মাগুরা প্রতিনিধি : সরকার পরিবর্তনের সাথে-সাথেই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইয়ের নামে মুক্তিযোদ্ধার নামের তালিকা হচ্ছে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর। আগাছার মতোই বৃদ্ধি পাচ্ছে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা। যোগ হচ্ছে নতুন-নতুন মুক্তিযোদ্ধাও। 

মাগুরার ৪ উপজেলায়ও থেমে নেই এই মুক্তিযোদ্ধা বৃদ্ধিতে। জেলায় ১৭৭৫ জন মুক্তিযোদ্ধা রয়েছে। এর মধ্যে মাগুরা সদর উপজেলায় ৫৫০ জন, শালিখায় ১২৫ জন, শ্রীপুর ৬৫০ জন ও মহম্মদপুর উপজেলায় ৪৫০জন মুক্তিযোদ্ধা রয়েছে। কে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা,আর কে মুক্তিযোদ্ধা নয় তা নিয়ে জন মনে সংশয় দেখা দিয়েছে। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার পাশাপাশি এ সকল কথিত মুক্তিযোদ্ধারাও সরকার প্রদত্ত সকল সুযোগ সুবিধা ভোগ করছে।

শালিখা উপজেলাও পিছিয়ে নেই মুক্তিযোদ্ধা বৃদ্ধিতে। শালিখায় ২০০১ সালে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিলো ৮২ জন। বর্তমানে তা দাঁড়িয়েছে ১২৫ জনে। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের পাশা-পাশি বৃদ্ধি পাওয়া এ সব ভ’য়া মুক্তিযোদ্ধারাও সরকার প্রদত্ত বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা ভোগ করছে।

‘৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় কোথাও যুদ্ধ না করে মুক্তিযুদ্ধের ৪৩ বছর পর হঠাৎ করেই মুক্তিযোদ্ধার সাময়িক সনদপত্র দেখিয়ে অনেকেই বলছে তারা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। ঘোষিত এই মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় রয়েছে শরীফ শাহ দেওয়ান, নরোত্তম মন্ডল, শুম্ভুনাথ বিশ্বাস, আজিজ মৃধাসহ আরও অনেকে। উপজেলার কোটবাগ গ্রামের বগুড়া পাড়ার শরীফ শাহ দেওয়ানের দুটি সনদ বাগিয়ে নিয়েছেন। যা ১৯৯৯ সালে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ প্রদত্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আহাদ চৌধুরী স্বাক্ষরিত সনদপত্রের ক্রমিক নম্বর ১২০৭৮ এবং ২০০৬ সালে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রনালয় প্রদত্ত প্রতিমন্ত্রী ও সচিব স্বাক্ষরিত সনদপত্রের নম্বর ম-১১৪০৪৪, গেজেটের ক্রমিক নং-৩৩৬৪ তাং ১৮ ডিসেম্বর ০৬ সাল। একই গেজেটে নাম রয়েছে দীঘল গ্রামের নরোত্তম মন্ডলের। গেজেটের ক্রমিক নম্বর ৩৩৬৩। দীঘল গ্রামের শম্ভু নাথ বিশ্বাস ও শতখালী গ্রামের আজিজ মৃধাও এ ধরনের সনদ এনে অনেককে দেখালেও ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে তারা এ সনদ প্রাপ্তির কথা এখন আর স্বীকার করছেন না। শরীফ-শাহ দেওয়ান ও নরোত্তম মন্ডল মাসিক সম্মানী ভাতাও তুলছেন। তাদের ভাতা প্রাপ্তীতে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েক জন মুক্তিযোদ্ধা জানান এরা ছাড়াও আরও অনেক ভ’য়া মুক্তিযোদ্ধা নিয়মিত ভাতা উত্তোলন করছেন।

একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে এ পর্যন্তু প্রকাশিত ৪ তালিকার যে কোন ২ তালিকায় নাম থাকতে হবে এবং গেজেট আকারে নাম প্রকাশিত হতে হবে। এই ৪ তালিকার কোনটিতেই এ সকল মুক্তিযোদ্ধার নাম নেই। মুক্তিযোদ্ধা মুকুল বিশ্বাস ও নারায়ন চন্দ্র বিশ্বাস বলেন শরীফ শাহ দেওয়ান ও নরোত্তম মন্ডল তাদেরকে বলেছে মাগুরা সদর উপজেলার কমান্ডার জহুর-এ-আলম এ সনদ দুটি এনে দিয়েছেন। জহুর-এ-আলমের সাথে কথা বললে তিনি জানান শরীফ শাহ দেওয়ান ও নরোত্তমকে আমি চিনি না। দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ না নিয়েও এক শ্রেনীর অসাধু ব্যক্তি মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম উঠিয়ে সুযোগ সুবিধা নিচ্ছেন।

