মাসে ৮জন শিশু এবং মে মাসে ৭ জন শিশুর জন্ম হয়। তিন মাসে সিজারের সংখ্যা মাত্র ১৯ টি।

মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে চিকিৎসা সেবাগ্রহীতাদের কোনো অর্থ ব্যয় করতে না হলেও বেসরকারি ক্লিনিকে প্রতিটি সিজারিয়ান অপারেশনে রোগীর স্বজনদের ওষুধ সহ ব্যয় করতে হয় ১৮থেকে ২০হাজার টাকা। কিন্তু মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের মেডিকেল অফিসার ডাঃ মারুফার ব্যাক্তিস্বার্থ ও বাণিজ্যিক মনোভাব এবং কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় বিনে পয়সাতে ওই একই চিকিৎসা নেয়ার সুযোগ থাকার পরেও সরকারের যুগান্তকারী পদক্ষেপের সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে হাজারো প্রসুতি মা।

গর্ভবতী নারীরা মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে প্রতি সপ্তাহের রোববার ও বুধবার নিয়মিত চেকআপে আসেন। সে হিসেবে ১ মাসেই চেক-আপকৃত রোগীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৮ শতাধিক। সে হিসেবে মাসে নরমাল ডেলিভারী সহ সিজারের সংখ্যা কমপক্ষে ১৮০ থেকে ২০০ টি হওয়ার কথা অথচ প্রতি মাসে নরমাল ও সিজারিয়ান অপারেশনের সংখ্যা ৫০টি ও অতিক্রম করেনি । গত ৩ মাসের পরিসংখ্যানে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র ক্যাম্পাসে রয়েছে মেডিকেল অফিসার, নার্স/ ধাত্রীদের আবাসিক ভবন। সুসজ্জিত অপারেশন থিয়েটারসহ রোগীদের জন্য রয়েছে ৩০টি বেড। আরও রয়েছে বিনে পয়সায় ওষুধ সরবরাহের সুবিধা। এতকিছু সুযোগসুবিধা থাকার পরও বেসরকারি ক্লিনিকগুলোতে যেতে বাধ্য হচ্ছে রোগীরা। এতে অর্থনৈতিক ক্ষতির শিকার হচ্ছেন দরিদ্র ও অসহায় মানুষেরা।পাশাপাশি সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের সুফল থেকে সেবা প্রত্যাশীদের বঞ্চিত করে হাতিয়ে নিচ্ছেন বিপুল পরিমান অর্থ। সেইসাথে হীনস্বার্থ চরিতার্থ করছেন নিজেদের অর্থলিপ্সু মনোবাসনার শতভাগ।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের মেডিকেল অফিসার ডাঃ মারুফা শুক্রবার সারাদিন এবং সপ্তাহের অন্য দিনগুলোতে প্রতিদিন বিকেল ৩ টা থেকে রাত্রি ৮ টা পর্যন্ত আইডিয়াল ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়মিত চেম্বার প্রাকটিস্ করেন। নতুন রোগী বাবদ ৫শ, পুরাতন রোগীর ৪ শ টাকা ফি নেন। ওই সময়কালীন মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে জরুরী প্রসববেদনা জনিত কারণে আগত মুমূর্ষু রোগীদের ক্যাম্পাসে অবস্থানরত স্টাফরা রোগী ভর্তি না করে তার প্রাইভেট চেম্বারে পাঠিয়ে দেয়। সেখানে বিভিন্ন পরিক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে সময়ক্ষেপণ করে ওই ক্লিনিকেই সিজার করে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন। অফিস চলাকালীন সময়ে আগত রোগীর ক্ষেত্রেও একই পদ্ধতিতে সময়ক্ষেপণ করা হয়। পরে অফিস সময় শেষ হয়েছে অথবা অজ্ঞানের ডাক্তার না থাকার অজুহাতে রোগীকে বেসরকারি ক্লিনিকে নিয়ে যেতে বাধ্য করা হয় স্বজনদের। এছাড়াও গোপন সমঝোতার মাধ্যমে অফিসে বসেই ক্লিনিক ও দালালদের মাধ্যমে নিয়ে আসা রোগীদের দেখে ব্যবস্থাপত্র দেন তিনি।

জানা গেছে, চলতি বছরের মার্চ, এপ্রিল ও মে এই তিন মাসে মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে ডাঃ মারুফা সিজার করেছেন মাত্র ১৯ টি। অথচ চাকুরী বিধিমালাকে বৃদ্ধাঙ্গলি প্রদর্শন করে তিন মাসে বেসরকারি ক্লিনিকে ডিএন্ড সি সহ সিজার করেছেন ২২৩টি । এই অপারেশন গুলির মধ্যে বেশকিছু সিজার অফিস সময়ের মধ্যে করা হয়। এবং একই দিনে আইডিয়াল ক্লিনিকে ৫থেকে ৭টি সিজার করার রেকর্ড রয়েছে। গত মার্চ মাসে তিনি মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে ৪ টি সিজার করলেও বেসরকারি ক্লিনিকে করেছেন ৮০ টি অপারেশন । এপ্রিলে মাতৃসদনে ৮ টি সিজার করলেও প্রাইভেট ক্লিনিকে করেছেন ৭৮ টি এবং মে মাসে বেসরকারি ক্লিনিক এ সিজার, হিসট্রেকটমি ও ডিএন্ডসিসহ ৬৫ টি অপারেশন করলেও মাতৃসদনে সিজার করেছেন মাত্র ৭ টি। প্রতিটি সিজারের বিপরীতে বেসরকারী ক্লিনিক থেকে ২৫০০ থেকে ৩০০০ টাকা পেয়ে থাকেন।

খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে এ্যানেস্থেসিয়া চিকিৎসকের জন্য স্থায়ী কোন পদ নেই। তবে এ সমস্যা সমাধানের বিকল্প হিসেবে অনূকলে এ্যানেস্থিয়া দেয়ার দায়িত্ব পালন করার কথা ভুরুঙ্গামারী উপজেলায় কর্মরত এমওএমসিএইচএন্ডএফপি ডাঃ জি.এম আরিফের। তবে একই পদে তিনি নাগেশ্বরী উপজেলারও অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করে আসছেন। এ ব্যাপারে ডাঃ জি.এম আরিফ জানান, সিজারের জন্য কল না পেলেতো আমার করার কিছুই নেই।
অফিস সময়ের পর প্রাইভেট প্রাকটিস করার বৈধতা রয়েছে জানিয়ে মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের মেডিকেল অফিসার ডাঃ মারুফা আক্তার জাহান বলেন, এ্যানেস্থেসিয়া চিকিৎসকের সংকট নেই। তবে নরমাল ডেলিভারির দিকেই তারা বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।

রোববার (৬জুন) সদ্য যোগদান করার কথা জানিয়ে পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের উপ-পরিচালক মীর রফিকুল ইসলাম বলেন, মেডিকেল অফিসারের ক্যাম্পাসের বাহিরে প্রাইভেট প্রাকটিস করার নিয়ম নেই। বিষয়টি খতিয়ে দেখার কথা জানান তিনি।

(পিএস/এসপি/জুন ০৬, ২০২১)