প্রহলাদ মন্ডল সৈকত, রাজারহাট (কুড়িগ্রাম) : মহান মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দ তৎকালীন কুড়িগ্রাম মহকুমার লালমনিরহাট থানার ছিনাই ইউনিয়নের  ছত্রজিৎ মৌজায় বসবাসকারী ধানের ধনি রাজ চন্দ্র বর্মণ স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে (৫০বছর পূর্তি) তাঁর বয়স হয়েছে ১০৭ (এক শত সাত বছর)। এ বয়সে তিনি সুস্থ্য আছেন এবং স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে সক্ষম। স্বাধীনতার যুদ্ধে তিনি ভারতে শরনার্থী না হয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ছিনাই বৈদ্যের বাজার এলাকার গহীন জঙ্গলে বসবাস করেন। সেখানে হিন্দু-মুসলিম যে সব মানুষ ও তাঁদের পরিবার পরিজন নিয়ে সাময়িক আশ্রয় নিয়েছেন ও পাকিস্তানি হানাদারদের নৃশংস তান্ডবের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছেন তাদের খাবারের সংকটে তিনি তাঁর ধানের গোলা থেকে ধান চাল ও অন্যান্য খাবার দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। 

বীর মুক্তিযোদ্ধা এস.এম. হারুন অর রশিদ লাল এর সাথে তাঁর বিষয়ে কথা হলে তিনি বলেন, আমার বাবা, মা, ভাই ও বোন সে সময়ে তাঁর বাড়ির পাশে স্বরূপ চামারু মৌজায় পঞ্চানন রায়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাঁর সাথে সে সময়ে আমার বাবার সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। আজ তিনি আমার বাবা, মা, মানসিক প্রতিবন্ধী বড় বোন, অন্যান্য ভাই বোনদের কথা স্বরণ করে কুশলাদি জানতে চান। তাঁর স্মৃতিতে সে সব কথা এখনো সব মনে আছে দেখে আশ্চর্য হলাম। আমার বাবা মহিউদ্দিন আহমেদ মুক্তিযুদ্ধে কুড়িগ্রাম মহকুমা হাইকমান্ডের অন্যতম কমান্ডার ছিলেন। তিনি ৭ এপ্রিল, ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দ কুড়িগ্রামের প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধের রনাঙ্গন তিস্তাা ফ্রন্ট (তিস্তাা ব্রীজ যুদ্ধ -২৮.০৩.১৯৭১ থেকে ০৬.০৪.১৯৭১ খ্রিস্টাব্দ) থেকে সাময়িক ভাবে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়ে কুড়িগ্রাম নতুন শহর প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।

সেখানে জেলখানার কারারক্ষী শহীদ ৫টি পরিবারসহ নিজের পরিবারকে সরিয়ে নিয়ে বেলগাছা কালীরহাটে আশ্রয় নিয়েছেন।

কয়েকবার ধরে যুদ্ধে কুড়িগ্রাম শহর ও ধরলা নদীর প্রতিরোধ যুদ্ধ ভেঙে গেলে পাকিস্তাান হানাদার বাহিনী শান্তি কমিটি, দালাল, রাজাকারদের সহযোগিতায় ও গোপন খবরের ভিত্তিতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধা কোম্পানির হাই কমান্ডার মহিউদ্দিন আহমেদকে কালীরহাটে জীবন্ত অথবা মৃত অবস্থায় ধরতে যান, কুড়িগ্রাম ক্যাম্পের মিলিটারি মেজর জীপে করে সশস্ত্র খান সেনাদেরকে সাথে নিয়ে কালীর হাট পৌছান ও স্বয়ংক্রিয় মেশিন গানের হামলা চালিয়ে অপারেশন করেন কিন্তু মহির কমান্ডার রেলকুলির মারফত খবর পেয়ে গর্ব ড্রেন অতিক্রম করে বৈদ্যের বাজারে আশ্রয় গ্রহন করেন।

তিনি আরো বলেন, আজ (১১জুন) দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর পর আমার সাথে এ প্রবীণ রাজ চন্দ্রের সাথে দেখা হয়। অনুজ সহোদর অ্যাডভোকেট এস.এম.আব্রাহাম লিংকন যুদ্ধকালীন কিশোর বয়সী হলেও এসব স্মৃতিচারণ সে সহজেই করতে পারে। আজ ১১ জুন, ২০২১ খ্রিস্টাব্দ আব্রাহাম লিংকন এবং আমি হারু অর রশীদ লাল সেই প্রবীণ ধনবান ব্যাক্তি রাজ চন্দ্রকে তাঁর বৈদ্যের বাজারের বাড়িতে দেখতে গিয়েছিলাম। বর্তমানে তাঁর পরিবারের হাতে ১৮০ বিঘা জমি আছে। আমি দেশের অভ্যন্তরে হাই কমান্ডার মহিউদ্দিন আহমেদ এর নির্দেশে এবং অধিনে মার্চ থেকে এপ্রিল,১৯৭১ খ্রিস্টাব্দ যুদ্ধ করেছি। তিনি আমার সহ আরো অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে অস্ত্র দিয়ে কমান্ডার হিসাবে প্রতিরোধ যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন। কুড়িগ্রাম ট্রেজারীর টাকা ১ কোটি ৬৪ লক্ষ এবং সোনার গহনা ০৭.০৪.১৯৭১ থেকে ১৭.০৪.১৯৭১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধা আনসার নিয়োগ করে রক্ষা করেন এবং রংপুর সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ উদ্দিন এর নির্দ্দেশে অন্যতম হাই কমান্ডার অধ্যাপক হায়দার আলী মিয়া, সুবেদার বোরহান উদ্দিন এর নিকট ১৭.০৪.১৯৭১ দুপুরে ০২.৩০ মিনিট থেকে ০৫.৩০ মিনিট পর্যন্ত এ টাকা সোনা হস্তান্তর করেন।

পরে হাই কমান্ডার মহিউদ্দিন আহমেদ এর নির্দেশে আমি সুবেদার আরব আলীর কোম্পানিতে ফুলবাড়িতে মহির কমান্ডারের যুদ্ধকালীন বন্দুক ও মোটর সাইকেল নিয়ে যাই এবং ভারতের দিনহাটার ধাপরা হাটের ডাঃ কৃষ্ণ চন্দ্রের বাড়ীর ক্যাম্পে জমা দেই। পরে সাহেবগঞ্জ সাব সেক্টরের ভুরুঙ্গামারী, নাগেশ্বরী, কুড়িগ্রাম সদর, রাজারহাট, লালমনিরহাট, কাউনিয়া, মীরবাগ, সাতমাথা, মাহিগঞ্জ, তাজহাট ও রংপুর জেলা শহরে ১৮ ডিসেম্বর, ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সন্মূখ যুদ্ধ করি।

আমার বোনের খবর নেয়ায় আমি খুবই খুশী হই কারণ প্রতিবন্ধীদের খবর সাধারনত কেউ রাখে না। দেশের অভ্যন্তরের শরনার্থীদের সেই দূর্দিনের অকৃত্রিম বন্ধু হিসাবে স্বাধীনতার ৫০ বছর পর শত বর্ষের অধিক বয়োজেষ্ঠ্য এই ধানের ধনি রাজ চন্দ্রের স্মৃতি ও তাঁর অবদানের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।

(পিএস/এসপি/জুন ১২, ২০২১)