সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : সাতক্ষীরার তালা উপজেলার পারকুমিরা গ্রামের বৃদ্ধা মলিনা পাল। বয়স নব্বই ছুঁই ছুঁই। ১৯৭১ সালের আজকের দিনে তার গ্রামে পাকবাহিনীর গণহত্যা সম্পর্কে মন্তব্য করতেই দীপ্ত কণ্ঠে বলে ওঠেন, বাংলা সনের ৯ বৈশাখ শুক্রবার দুপুর সাড়ে ১২টা। সাতক্ষীরা থেকে পাকবাহিনীর চারটি সাজোয়া গাড়ি পাটকেলঘাটা বলফিল্ডে আসে। এরপর তারা মনোহর কসাই (বিহারী) ও ছদ্মবেশধারি এক রুটি বিক্রেতার ইশারায় গোষ্ট বিহারী কুণ্ডকে গুলি করে হত্যা করে। দুপুর একটার দিকে পাঁচ রাস্তার মোড়ে কয়েকজনকে গুলি করে হত্যার পর তারা পারকুমিরা গ্রামের ষষ্ঠী বিহারী কুণ্ডুর বাড়িতে যায়। সেখানে ভারতে যাওয়ার জন্য দূর থেকে আসা কয়েকজন হিন্দু শরনার্থী অবস্থান করছিল। সেখান থেকে তাদেরকে গরুর দড়ি দিয়ে হাত বেঁধে পারকুমিরা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের একটি কোয়ার্টারে আনা হয়। এরপর তারা পুটিখালি মসজিদে অবস্থান নেওয়া ১০জনকে গরুর দড়ি দিয়ে হাত বেধে সেখানে ধরে আনে। একে একে তারা সরুলিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের তৎকালিন সভাপতি পুটিয়াখালি গ্রামের শেখ আব্দুর রহমান, তার ছেলে শেখ জালালউদ্দিন একই গ্রামের শেখ সামছুর রহমান, শেখ বদরউদ্দিন, শেখ হায়দার আলী, শেখ ফজলুর রহমান, শেখ আজিজুর রহমান, সামছুর রহমান (২), বেলায়েত আলী, আব্দুল মজিদ, শেখ সাজ্জাদ আলী, সালামত আলী মল্লিক, হাজুপদ দাস, পারকুমিরার ষষ্ঠী বিহারী কুণ্ডু, বিজয় পাল, বাইগুনি গ্রামের দীনবন্ধু দাস, কলাগাছির পরিমল মণ্ডল, তৈলকুপির আব্দুর রউফ, পাগল সাধু, বালিয়াদহের সাজ্জাদ আলীসহ একে একে ৭৯জন লোককে দড়ি বেঁধে সারিতে দাঁড় করিয়ে শরীরে রাইফেলের বেয়নট দিয়ে খুচিয়ে খুচিয়ে নির্যাতনের পর গুলি করে হত্যা করে। এ সময় পাকবাহিনী গান পাউডার ছড়িয়ে পারকুমিরা ও পুটিয়াখালি গ্রামের শতাধিক ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়। ৭৯টি লাশের মধ্যে কয়েকটি লাশ স্থানীয়ভাবে কবর দেওয়া হয়। কয়েকটি লাশ পাকসেনারা পার্শ্ববর্তী কপোতাক্ষ নদের জলে ভাসিয়ে দেয়। পরদিন বাকি ৪৯টি লাশ পারকুমিরা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পার্শ্ববর্তী একটি তালগাছের নীচের ডোবায় গণকবর দেওয়া হয়। ওই গণকবরের পাশে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি কৃষ্ণচুড়া গাছ। এ ভয়ঙ্কর স্মৃতি নিয়ে আজো তিনি স্বপ্ন দেখে আতকে ওঠেন। যারা এলাকার এ ধরনের হত্যাযঞ্জে সহযোগিতা করেছিল তারা আজও ধরা ছোঁয়ার বাইরে। যুদ্ধাপরাধীদের তালিকায় তাদের নাম সম্পৃক্ত করে অবিলম্বে তাদের ফাঁসির দাবি জানান ওই বৃদ্ধা। স্বাধীনতা পরবর্তী  ৪২ বছরে আওয়ামী লীগ ১৩ বছর রাজত্ব করলেও এই বদ্ধভূমিতে স্মৃতিসৌধ গড়ে না তোলা বা কোন প্রকার রক্ষণাবেক্ষনের ব্যবস্থা না করায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন তিনি।

পারকুমিরা গ্রামের ফজিলা খাতুন জানান, সেদিন রাজাকাররা শুধু হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি। তারা নিরীহ নারী শরনার্থীদের ধরে নিয়ে ধর্ষণ করেছিল। তালতলা থেকে ধরে আনা হায়দার আলী দড়িবাঁধা অবস্থায় ষষ্ঠী কুণ্ডুর বাড়িতে আগুন দিতে রাজী না হওয়ায় পা ধরে ক্ষমা চাইলেও তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরে ষষ্ঠী কুণ্ডুর বাড়ির পাটের গুদামের আগুনে পুড়ে যায় হায়দার আলী। সেদিনের সেই হায়নারা আজো তাদের এলাকায় ঘুর বেড়াচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেই পাক হানাদারদের দোসর জামায়াত শিবির পরাজয়ের গ্লানি দূর করতে আবারো দেশে সহিংসতা সৃষ্টি করে চলেছে। যে সব রাজাকার জুম্মার নামাজের সময় পকিস্তানি হানাদারদের গ্রামে ঢুকিয়ে নারী ধর্ষণ করে, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট শেষে নিরীহমানুষকে হত্যা করে এদেশে তাদের রাজনীতি বন্ধ করে পাকিস্তানে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে।

