আবীর আহাদ


উচ্চ আদালত ও সামরিক বাহিনীর সমন্বয়ে মুক্তিযোদ্ধা জাতীয় কমিশন গঠন করে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সঠিক তালিকা প্রণয়নের জন্যে আমরা সম্প্রতি একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছি। কোন প্রেক্ষাপটে এ দাবি পেশ করেছি, সে সম্পর্কে বলতে গিয়ে আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছি যে, জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল=জামুকা প্রণীত ভুয়াভরা মুক্তিযোদ্ধা তালিকা অনুমোদন না করে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে তিনি যেনো জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৭২ সালের মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞার ভিত্তিতে, উচ্চ আদালত ও সামরিক বাহিনীর সমন্বয়ে একটি 'জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কমিশন' গঠন করে যথাযথ যাচাই বাছাইয়ের মাধ্যমে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। জাতীয় ইতিহাসের স্বার্থে মুক্তিযোদ্ধাদের নির্ভুল তালিকা প্রণয়নের প্রয়োজনে যদি আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হয় তা নিশ্চয়ই মুক্তিযোদ্ধারা করবেন। তবে কোনো অবস্থাতেই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাসহ সচেতন দেশবাসী কোনো গোঁজামিলের সংজ্ঞা ও প্রতারণামূলক নির্দেশিকার কারসাজিতে হাজার হাজার অমুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকারমিশ্রিত মুক্তিযোদ্ধা তালিকা মেনে নেবেন না। প্রসঙ্গত: উল্লেখযোগ্য যে, বাংলাদেশ হাইকোর্ট বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞাকে মুক্তিযোদ্ধা নির্ধারণের মৌলিক সংজ্ঞা গণ্য করে এতদসংক্রান্ত অন্যান্য সংজ্ঞা, লাল মুক্তিবার্তা ও নির্দেশিকাকে বেআইনি ও অকার্যকর বলে কেনো তা বাতিল করা হবে না, এ বিষয়ে সরকারের ওপর একটি রুলনিশি জারি করেছেন।

আমার এ ধরনের একটি বিবৃতি জাতীয় পত্রপত্রিকা ও সোসাল মিডিয়ায় প্রকাশিত হওয়ার পর এ প্রস্তাবের পক্ষে বেশ সাড়া পরিলক্ষিত হয়েছে। ফেনীর বীর মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন তাঁর প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছেন, যেহেতু উচ্চ আদালত সরকারের প্রতি রুল জারি করেছেন, সেহেতু এটা নিয়ে আমাদের উচ্চবাচ্য করা ঠিক হবে না। অপরদিকে নড়াইলের বীর মুক্তিযোদ্ধা আফতাব আহমেদ শিকদার ও পাবনার বীর মুক্তিযোদ্ধা বদিউজ্জামান প্রায় একই সুরে বলেছেন, যেহেতু মুক্তিযুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে উচ্চ আদালত দৃষ্টি দিয়েছেন, সেহেতু এটির পক্ষে বেশি বেশি করে সোচ্চার হতে হবে, জনমত সৃষ্টি করার জন্যে সংগ্রাম করতে হবে। কারণ আদালত শুধু আইনই দেখেন না, জনমতও দেখেন।' এছাড়া বিপুলসংখ্যক বীর মুক্তিযোদ্ধা নানান মন্তব্যে বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞা এবং সেটির আলোকে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কমিশন গঠনের প্রস্তাবের ওপর ব্যাপক সমর্থন ব্যক্ত করে যাচ্ছেন।

আমরা আমাদের বক্তব্যে বলেছি, আমরা রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধারা বড়ো বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করে আসছি যে, অতীতে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার থেকে শুরু করে চলমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সরকারিভাবে কমবেশি ২ লক্ষ ৩৫ হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে গেজেটভুক্ত করা হয়েছে। তথাকথিত যাচাই বাছাই অন্তে হয়তো শেষপর্বের প্রকাশিতব্য তালিকায় সামান্যসংখ্যক কমতে পারে যা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যাবে না। আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে ছিলাম, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে নিরন্তর গবেষণাকর্মে নিয়োজিত আছি তারাই জানি মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা কতো হতে পারে। তাছাড়া মুক্তিযোদ্ধা নির্ণয়ে বঙ্গবন্ধু সরকার ১৯৭২ সালে যে সংজ্ঞা দিয়ে গেছেন, সেটিকে মূল ধরে আগালে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা কোনো অবস্থাতেই ১ লক্ষ ৫০ হাজারের বেশি হবে না। সংগতকারণে বঙ্গবন্ধু সরকারের মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞাটি এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন। সেটি হলো : Freedom Fighters (FF) means any person who had served as a member of any force engaged in the War of Liberation [মুক্তিযোদ্ধা মানে একজন ব্যক্তি যিনি মুক্তিযুদ্ধে নিয়োজিত যেকোনো সশস্ত্রবাহিনীর সদস্য হিশেবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন ]। এটাই সর্বকালের শ্রেষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞা। সম্প্রতি মাননীয় হাইকোর্টও বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞাকে মৌলিক সংজ্ঞা ধরে অন্যান্য তথাকথিত সংজ্ঞা, নির্দেশিকা, বিশেষ করে লাল মুক্তিবার্তা কেনো বেআইনি ও অকার্যকর ঘোষণা করা হবে না এসব বিষয়ে সরকারের প্রতি একটি রুলনিশি জারি করেছেন। মূলত বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞার বাইরে ২০১৬ সালে যে তথাকথিত মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞা ও নির্দেশিকা চালিয়ে দেয়া হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে বাণিজ্যিক, আত্মীয়তা ও রাজনৈতিক বিবেচনার দৃষ্টিভঙ্গি যা কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়।

