চৌধুরী আবদুল হান্নান


২০০১ সালে অধ্যাপক ডা.বি চৌধুরী যখন দেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে মনোনিত হলেন, তাঁর ছেড়ে দেয়া নির্বাচনী আসনে উপনির্বাচনের তোড়জোড় চলছে। এক প্রার্থীর নামে লোকাল অফিসে খেলাপি ঋণ রয়েছে, এ সংক্রান্ত চিঠি নির্বাচন কমিশনে পাঠালে তার প্রার্থিতা বাতিল হয়ে যাবে।ফলে অপর প্রার্থীর বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে। কিন্ত চিঠি তৈরি করতে গিয়ে দেখা গেল, ভয়ংকর ঘটনা ! 

এক গভীর নিম্নচাপ তৈরি হয়ে আছে, ঘূর্ণিঝড় উঠবে। খেলাপি ঋণ হিসাবটি ভুলক্রমে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়নি, ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবিতেও রিপোর্ট হয়নি। অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ তথ্য ভান্ডার অনুযায়ী এটা খেলাপি ঋণ নয়। ব্যাংক এখন উভয় সংকটে, মহা সংকটে। বিষয়টি রাজনৈতিক বড় নেতাদের কাছেও বিদ্যুৎ গতিতে পৌছে গেল।দলের অঙ্গ সংগঠনের সাথে সম্পর্কিত ব্যাংকের নেতারা বীর দর্পে ঝাপিয়ে পড়েছে শিল্পঋণ বিভাগের কর্মকর্তাদের ওপর।একদল বলছে খেলাপি ঋণের তথ্যসহ চিঠি দিতে, অন্যদল বলছে ব্যাংকের ব্যাংকের রেকর্ড অনুযায়ী আমরা ঋণ খেলাপি নই, তাই চিঠি দিতে পারেন না। অফিস উত্তপ্ত, উত্তাল। যেন এমপি নির্বাচনে জয় পরাজয় সোনালী ব্যাংকই নির্ধারণ করে দেবে।

এ খবর ব্যাংকের সর্বোচ্চ মহলে পৌছাতে বিলম্ব হলো না। অফিস প্রধান জেনারেল ম্যানেজার মো.মিজানুর রহমান ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সাথে এ বিষয়ে এমডি মহোদয়ের চেম্বারে দীর্ঘ বৈঠক শেষে ফিরে এসেছেন। একজন সদা হাস্যোজ্জ্বল, নির্ভীক মানুষকে ইতিপূর্বে এতো বিষণ্ণ কেউ দেখেনি।এবার কি তিনি সহকর্মীদের বাঁচাতে পারবেন ? একটি রাজনৈতিক দলকে ব্যাংকের সত্য গোপন করে অনৈতিক সুবিধা দেয়ার অভিযোগে ব্যাংকের কিছু লোকের চাকুরি যাবে—এ বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে গেছে। এই চিঠি সই করার অথরিটি আমার, কারণ আমি এ বিভাগটির প্রধান কিন্ত আমার অবস্হান সুতায় ঝুলছে। খড়কুটোর মতো ভেসে যাওয়া এখন কেবল সময়ের ব্যাপার।

বিষয়টি এতো বড় যে এখানে আমার কোনো ভূমিকা থাকতে পারে রাজনীতির উচ্চ পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে এমন ভাবনা আসেনি, তারা কেবল ব্যাংকের উচ্চ পর্যায়কে অস্হির করে ফেলছে। তবে এ বিষয়ে উপর থেকে এখনো নেগেটিভ, পজিটিভ কোনো নির্দেশ আমাকে দেয়া হয়নি। তাই সিদ্ধান্ত গ্রহণে আমার দরজা খোলা, বাঁচার জন্য শেষ কামড় তো দিতেই হবে। এক দলের এক নেতাকে ডেকে বললাম— বিকালে চিঠি আমার নিকট থেকে নিয়ে যাবেন, আপনাদের সকল লোক চুপচাপ দপ্তর থেকে সরিয়ে নিন, অন্যদল তো আগেই শান্ত মেজাজে আছে, তাদের বিশ্বাস ব্যাংক এমন চিঠি দিতেই পারে না কারণ বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য তাদের পক্ষে।

