রহিম আব্দুর রহিম


সবে মাত্র স্কুলে যাওয়া-আসা। দিন তারিখ মনে পরছে না। চাউলের দাম নাগালের বাইরে। ঢাকা থেকে সাংবাদিক এসেছে, এই সংবাদ এলাকায় ছড়িয়ে পরেছে। শতশত মানুষ ছুঁটছে সাংবাদিক দেখতে; তাদের মধ্যে আমিও একজন। গ্রামের বাড়ি থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার রাস্তা দৌঁড়াইয়া ঢাকা-জামালপুর সড়কের দিগপাইত বাস স্ট্যান্ডে হাজির হলাম; শতসহস্র মানুষের মাঝে সাংবাদিক দেখা কঠিন হয়ে দাঁড়াল। কে সাংবাদিক, কে সাধারণ তা খুঁজে না পেয়ে বাস স্ট্যান্ড সংলগ্ন বকুল গাছের নিচে দাঁড়ালাম। এক বয়স্কজন জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি রে তোরা কেন আইছস?’ বললাম, সাংবাদিক দেখতে। উনি বললেন, ‘দেখছস?’ বললাম, না। উনি দেখিয়ে দিলেন এক ব্যক্তিকে। যার হাতের এক তালায় কিছু কাগজপত্র, অন্য হাতে কালো একটি বাক্সের মত প্যাকেট, সম্ভবত ক্যামেরা হবে। মনভরে গেল, সাংবাদিক দেখেছি। বাড়ি এসে সত্য-মিথ্যা মিলিয়ে এক ভয়াবহ কাহিনী বন্ধু-বান্ধবদের শোনালাম। ওদের চেহারা দেখে বুঝতে বাকি থাকলো না, সাংবাদিক না দেখাটা তাদের জন্য একটা অভিশাপ! মনে মনে স্বপ্ন দেখা শুরু করলাম, আমিও সাংবাদিক হব। স্কুল পেরিয়ে কলেজ, স্থানীয় একটি পত্রিকায় রিপোর্ট করি। এরপর কলেজ ক্যাম্পাস প্রতিনিধি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার, স্টাফ রিপোর্টারের খ্যাতি নিয়ে এখন অধ্যাপনার পাশাপাশি লেখালেখি করছি। সময় গড়িয়েছে ৩৭ বছর, নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোতে আত্মতৃপ্তি ছাড়া আর কিছুই নেই।

বর্তমান সরকারের টানা ১২ বছরের ব্যবধানে দেশের সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকদের খনি বের হয়েছে। মাথার চুল গুনে শেষ করা যায়, সাংবাদিক গুনে শেষ করা মুস্কিল। সাধারণ মানুষ সাংবাদিকদের নাম শুনলে ‘ঘৃণার বমি’ উদগরণ করে। অসংখ্য অনলাইন পোর্টাল, টিভি চ্যানেলের হিসেব মেলানো ভার। টাকার বিনিময়ে পাওয়া যায় এ সমস্ত মিডিয়ার আইডি কার্ড। সমাজের রিক্সা- ভ্যান চালক, মেকার-মিস্ত্রি, অর্ধ শিক্ষিত-অশিক্ষিত বেকাররা গলায় কার্ড ঝুলিয়ে চষে বেরাচ্ছে গ্রাম-শহর। অফিস-আদালত, কোর্ট-কাচারি, থানা থেকে আঁতুর ঘর পর্যন্ত এদের দৌরাত্ম। অনেক নামি-দামি কিছু মিডিয়ায় কাজ করেছে এখন করে না, অর্জন করেছে সাংবাদিকতার খ্যাতি, এই খ্যাতিতেই রাষ্ট্রের সর্বাঙ্গে প্রভাব বিস্তার করে সুবিধা ভোগ করছে, এদের সংখ্যাও একেবারে কম নয়। হাতে মিডিয়া নেই, সাংবাদিক সংগঠনের নেতা সেজে সুবিধা গ্রহণকারীরাও তৎপর। রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলে বিবেচিত সংবাদ জগত এখন কলুষিত, কলঙ্কিত, অন্ধকারে পতিত এক ভয়াবহ জগতের নাম। এই জগতের সংষ্কারে কে, কারা, কখন এগিয়ে আসবেন সেটাই ভাবনার বিষয়।