অতীত বিএনপি- জামায়াত জোট সরকারের ফর্মুলায় আওয়ামী লীগ সরকার জামুকা নামক যে কর্তৃপক্ষ সৃষ্টি করেছেন, এই জামুকার চেয়ারম্যান (মুবিমমন্ত্রী)সহ এর সদস্যরা তালিকা প্রণয়নের ক্ষেত্রে শুধু জটিলতাই সৃষ্টি করে আসছেন। এদের দিয়ে রাজাকারদের তালিকা করাতে গিয়ে যে হযবরল হয়েছিলো, ঠিক তেমনি এদের হাত দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের গোঁজামিলের তালিকাই প্রকাশিত হতে যাচ্ছে ! কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা তালিকা নিয়ে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা তো বটে, গোটা বাঙালি জাতি কোনো তামাশা ও ছেলেখেলা দেখতে চায় না। অপরদিকে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের গোঁজামিলের তালিকা জাতির পিতার কন্যার হাত দিয়ে অনুমোদিত হয়ে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাবে তা ভাবাই যায় না!

আমাদের যুক্তি হচ্ছে, বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞা দ্বারা কেবলমাত্র সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধারাই 'মুক্তিযোদ্ধা' বলে গণ্য হবেন। এ সংজ্ঞার আলোকে মুজিবনগর সরকারের নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন সেক্টর কমান্ডের অধীনস্থ সেনা-বিমান-নৌ বাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, আনসার, এফএফ-গণবাহিনী, বিএলএফসহ দেশের অভ্যন্তরে গড়েওঠা কাদেরীয়া বাহিনী, হেমায়েত বাহিনী, হালিম বাহিনী, আবসার বাহিনী, আকবর বাহিনী ও অন্যান্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সশস্ত্রবাহিনীর সদস্য সবাই বঙ্গবন্ধুর সংজ্ঞার মুক্তিযোদ্ধা বলে গণ্য হবেন। তবে মুক্তিযুদ্ধের সাথে সম্পৃক্ত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, তৎকালীন এমসিএ, কূটনীতিকবৃন্দ, মুজিবনগর সরকারের কর্মকর্তা ও কর্মচারী, স্বাধীনবাংলা বেতারের কলাকুশলী, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, চিকিত্সক, ফুটবলার প্রভৃতি অ-সশস্ত্র ব্যক্তিবর্গও ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। তাঁদের অবদানের যথাযথ স্বীকৃতি দেয়া হোক তা আমরাও চাই। তবে সবাইকে গড়ে "বীর মুক্তিযোদ্ধা" বলে দেয়া হবে চরম ইতিহাস বিকৃতি। মুক্তিযুদ্ধের সাথে সম্পৃক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্মপ্রক্রিয়ার নিরিখে যার যার ভূমিকার স্বীকৃতি দিতে হবে। যেমন একজন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বংশিবাদক বা একটি গানের দোহাড় বা একজন ফুটবল দলের সদস্য মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত প্রান্তরে অবগাহন করা শত্রুকে মেরে, নিজে মরে বা বুলেট ও গ্রেনেডে হাত পা ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া কোনো ব্যক্তির সমান্তরাল হতে পারেন না। যার যার কর্মপ্রক্রিয়া বিচার-বিবেচনা করা হলে যার যার অবদানকে যথাযথ মূল্যায়ন করা হয়; কারো সঙ্গে কারো সংঘর্ষ বাঁধার অবকাশ থাকে না। সুতরাং সশস্ত্র বীর মুক্তিযোদ্ধাদের একদিকে রেখে, অন্যান্যদের যার যার কর্মপ্রক্রিয়া অনুযায়ী অন্য যেকোনো ঐতিহাসিক অভিধায় স্বীকৃতি দেয়া যেতেই পারে।

পরিশেষ বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছি, যে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় হাজার হাজার অমুক্তিযোদ্ধা এমনকি রাজাকাররাও স্থান পাচ্ছে, যে মুক্তিযোদ্ধা তালিকা করার নামে বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞাকে অবমাননা করার মাধ্যমে তাঁকেই অপমান করা হচ্ছে, যে মুক্তিযোদ্ধা তালিকার মধ্যে বিশাল বাণিজ্যিক ধান্দা রয়েছে, যে তালিকা প্রকাশের মাধ্যমে প্রতারণার আশ্রয়ে প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব ও মর্যাদায় বিশালসংখ্যক অমুক্তিযোদ্ধা ভাগ বসিয়ে রাষ্ট্রীয় সম্মানী ও অন্যান্য সুবিধাদি লুটপাট করছে এমনই একটি কলঙ্কজনক তালিকাকে অনুমোদন দিয়ে নিশ্চয়ই মহলবিশেষের চক্রান্তের ফাঁদে পা দিয়ে তিনি নিজের ভাবমূর্তিকে বিসর্জন দিয়ে ইতিহাসের পাতায় বিতর্কিত হবেন না। একই সাথে বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞার সমর্থনে ও প্রস্তাবিত জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কমিশনের দাবিতে সোচ্চার হওয়ার জন্যে আমি দেশের সর্বস্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্মের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।

লেখক : চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।