ফিচার ডেস্ক : মাত্র ১৩ বছরের এক কন্যা। যাকে নির্মমভাবে নরবলি দেওয়া হয়েছিল। শুধু তাকেই নয়, বরং তার সঙ্গে ৪ বছরের একটি ছেলে ও ৫ বছরের একটি কন্যাকেও বলি দেওয়া হয়। ৫০০ বছর আগে নরবলির শিকার হয় এই তিন কন্যা। প্রকৃতিই তাদেরকে মমি করে রেখেছে আজও।

ঠিক যেন বসে থাকা অবস্থায় গভীর ঘুমে ঢলে পড়েছে তারা। হাঁটু ভাঁজ করে সামনের দিকে খানিকটা ঝুঁকে আছে মাথা। ৫০০ বছরেও নষ্ট হয়নি তাদের শরীর। শরীরের মতো গায়ের জামাটিও অক্ষত ছিল। এমনকি তাদের চুলও ঠিক সেভাবেই রয়ে গিয়েছিল।

ঘুমন্ত অবস্থায় বরফে শরীর জমে গিয়ে মৃত্যু হলে যেমন দেখায়; ঠিক তেমনই দেখাচ্ছিল তাদের। ওই তিন জনেরই শরীরের ভিতরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোতেও সেভাবে পচন ধরেনি। এক জনের হৃৎপিণ্ডে আবার এত বছর পরেও জমাট বাঁধা রক্ত মিলেছে।

এর কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞেরা জানিয়েছেন, তাদের শরীরে ডিহাইড্রেশন শুরুর আগেই তারা মমি হয়ে গিয়েছিল। এই মমির সন্ধান মেলে আটাকামা এলাকায়। এটি বিশ্বের সবচেয়ে শুষ্ক অঞ্চল। আর শুষ্ক বায়ুর কারণেই ৫০০ বছর ধরে দেহগুলো সুন্দরভাবে সংরক্ষিত আছে।

যেভাবে সন্ধান মেলে তিন কন্যার মমির

১৯৯৯ সালে আন্দিজ পর্বতের মাথায় লুলাইলাকো থেকে মাটি খুঁড়ে বের করা হয় একটি মমি। এরপর আরও খুঁড়ে দেখা মেলে একটি নয়, একসঙ্গে তিনটি মমি। তিন জনেরই বয়স খুব কম। মৃত্যুর সময় সবচেয়ে বড় জনের বয়স ছিল ১৩ বছর। বাকি দু’জনের যথাক্রমে চার এবং পাঁচ।

প্রত্নতত্ত্ববিদদের মতে, লুলাইলাকোর ওই তিন মমিই আসলে নরবলির নিদর্শন। তাদের মধ্যে ১৩ বছরের নাবালিকাকে ‘লুলাইলাকো কুমারী’ নাম দেওয়া হয়। তাকেই মূলত ঈশ্বরের কাছে উৎসর্গ করা হয়েছিল। বাকি দু’জনকে রাখা হয়েছিল তাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য।

বন্দি অবস্থায় দুর্গম ওই স্থানে একটু একটু করে শক্তি হারাচ্ছিল তাদের শরীর। বসে থাকা অবস্থাতেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে তারা। ওই অবস্থাতেই মৃতপ্রায় শিশুদের মাটির পাঁচ ফুট নীচে কফিনবন্দি করা হয়েছিল নরবলি দেওয়ার উদ্দেশ্যে।

প্রত্নতত্ত্ববিদদের মতে, মমিগুলির বয়স অন্তত ৫০০ বছর। আন্দিজ পর্বতের মাথায় লুলাইলাকোতে আজও পৌঁছনো বেশ কঠিন। বহু চেষ্টার পর ১৯৯৯ সালে পৌঁছতে পারে প্রত্নতত্ত্ববিদদের একটি দল। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হতে হতে এক সময় ফিরে আসার মানসিক প্রস্তুতিও নিয়ে ফেলেছিলেন।

তারপর সন্ধান মেলা একটি সূত্রের জোরে তারা অবশেষে লুলাইলাকোর শ্মশানে পৌঁছন এবং অনেক খোঁজার পর ইনকাদের নরবলির এই নিদর্শন খুঁড়ে বার করেন। এত বছর আগে এই দুর্গম অঞ্চলে ইনকাদের নিত্য যাতায়াত সত্যিই বিস্ময়কর।

ইনকা কারা?

