সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর জেলগেট থেকে গোয়েন্দা পুলিশ পরিচয়ে ধরে নিয়ে যাওয়া সাতক্ষীরা সদরের ছাতিয়ানতলার মহিতোষ হাজরাকে (৪৫) আটদিন পর মঙ্গলবার একটি নতুন মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে পাঠিয়েছে পুলিশ।

এদিকে জেলগেট থেকে ধরে নিয়ে গোয়েন্দা পুলিশ তাদের একটি গোপন আস্তানায় রেখে অমানুষিক নির্যাতন চালিয়েছে একথা কোথাও প্রকাশ করলে গ্রেফতারকৃত নতুন মামলায় রিমাণ্ডে নিয়ে হাত পা গুড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা গোলাম রহমান।

সাতক্ষীরা সদর থানার উপপরিদর্শক তানভির হোসেন জানান, সোমবার দিবাগত রাত পৌনে দু’টার দিকে সাতক্ষীরা- খুলনা সড়কের বিনেরপোতা ঋশিল্পী’র পাশে জাহাঙ্গীর হোসেনের চিংড়ি ঘেরের পাশে একদল ডাকাত ডাকাতির উদ্দেশ্যে জড়ো হলে তার নেতৃত্বে পুলিশ তাদেরকে ধাওয়া করে। এ সময় ঘটনাস্থল থেকে মহিতোষ হাজরা নামের একজনকে আটক করা হয়। ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা হয় দু’টি রামদা ও দু’টি ককটেল। এ ঘটনায় উপপরিদর্শক তানভির হোসেন বাদি হয়ে মঙ্গলবার থানায় একটি মামলা (১নং) দায়ের করেন। মামলায় মহিতোষসহ অজ্ঞাতনামা আটজনকে আসামী করা হয়। সাংবাদিক নির্যাতনকারি উপপরিদর্শক হেকমত আলীকে এ মামলার তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

মঙ্গলবার সকালে আদালতপাড়ায় মহিতোষ হাজরা জানান, গত ২৬ আগষ্ট বিকেল ৫টার দিকে আদালত থেকে জামিননামা পৌঁছানোর পর তাকে জেলখানার অফিস কক্ষে ডেকে পাঠান ডেপুটি জেলর মোঃ নাসিরউদ্দিন। এ সময় তিনি সাতক্ষীরা গোয়েন্দা পুলিশের উপপরিদর্শক মফিজুল ইসলামকে মোবাইল ফোনে ডাকিয়ে এনে তার(মহিতোষ) সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। গোয়েন্দা পুলিশের উপপরিদর্শক মফিজুল ইসলাম তার (মহিতোষ) কাছে। একপর্যায়ে সন্ধ্যা ৬টার দিকে প্রধান ফটক থেকে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গোয়েন্দা পুলিশের উপপরিদর্শক মফিজুল ইসলাম তাকে জোরপূর্বক একটি সাদা রঙের মাইক্রোবাসে তোলার চেষ্টা করনে। এ সময় মা ও বোনকে দেখতে পেয়ে বলে চিৎকার করলে মুখ চেপে ধরে তাকে গাড়ির ভিতরে তোলা হয়। গাড়ির মধ্যে তার দু’চোখ বেঁধে এনে সাতক্ষীরা গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে আনা হয়। এরপর থেকে তাকে গোয়েন্দা পুলিশের ব্যারাকের একটি অন্ধকার ভাঙা চোরা দরজা বিশিষ্ট গুদাম ঘরে দু’ হাত ও দু’ পা বেঁধে ফেলে রেখে অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। তিনি নিজে কোনদিন একটি বিড়ি না খেলেও তাকে প্রতিদিন আড়াই প্যাকেট সিগারেট খেতে বাধ্য করে পুলিশ। তাকে একটি পানির খালি প্লাসিক পাত্রে প্রসাব ও পলিথিনের বস্তায় পায়খানা করতে হতো। গত আট দিনের মধ্যে গত সোমবার দুপুরে মাত্র একবার ডাল ভাত দেওয়া হয়। এ ছাড়া বাকি দিনগুলো তাকে পাউরুটি ও কলা খেয়ে কাটাতে হয়েছে।

তিনি আরো জানান, রোববার সকালে গোয়েন্দা পুলিশের এক সদস্য তার মোবাইল (০১৯৩০-৫৮৪১৬৪) থেকে বোন ছন্দা ও মা স্বর্ণলতার সঙ্গে কথা বলিয়ে দেন। এজন্য তাকে ২০ হাজার টাকা ঘুষ হিসেবে পাঠানোর জন্য একটি ব্যক্তিগত বিকাশ নম্বর ম্যাসেজ করে দেওয়া হয়। ওই দিন বিকেলে ওই সিপাহী আবারো টাকা চায় বোনের মোবাইল ফোনে। রোববার সন্ধ্যার পর তার পাশে দু’টি রাম দা রেখে দিয়ে সোমবার দুপুর পর্যন্ত তার চোখ কালো কাপড় দিয়ে বেঁধে দেওয়া হয়। পরে খাওয়ার শেষ ইচ্ছা খাসির মাংস বা মুরগি তা জানতে চাওয়া হয়। বিকেলে তাকে গোয়েন্দা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার ব্যক্তিগত কক্ষের পিছনে একটি ছোট ঘরে নিয়ে পিঠ মোড়া দিয়ে বেঁধে রাখা হয়।

