স্বীকারোক্তি আদায়ের নামে ইলেকট্রিক শক!
কালীগঞ্জে চুরির মামলায় গ্রেপ্তার বাণিজ্যের অভিযোগ, ঘুষের ৯০ হাজার টাকা বদহজম!
রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : একটি চুরির মামলায় গ্রেপ্তার বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ থানার পুলিশ পরিদর্শক মিজানুর রহমান ও উপপরিদর্শক গোবিন্দ আকর্ষণের বিরুদ্ধে। আটককৃত এক ব্যক্তিকে স্বীকারোক্তি আদায়ের নামে দেওয়া হয়েছে ইলেকট্রিক শক। নির্যাতন বন্ধে দু’জনের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে ৩৮ হাজার টাকা। তিনজনকে আটকের পর মামলা না দেওয়ার শর্তে নেওয়া ৯৭ হাজার টাকার মধ্যে ৯০ হাজার টাকা ফেরৎ দেওয়া হয়েছে।
কালীগঞ্জ থানা সূত্রে জানা গেছে, গত ১০ জুলাই দিবাগত রাত দেড়টার দিকে বাড়িতে দুঃসাহসিক চুরির অভিযোগে পরদিন কারো নাম উল্লেখ না করেই থানায় মামলা(জিআর-২১৭/২১) করেন বিষ্ণুপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জয়পত্রকাটি গ্রামের নুরুল হক। এ মামলায় গ্রেপ্তারকৃত পাঁচজনের মধ্যে উপজেলার নবীননগরের ফজলু ঢালী ও বন্দকাটি গ্রামের জালাল মোড়লকে ১২ জুলাই গ্রেপ্তার করা হয় নিজ নিজ বাড়ি থেকে। ১৮ জুলাই তাদের প্রত্যেককে এক দিনের রিমাণ্ড মঞ্জুর করে আদালত।
চম্পাফুল ইউনিয়নের নবীননগর গ্রামের সৈয়দ ঢালীর ছেলে মফিজুল ঢালীর অভিযোগ, বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের এক ইউপি সদস্যের সঙ্গে তার চাচাত ভাই মাছ ব্যবসায়ি ফজলু ঢালীর বিরোধ দীর্ঘদিনের।এ বিরোধকে কাজে লাগিয়ে ওই ইউপি সদসস্যের সহযোগি পুলিশের সোর্স ফতেপুর গ্রামের সুমনকে ব্যবহার করে তদন্তকারি কর্মকর্তা উপপরিদর্শক গোবিন্দ আকর্ষণকে দিয়ে বিষ্ণুপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতির বাড়িতে চুরির মামলায় গ্রেপ্তার করানো হয়েছে। চাওয়ানো হয়েছে রিমাণ্ড। ফজলুর নির্যাতন বন্ধে গোবিন্দ আকর্ষণ তার কাছ থেকে এক হাজার ও স্থানীয় ইউপি চেয়ারনম্যানে মোজাম্মেল হকের মাধ্যমে ১৫ হাজার টাকা নিয়েছেন।
একইভাবে বন্দকাটি গ্রামের হাফেজ নেছারউদ্দিন মোড়লের অভিযোগ, গ্রামের মুকুল মোড়লের সঙ্গে তার বিরোধ রয়েছে। মুকুল মোড়ল পুলিশের সঙ্গে সখ্যতা বজায় রেখে তার ছেলে জালালকে গত ১২ জুলাই গভীর রাতে নুরুল হকের মামলায় গ্রেপ্তার করিয়ে রিমাণ্ডের ব্যবস্থা করিয়েছে। সূযোগ বুঝে গোবিন্দ আকর্ষণ তার কাছ থেকে ২২ হাজার টাকা নিয়েছেন। তবে ঘুষের বিষয়টি কাউকে না জানানোর শর্তে জালালের নাম অভিযোগপত্র থেকে বাদ দেওয়ার নিশ্চয়তা দিয়েছেন ওই পুলিশ কর্মকর্তা।
কুশুলিয়া চণ্ডিতলা গ্রামের সন্তোষ রায় এর ছেলে বিকাশ রায় জানান, গত ৪ আগষ্ট দিবাগত রাত দু'টো থেকে ভোর চারটার মধ্যে নিজ নিজ বাড়ি থেকে তার ভাই প্রকাশ রায়, বিষ্ণুপুর গ্রামের রণজিৎ সরদার ওরফে বাটুল সরদারের ছেলে সুশান্ত সরদার ও শ্রীরামপুর গ্রামের পরান গাজীর ছেলে রফিকুল গাজীকে আটক করে উপপরিদর্শক গোবিন্দ আকর্ষণ। এ সময়ের মধ্যে পুলিশ বিষ্ণুপুর গ্রামের শঙ্কর সরদারের ছেলে অপু সরদার ও জিয়াত শেখের ছেলে রবিউলকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালানো হয়।