পঞ্চদশ শতকের সবচেয়ে বড় সভ্যতা ছিল ইনকা। প্রযুক্তি এবং আভিজাত্য এই দুইয়ের মিশেল ছিল এই সভ্যতা। পঞ্চদশ শতকে আমেরিকার সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্য ছিল ইনকাদেরই। ইকুয়েডর থেকে চিলি পর্যন্ত প্রায় ৫ হাজার কিলোমিটার এলাকায় ছড়িয়ে ছিল এই সভ্যতা।

ইনকা সভ্যতার বেশির ভাগই আজও রহস্যে মোড়া। তাদের প্রযুক্তির ব্যবহার দেখে এ যুগে দাঁড়িয়েও বিস্মিত হতে হয়। এখনও ইনকাদের সম্পর্কে বেশির ভাগই অজানা। সেই রহস্য সমাধানের চেষ্টা করছেন প্রত্নতত্ত্ববিদেরা। একটু একটু করে আধুনিক সমাজের কাছে মেলে ধরছেন ইনকাদের জীবনযাত্রা।

তারই অন্যতম হল নরবলি। ইনকাদের মধ্যে এই প্রথার প্রচলন ছিল। নরবলি অর্থাৎ ঈশ্বরের কাছে কোনো পবিত্র প্রাণ উৎসর্গ করার রীতি। শরীরে কোনো কাটাছেঁড়া করতেন না তারা। জীবিত মানুষকেই মমি করে রেখে দিতেন।

কীভাবে মৃত্যু হয়েছিলো তাদের?

মমিগুলো খুঁড়ে পাওয়ার পর প্রত্নতত্ত্ববিদরা এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে থাকেন। বিভিন্ন পরীক্ষার পর তাদের মৃত্যুর কারণ জেনে সবাই আরও বিস্মিত হয়েছিলেন। মৃত্যুর ৬ মাস আগে থেকে শুধু মদ খাইয়েই রাখা হয়েছিল তাদের।

কোকো পাতা এবং ভুট্টা দিয়ে তৈরি মদ খেয়েই ৬ মাস বন্দি অবস্থায় দিন কাটিয়েছিল তারা। উৎসর্গের দিন যত এগিয়ে এসেছিল; তাদের মদের মাত্রাও বেড়েছিল। তিন কন্যার শরীর থেকেও কোকো পাতা আর ভুট্টার মদের সন্ধান মেলে।

কেন তারা এত মদ খেত? কারও মতে, উৎসর্গের এই প্রথা শুভ বলে গণ্য করা হত। ঈশ্বরের কাছে উৎসর্গের অনুমতি মিলত শুধুমাত্র সমাজের উচ্চশ্রেণির মানুষদের। মমি হয়ে যাওয়া ওই তিনজনই নিশ্চয় ধনী পরিবারের সন্তান ছিল।

আবার কারও মতে, বয়সে ছোট হলেও তাদের পরিণতি কী হতে চলেছে তা খুব ভালভাবেই বুঝে গিয়েছিল তারা। ভয় কাটাতে এবং শারীরিক কষ্ট কমাতে এগুলোর উপরই একমাত্র ভরসা ছিল তাদের।

অন্যদিকে সন্তানদের উৎসর্গ করে গর্ববোধ করতেন মা-বাবা। তাদের ধারণা ছিল, এতে সন্তান অমর হবে, ঈশ্বরের কাছে ঠাঁই হবে তার।

মমিগুলো কোথায় আছে?

বর্তমানে আর্জেন্টিনার সাল্টায় মিউজিয়াম অব হাই অলটিটিউট আর্কিওলজি-তে সংরক্ষিত আছে মমিগুলো। সাল্টাও এক সময় ইনকা সাম্রাজ্যের অধীন ছিল।

ক্ষয় রোধ করতে ওই একই শুষ্ক এবং ঠান্ডা আবহাওয়া তৈরি করা হয়েছে মমিগুলির কক্ষে। ২০০৭ সাল থেকে পর্যটকদের জন্য খুলে দেওয়া হয় এই জাদুঘর। সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফি

(ওএস/এসপি/আগস্ট ০৪, ২০২১)