একই ভাবে নিজের চোখে দেখা ১৯৭১ সালের ২৩ এপ্রিলের হত্যাযজ্ঞের নির্মম স্মৃতিচারণা করতে যেয়ে পারকুমিরা গ্রামের মনিলাল ঘোষ বলেন, সেদিন সূর্যাস্তের পরপরই হত্যাযজ্ঞের পর খানসেনাদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার বোন পুটিকে দূরের এক পুকুরে মাথায় কচুরি পানা দিয়ে ঢাকা অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। পারকুমিরার গাছে গাছে মানুষের মুণ্ডু ঝুলিয়ে বিভিষীকার চিত্র তুলে ধরে রাজাকাররা। এসব ঘটনার পূণঃরাবৃত্তি করতেই চাচাত ভাই সামছুরকে হত্যার করুন চিত্র তুলে ধরেন পারকুমিরা গ্রামের শেখ ইছহাক গাজী। পারকুমিরা গ্রামের মনিলাল ঘোষ ও পুটিখালির শেখ নেছার আলী ১৯৭১ সালের পারকুমিরার গণহত্যার সঙ্গে জড়িতদের বিশেষ ট্রাইবুনালে বিচার ও বধ্যভূমি সংরক্ষণের দাবি জানান।

তালা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নূরুল হক জানান, ১৯৭১ সালের ২২ এপ্রিল পাটকেলঘাটা বাজারে এক ব্যবসায়ির দোকানে বসে এলাকার মুক্তিকামী ও নিরীহ মানুষদের হত্যার পূর্ব পরিকল্পনা করা হয়। পরিকল্পনাকারি হিসেবে ছিলেন মনোহর কসাই, রাজাকার উপজেলার উথালি গ্রামের আনছার আলী, আশাশুনির সাবেক সাংসদ জামায়াত নেতা রিয়াছাত আলী বিশ্বাস ও মমতাজউদ্দিন। ২৩ এপ্রিল বাবা ও বড় ভাইয়ের সঙ্গে তাকেও আটক করা হয়। কৌশলে পালিয়ে যাওয়ায় খান সেনাদের হাত থেকে রক্ষা পান তিনি। গণহত্যার পরবর্তীতে তৎকালিন প্রাদেশিক পরিষদের সংসদ সদস্য সালাউদ্দিনকে সরিয়ে রাজাকার আনছার আলীকে (বর্তমানে হাইকোর্টের আইনজীবী) তার স্থলাভিষিক্ত করা হয়।

তিনি বলেন, ১৯৯২ সালের ২৪ মে তৎকালিন বিরোধী দলীয় নেতা শেখ হাসিনা পাটকেলঘাটায় এসেছিলেন। তিনি পারকুমিরা বদ্ধভূমি সরকারিভাবে রক্ষণাবেক্ষণ ও সেখানে স্মৃতি সৌধ নির্মানের জন্য প্রকল্প গ্রহণের আশ্বাস দিয়ে ছিলেন। ১৯৯৬ সালে তিনি ক্ষমতায় আসার পরও তা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। ২০০৯ সালে আবারো ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালে পারকুমিরাসহ দেশের কয়েকটি প্রকল্প হাতে নিয়েছেন। তার প্রথম দফার কাজ আগামি জুন মাসের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। চলতি বছরের জুলাই থেকে শুরু হওয়া দ্বিতীয় দফার ১৬তম বদ্ধভূমি সংস্কার ও স্মৃতিসৌধ নির্মাণের কাজ এ বছরের জুলাই থেকে শুরু হবে বলে তিনি আশাবাদি। একইসাথে যুদ্ধাপরাধের দায়ের তালিকাভুক্ত জামায়াতের সাবেক সাংসদ আনছার আলী ছাড়া যারা গণহত্যায় জড়িত তাদেরকে বিশেষ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে দ্রুত বিচারের দাবি জানান তিনি।

মুক্তিযোদ্ধা সরদার কাজেম আলী জানান, ২০১২ সালে পারকুমিরা বদ্ধভূমির মাটি ভরাটের জন্য তালা উপজেলার তৎকালিন নির্বাহী কর্মকর্তা খান মোহাম্মদ রেজাউন্নবী চার টন চাল বরাদ্দ করেন। দিবসটি উদযাপন উপলক্ষে পাটকেলঘাটা-পারকুমিরা ও পুটিয়াখালি গণহত্যা দিবস উদযাপন কমিটি আজ বুধবার বধ্যভূমিতে পুষ্পমাল্য অর্পণ ও আলোচনা সভা শেষে পাটকেলঘাটা পাঁচ রাস্তার মোড়ে এক স্মরণসভার আয়োজন করেছে।

(আরকে/এইচআর/এপ্রিল ২৩, ২০১৪)