সুশান্ত সরদার জানান, বৃহষ্পতিবার সকালে থানার পুলিশ পরিদর্শক মিজানুর রহমান জয়পত্রকাটি গ্রামের নুরুল হকের বাড়িতে চুরির ঘটনায় তার জড়িত থাকার বিষয়ে বিভিন্নভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। বিষয়টি নিয়ে তার এক আত্মীয় পুলিশ কর্মকর্তা মিজানুর রহমানের সঙ্গে কথা বলেন। এরপরও তার আত্মীয় মৃন্ময় সরদার ওরফে মধুর কাছ থেকে তাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য অফিসে বসে বৃহষ্পতিবার সন্ধ্যায় ৪০ হাজার টাকা ঘুষ নেন মিজানুর রহমান। এ সময় মৃন্ময় সরকারের কাছ থেকে একটি অলিখিত সাদা কাগজে সাক্ষর করিয়ে নেন ওই পুলিশ কর্মকর্তা। খবর পেয়ে বিষ্ণুপুর ইউপি চেয়ারম্যান শেখ রিয়াজউদ্দিন থানায় যেয়ে তাকে আটকের প্রতিবাদ করে তার জিম্মায় ছেড়ে দেওয়ার কথা বলেন পুলিশ পরিদর্শক মিজানুর রহমানকে। রাত সোয়া ১১টার দিকে তাকে থানা থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
বিষয়টি পুলিশের উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হলে ৬ আগষ্ট শুক্রবার সন্ধ্যায় থানা থেকে টাকা ফেরৎ দেওয়ার কথা বলা হয়। একপর্যায়ে শুক্রবার সন্ধ্যায় থানার সামনে এলে এক ঘণ্টা আগে তিনজনের জন্য ৯০ হাজার টাকা কাজী স্বজলের বাড়ি থেকে নেওয়ার জন্য মোবাইল ফোনে জানানো হয়। পরে তিনি (সুশান্ত) নিজে ৩৫ হাজার টাকা ওই আওয়ামী লীগ নেতার কাছ থেকে ফেরৎ পান।
কুশুুলিয়া গ্রামের বিকাশ রায় জানান, তার ভাই প্রকাশকে ধরে নিয়ে নুরুল হকের বাড়িতে চুরির মামলায় জড়ানোর চেষ্টার বিষয়টি তার এক খালাত ভগ্নিপতি সিআইডি কর্মকর্তাকে অবহিত করা হয়। তিনিও পুলিশ পরিদর্শক মিজানুর রহমানের সঙ্গে কথা বলেন। লাভ হয়নি তাতে। প্রকাশকে ছেড়ে দিতে বৃহষ্পতিবার সন্ধ্যায় তার কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা টাকা নেন পুলিশ কর্মকর্তা মিজানুর রহমান। রাত সাড়ে ১১টার দিকে ভাইকে ছেড়ে দেওয়ার পরপরই উপপরিদর্শক গোবিন্দ আকর্ষণ তার কাছ থেকে দু’ হাজার টাকা নেন। অজ্ঞাত কারণে শুক্রবার সন্ধ্যার পর মিজানুর রহমানের ফেরৎ দেওয়া ২০ হাজার টাকা স্বজল কাজীর কাছ থেকে নিয়ে আত্মীয় ও দলিল লেখক উজ্জল কুমার সরদার তাকে বুঝিয়ে দিয়েছেন।
শ্রীরামপুর গ্রামের রফিকুল ইসলাম বলেন, নূুরুক হকের বাড়িতে চুরির মামলায় স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য তার দু’ কানে পাঁচ মিনিটের মধ্যে চার বার ইলেকট্রিক শক দেন পুলিশ কর্মকর্তা মিজানুর রহমান। এখন তিনি কানে ভালো করে শুনতে পাচ্ছেন না। ছেড়ে দেওয়ার জন্য ভাই সাদ্দামের কাছ থেকে নেওয়া ৩৫ হাজার টাকা ইউপি সদস্য সিরাজুলের হাত থেকে নেন পুলিশ কর্মকর্তা মিজানুর রহমান। শুক্রবার সন্ধ্যায় ওই পুলিশ কর্মকর্তার ফেরৎ দেওয়া ৩৫ হাজার টাকা স্বজল কাজীর মাধ্যমে তাকে দেওয়ার জন্য ইউপি সদস্য সিরাজুল ইসলামকে দিলেও বুধবার দুপুর দু'টো পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। নানাভাবে টালবাহানা করা করছেন ওই জনপ্রতিনিধি।