বেশি দিনের কথা নয়, দেশ স্বাধীন হওয়ার পরের ঘটনা। গ্রামের জনমানুষ দিনমান হাড়ভাঙ্গা খাঁটুনির পর সন্ধা বেলায় হলে সিনেমা দেখতে যেতেন, বিদ্যুৎ না থাকায় জেনারেটরের সাহায্যে সিনেমা হল চলতো। সে কি আনন্দ! ওই সময়কার নায়ক-নায়িকাদের মনোমুগ্ধ অভিনয়ে বিমোহিত শ্রোতা-দর্শক তাদের নবজাতকের নাম রাখতেন নায়ক-নায়িকাদের নামানুসারে। তখনকার দিনে প্রতি মাসে একবার টেলিভিশনে প্রদর্শিত হতো সিনেমা। এই সিনেমা দেখার জন্য গ্রামের মানুষের সে কিভীড়! বিদ্যুৎ ছিল না, ব্যাটারির মাধ্যমে চলতো টিভি। এই ব্যাটারি চার্জ করে আনতে হতো শহর থেকে। এভাবেই দেখা হতো টিভি প্রদর্শিত সিনেমা। এখন আর সিনেমা কেউ দেখে না। যাও দেখতো তাও কলুষিত। সম্প্রতি এই কলুষিত অঙ্গনের অনেকেই ধরা পরেছে। কেউ কেউ পুলিশের নজরদারিতে রয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। কয়দিন পরে হয়ত শোনাও যাবে না।

রাজনীতির কথা কে না জানে! পাকিস্তানি শাসক-শোষকদের বিরুদ্ধে জনমত গঠনে জাতির পিতা গ্রাম থেকে গ্রামে চষে বেরিয়েছেন। জানিয়েছেন মুক্তির আহ্বান। যাঁর রাজনৈতিক আদর্শের কথা শুনেছি বাবা-মা প্রতিবেশির মুখে। দেখেছি আওয়ামী লীগের মত বৃহৎ সংগঠনের কর্মী সংগ্রহের পদ্ধতি। গ্রামে গ্রামে কর্মীদের কাছ থেকে সামান্য চাঁদার বিনিময়ে চলেছে এই দলটি। যে দল স্বাধীন দেশের একমাত্র অবলম্বন, সেই দলে পরগাছার শেষ নাই। বৃহৎ বা পুরোনো গাছে পরগাছা গজাবে এটাই সত্য। তবে তা ছেঁটে-ছুটে পরিস্কার করার মত একটি সময় সম্ভবত হেলেনা জাহাঙ্গীর ইস্যুতে সামনে এসেছে। এই ইস্যুকে কাজে লাগাতে পারলে রাজনীতির কুলাঙ্গারদের পতন ঘটতে পারে। আমাদের মধুর সংস্কৃতির অঙ্গনে জ্বীন-পরীদের যে আছর পরেছে, এটাও দূর হওয়া উচিত। চতুর্থ স্তম্ভের মিডিয়া জগতে সিলেটের তথা কথিত সাংবাদিক ফয়সাল কাদির কোন বড় ফ্যাক্টর নয়। দেশের পরতে পরতে এর চেয়েও বড় ফ্যাক্টররা উজ্জ্বীবিত। এদের হাত থেকে ‘সংস্কৃতি’, ‘সংবাদ জগৎ’এবং ‘রাজনৈতিক অঙ্গন’ রক্ষা এখন সুস্থ বিবেকের সময়ের দাবি।

লেখক : লেখক, শিক্ষক ও নাট্যকার।