ওই সব মানুষকে সনদ পেতে সহযোগিতা করছেন উপজেলা - জেলা কমান্ডের একশ্রেনীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার, মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রনালয় ও জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) এর কিছু অসাধু কর্মকর্তা। ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলার তিমিরকাঠি গ্রামের মৃত মোজাহার আলী হাওলাদারের পুত্র পুলিশের সাব-ইন্সেপেক্টর মোঃ মোফাজ্জল হোসেন হাওলাদার ২০১৩ সালের ১১ আগষ্ট শালিখা থানায় যোগদান করেন এবং ২০১৪ সালের ৩০ জুলাই এলপিআরে যান। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক থানা কমান্ডার মোঃ আলী আহম্মদ বিশ্বাসের সাথে যোগাযোগ করে মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে এ এলাকায় মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহন করার একটি প্রত্যয়ন পত্র নেন। প্রত্যয়ন পত্রটি নিয়ে তার নিজ জেলা ঝালকাঠির মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাথে যোগাযোগ করে মন্ত্রনালয় থেকে মুক্তিযোদ্ধার সনদ বের করেন। এই সনদ দেখিয়ে তিনি চাকুরির মেয়াদ বৃদ্ধির সুবিধা গ্রহন করেন।

এ ব্যাপারে সাব-ইন্সেপেক্টর মো. মোফাজ্জল হোসেন হাওলাদার নিকট জানতে চাইলে তিনি বলেন ‘৭১ সালে অস্ত্র হাতে শালিখায় যুদ্ধ করেছিলাম এবং যুদ্ধ শেষ হলে বরিশালে যেয়ে অস্ত্র জমা দেই। শালিখা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আলী আহম্মদ বিশ্বাস জানান যুদ্ধকালীন কমান্ডার মো. শামছুর রহমান -মোফাজ্জল হোসেনকে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে সুপারিশ পত্র প্রদান করায় আমি প্রত্যয়ন পত্র প্রদান করি। মো. শামছুর রহমান জানান সাবেক কমান্ডার আলী আহম্মদ বিশ্বাস মোফাজ্জল দারোগাকে আমার কাছে নিয়ে এসে বলেন ইনি শালিখায় মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। তাকে মুক্তিযোদ্ধার একটি সুপারিশ পত্র দিতে হবে। মূলত তার পীড়া-পিড়ির কারণেই আমি সুপারিশ পত্র দিতে বাধ্য হই।

তবে দারোগা মোফাজ্জল হোসেনের বক্তব্যের বিরোধিতা করে বলেন তিনি এ এলাকায় কখনও যুদ্ধ করেননি। শালিখার মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার মো. ইদ্রিস হোসেন, মো. মোন্তাজ শিকদার, মো. ছব্দার হোসেন, মো. হাশেম আলী মন্ডলসহ বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধারা জানান নামল্ল্যোখিত সকলেই ভ’য়া মুক্তিযোদ্ধা। এ ছাড়া আরও অনেক ভ’য়া মুক্তিযোদ্ধা রয়েছে। তারা ভাতাও উত্তোলন করছেন। তারা আরও বলেন মাগুরায় মুক্তিযোদ্ধার জাল সনদ তৈরী ও ভ’য়া মুক্তিযোদ্ধা বানানোর শক্তিশালী সিন্ডিকেট রয়েছে। কতিপয় অসাধু মুক্তিযোদ্ধা দীর্ঘদিন ধরে এই সিন্ডিকেট পরিচালনা করে আসছে। এ সিন্ডিকেটের সদস্যদের নাম সকলের জানা থাকলেও এদের বিরূদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহনের কোন উদ্যোগ নেই।

উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের বর্তমান কমান্ডার মো. আবু বক্কার বিশ্বাস জানান ১৯৯৮-৯৯ সালে কেন্দ্রীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কর্তৃক ৩ বার যাচাই-বাছাইয়ের পর মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিলো ৮২ জন। তাদের নাম মুক্তিবার্তার লাল তালিকায় রয়েছে। গত ১৫ বছরে এ সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ১শ২৫ জনে দাড়িয়েছে। উপজেলা যাচাই-বাছাই কমিটি থাকলেও তাকে পাশ কাটিয়ে এক শ্রেনীর অসাধু ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রনালয়ের সাময়িক সনদ পত্র এনে নিজেদেরকে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা বলে দাবি করছেন। তাদের হাতে মন্ত্রনালয়ের সনদপত্র থাকায় তাদের বিরূদ্ধে আমাদের কিছুই করার নেই।

মহম্মদপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মো. আলী রেজা খোকন জানান এ পর্যন্তু কেহ মুক্তিযোদ্ধার সঠিক হিসাব দিতে পারে নাই। আমরা যে কয়েক জন অস্ত্র জমা দিয়েছিলাম তা বাদেও আজ এ সংখ্যা কতো। আরও হয়তো বাড়বে। দেশে আর একবার যুদ্ধ হলে তবেই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা বেরিয়ে আসবে।

মাগুরা জেলার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোঃ নবুয়ত হোসেন মোল্যা জানান কে কি ভাবে মুক্তিযোদ্ধা হচ্ছে তা আমার জানা নাই। তবে বর্তমানে জামুকার মাধ্যমে অনেকেই মুক্তিযোদ্ধা হচ্ছে। আপনি প্রত্যয়ন না দিলে কি ভাবে মুক্তিযোদ্ধা হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন – আমি তো সকলকে চিনিনা। থানা কমান্ডাররা নিয়ে আসে তাই আমি প্রত্যয়ন দিই।

(ডিসি/এএস/সেপ্টেম্বর ০৯, ২০১৪)