মহিতোষ হাজরা আরো জানান, সোমবার রাত ১০টার দিকে পুলিশ সুপার মহোদয় মোবাইলে গোয়েন্দা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা একেএম আজমল হোসেনকে ছেড়ে দিতে বলেন। এরপরও তিনি তা না করে সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা গোলাম রহমানের সঙ্গে পরামর্শ করে তাকে একটি নতুন মামলার প্রেক্ষাপট তৈরি করে চালান দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সে অনুযায়ি সোমবার দিবাগত রাত ১২টার দিকে পুলিশ সুপার ও গোয়েন্দা পুলিশের সকল ঘর ও বারান্দার আলো বন্ধ করে দিয়ে একটি লাল রঙের মাইক্রোবাসে করে সীটের নীচে বসিয়ে রেখে বিনেরপোতায় নিয়ে আসা হয়। সেখান থেকে সাতক্ষীরার দিকে নিয়ে আসার সময় ঋ’শিল্পীর সামনে থানা পুলিশের কয়েকজন সদস্যসহ একটি সাদা রঙ্গের প্রাইভেট কার দেখতে পান। সেখান থেকে পুলিশ তাকে সদর থানা লক আপে নিয়ে আসে। সকাল সাতটার দিকে সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা গোলাম রহমান তাকে একটি ডাকাতি প্রস্তুতির দুর্বল মামলায় চালান দেওয়ার কথা বলে জেল গেট থেকে ধরে নিয়ে গোয়েন্দা পুলিশের স্টাফ কক্ষের একটি অন্ধকার গুদাম ঘরে আটক রেখে নির্যাতন করার কথা কোথাও না বলার জন্য অনুরোধ করেন। পরে এ কথা ফাঁস হলে গ্রেফতার দেখানো নতুন মামলায় রিমা-ে নিয়ে হাত পা ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেন তিনি। আদালতে নিয়ে আসার পর এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলতে বলতে মহিতোষ ২৬ আগষ্ট জেল গেট থেকে মুক্তি পাওয়ার সময় সঙ্গে থাকা একটি কাপড়ের থলের মধ্যে নিয়ে আসা দু’ মেয়ে বল্লী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণীর ছাত্রী ইতি ও অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী তিথির জন্য তিনটি সানডালিনা সাবান দেখিয়ে বলেন, এগুলো মার কাছে দিয়ে দেবেন। এ ছাড়া ওই থলের মধ্যে একটি লাল মগ, ম্যালামাইনের থালা, দু’টি লুঙ্গিসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র ছিল। দূঃখের মধ্যে এক চিলকি হাসির মাঝে মহিতোষ বলেন, পুলিশ যাই করুক তার জেলখানা থেকে নিয়ে থলেটি সঙ্গে রাখতে দিয়ে আট দিন পর আবারো জেলখানায় পাঠাচ্ছে। পুলিশ জেলখানার আলামত তার (মহিতোষ) সঙ্গে রাখতে দিয়ে নিজেদের দোষ নিজেই প্রমান করেছে।

সাতক্ষীরা গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক একেএম আজমল হুদা জানান, গত ২৬ আগষ্ট জেলগেট থেকে মহিতোষকে আটক করেননি। সেক্ষেত্রে বদ্ধ ঘরে আটক রেখে নির্যাতনের অভিযোগ ঠিক নয়।

তবে সাতক্ষীরা জেলা কারাগার কর্তৃপক্ষ গত ২৬ আগষ্ট সন্ধ্যায় গোয়েন্দা পুলিশ মহিতোষকে ধরে নিয়ে যাওয়ার কথা নিশ্চিত করেছে।
এ ব্যাপারে সাতক্ষীরা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা গোলাম রহমান বলেন, মহিতোষকে রিমা-ে হুমকি ধামকি দেওয়ার অভিযোগ ঠিক নয়। যেভাবে আটক করা হয়েছে সে অনুযায়ি গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়েছে।

প্রসঙ্গত, মহিতোষকে জীবিত ও অক্ষত অবস্থায় ফিরে পাওয়ার জন্য তার মা স্বর্ণলতা হাজরা ও বোন ছন্দা জাতীয় মানবাধিকারকমিশনের চেয়ারম্যান, আইন ও শালিস কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালকের শরনাপন্ন হন। পাশাপাশি সোমবার দুপুরে সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রশাসেনর উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করেন।

(আরকে/এটিআর/সেপ্টেম্বর ০২, ২০১৪)