সুশান্ত সরদার, রফিকুল ইসলাম ও প্রকাশ রায় জানান, বৃহষ্পতিবার রাত সোয়া ১১টার দিকে তাদেরকে সময়ে ছেড়ে দেওয়ার সময় একটি সাদা কাগজে তাদের তিনজনসহ বিষ্ণুপুর ইউপি সদস্য সিরাজুল ইসলাম ও কুশুলিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি কাজী কাওফিল আরা স্বজলের কাছ থেকে অলিখিত একটি সাদা কাগজে সাক্ষর করিয়ে নেওয়া হয়।
বিষ্ণুপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি নুরুল হক জানান, ঘটনাটি ডাকাতি হলেও পুলিশ কৌশলে চুরির মামলা রেকর্ড করায়। এ মামলায় সুশান্ত সরকার, প্রকাশ ও রফিকুলকে আটক করে তাদের মুক্তির বিনিময়ে ঘুষ নেওয়া ও পরে সে টাকা ফিরিয়ে দেওয়ার কথা শুনেছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, গ্রেপ্তার বাণিজ্যে তিনি অবাক হয়েছেন।
বিষ্ণুপুর ইউপি সদস্য সিরাজুল ইসলাম বলেন, কাজী স্বজলের কাছ থেকে নিয়ে আসা টাকা বিশেষ কারণে আটকে রাখা হয়েছিল। তবে তা রফিকুলকে দেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
কুশুলিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি কাজী কাওফিল আরা স্বজল বুধবার সকালে এ প্রতিবেদককে মোবাইল ফোনে বলেন, পুলিশ পরিদর্শকের ফিরিয়ে দেওয়া ৩৫ হাজার টাকা সিরাজুল মেম্বর রফিকুলকে ফেরৎ দিয়েছেন কিনা তা তিনি জানেন না। তাবে ফেরৎ না দিলে রফিকুল নিজে তাকে জানালে টাকা ফেরৎ দেওয়ার উদ্যোগ নেবেন তিনি।
এ ব্যাপারে বুধবার সকাল থেকে কয়েকবার কালীগঞ্জ থানার উপপরিদর্শক গোবিন্দ আকর্ষণের সঙ্গে মোবাইলে কথা বলার চেষ্টা করলে তিনি রিসিভ করেননি। তবে সর্বশেষ একবার রিসিভ করে কোন কথা না বলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।
কালীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (তদন্ত) মিজানুর রহমান বুধবার সকালে মোবাইল ফোনে বলেন, তিনি ওই চুরির মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা নন। তাই তার টাকা নেওয়ার কোন প্রশ্নই আসে না। তবে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে শেষ পর্যন্ত টাকা নেওয়া ও ফেরৎ দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে তিনি নীরবতা পালন করেন।
কালীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোঃ গোলাম মোস্তফা জানান, আওয়ামী লীগ নেতা নুরুল হকের দায়েরকৃত চুরির মামলায় প্রকাশ, সুশান্ত ও রফিকুলের কাছ থেকে পুলিশ পরিদর্শক মিজানুর রহমানের ৯৭ হাজার টাকা নিয়ে ৯০ হাজার ফেরৎ দেওয়ার বিষয়টি সম্পূর্ণ মিথ্যা। এ ছাড়া আসামী জালাল ও ফজলুকে নির্যাতন না করার জন্য) ৩৮ হাজার টাকা নেওয়ার যে অভিযোগ করা হয়েছে তা গোবিন্দ আকর্ষণ অস্বীকার করেছেন। তবে তিনি বিষয় বিষয় দু’টি নিশ্চিত হতে দু’ পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত করবেন বলে জানান।
(আরকে/এসপি/আগস্ট ১১, ২০২১)