গ্রাহক ঋণ খেলাপি—এ মর্মে গোপনে চিঠি তৈরি করতে ডিপার্টমেন্টে বলে দিলাম কিন্ত কথা গোপন রইলো না।এবার শুরু হলো আমার পিছনে তাড়া।ল্যান্ডফোন বেঁজে উঠলো , চেম্বার ডিউটি করে আহমেদ পেয়ার ফোন ধরে জবাব দিলো—,” স্যার তো চেম্বারে নাই ।” “ মিথ্যা “ বলার কারণ সে যা বললো তাতে ওর তাৎক্ষণিক বুদ্ধিমত্তা দেখে আমি মুগ্ধ।মনে হলো সে আমাকে এ যাত্রায় বাঁচিয়ে দিলো।ফোনটা কার ছিল ? তা থাক ! সবাই যখন পালিয়েছে , এবার আমার পালানোর পালা, আমি চেম্বার ছেড়ে আমার পূর্বের কর্মস্থল প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে ঘাপটি মেরে রইলাম।এখন একমাত্র কাজ চিঠিটি স্বাক্ষর করে নির্বাচন কমিশনে পাঠিয়ে দেয়া, ট্রান্সপোর্টের সামসুল হককে বলে একটি গাড়িও প্রস্তুত রাখা হয়েছে। খেলাপি গ্রাহকের প্রতিনিধি ইতিমধ্যে নিশ্চিত হয়ে গেছে যে, চিঠি যাবেই ।

কেউ ঠেকাতে পারবে না। আধ ঘন্টার মধ্যে আমার “ গোয়েন্দা বাহিনী” খবর দিলো, ৬০ লক্ষাধিক নগদ টাকা নিয়ে তারা আসছে ঋণ পরিশোধের জন্য। মহান আল্লার অশেষ রহমত—টাকার বস্তা লোকাল অফিসের পিছন দরজা দিয়ে ক্যাশ বিভাগের মহানিরাপত্তা কক্ষে ঢুকে পড়েছে। আমার কানকে বিশ্বাস হচ্ছে না, মনে হচ্ছে আমি স্বপ্নের ঘোরে। টাকা জমা হলো, খেলাপি ঋণ পরিশোধ। এখন আমি নিজেই ফুরফরা। ঘটনা প্রবাহ সফল পরিনতির দিকে নিয়ে যাওয়ার মূল নায়ক লোকাল অফিসের জেনারেল ম্যানেজার মো.মিজানুর রহমানের দূরদর্শিতা।

তিনি যদি প্রধান কার্যালয়ের নির্দেশনা (দায়ী কর্মকর্তাদের সাময়িক বরখাস্ত) তাৎক্ষণিক কার্যকর করার উদ্যোগ নিতেন (সেটাই স্বাভাবিক ছিল) তা হলে দীর্ঘদিনের খেলাপি ঋণ আদায় তো হতোই না, একটি রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনে অনৈতিক সুবিধা দেয়ার অভিযোগে ব্যাংকের কর্মকর্তাদের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হতো এবং এমন খবর পরের দিন সকল জাতীয় পত্রিকার শিরোনাম দখল করতো। মিজান স্যার কেবল অফিসের বসই ছিলেন না, সহকর্মীদের বন্ধুও ছিলেন। তাই তিনি অনন্য, বেতিক্রম। উল্লেখ্য, পরবর্তীতে তিনি বাংলাদেশ শিল্প বাংক, বাংলাদেশ শিল্পঋণ সংস্থা, সর্বশেষ মধুমতি ব্যাংকের ব্যবস্হাপনা পরিচালক ছিলেন।

লেখক : সাবেক ব্যাংকার।