আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ১৯৬১ সালে ডরোথি বাটলার গিলিয়াম শীর্ষস্থানীয় মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্টে যোগ দেন। তিনি ছিলেন প্রথম আফ্রিকান আমেরিকান নারী সাংবাদিক। তখনকার বর্ণবিদ্বেষী পরিবেশে শেতাঙ্গদের জগতে একমাত্র কৃষ্ণাঙ্গ নারী হিসেবে তাকে অনেক প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। বিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে এই সাংবাদিককে।

ডরোথি বলেন, একবার তিনি ওয়াশিংটনের একজন সম্পদশালী নারীর শততম জন্মদিনের পার্টিতে গিয়েছিলেন। তখন দারোয়ান তাকে সামনের দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে বাঁধা দিয়ে বলেছিল, চাকরদের প্রবেশদ্বার বাড়ির পেছন দিকে। ডরোথি জবাবে বলেন, আমি চাকর নই, আমি ওয়াশিংটন পোস্টের একজন সাংবাদিক।

১৯৬১ সালে ক্যারিয়ার শুরু করে পরবর্তী তিন দশক তিনি সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেন। কাজ করেন সম্পাদক ও কলাম লেখক হিসেবেও। বর্ণবাদী মানসিকতার ব্যাপারে মার্কিন সমাজ ও সংবাদমাধ্যমের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সাক্ষী হন তিনি।

কলেজ জীবনে ঘটনাক্রমে ডরোথি সাংবাদিকতায় ঢুকে পড়েন। তিনি যখন কলেজের প্রথম বর্ষে অধ্যয়নরত, তখন লুইসভিল ডিফেন্ডার নামে কৃষ্ণাঙ্গদের একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায় দাপ্তরিক কাজকর্ম করতেন। একদিন পত্রিকার সমাজজীবন বিভাগের সম্পাদক অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তাকে তার জায়গায় কাজ করতে বলা হয়। হঠাৎ কোন অভিজ্ঞতা ছাড়াই তাকে কেন্টাকির সবচেয়ে বড় শহরে প্রতিবেদন করতে পাঠানো হয়।

তিনি বলেন, এটা ছিল আমার জন্য চমৎকার ও ব্যতিক্রমী একটি অভিজ্ঞতা। আমি দেখলাম সাংবাদিকতা এমন একটি পেশা, যদি আমি এখানে ভালভাবে কাজ করতে পারি, তাহলে আমার সামনে অনেক সম্ভাবনার দরজা খুলে যেতে পারে এবং আমি পৃথিবীর সামনে নিজেকে প্রকাশ করার সুযোগ পেতে পারি।

কলেজ জীবন শেষ হওয়ার পর তিনি জেট এবং ইবোনির মতো কৃষ্ণাঙ্গদের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকায় কাজ করেছেন। কিন্তু তার স্বপ্ন ছিল দৈনিক সংবাদপত্রে কাজ করা। তিনি নিউইয়র্কের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতার ওপর পড়াশোনা করার সুযোগ পেয়েছিলেন। তিনি ছিলেন তার কোর্সের একমাত্র আফ্রিকান আমেরিকান শিক্ষার্থী।

ওয়াশিংটন পোস্ট যখন তাকে চাকরি অফার করে, তার বয়স তখন মাত্র ২৪ বছর। ওই পত্রিকায় প্রথম আফ্রিকান আমেরিকান নারী সাংবাদিক হিসেবে কাজ করতে গিয়ে বিচিত্র অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন তিনি।

কোনো ট্যাক্সি ক্যাব তার জন্য দাঁড়াতো না। তিনি বলেন, আমি পত্রিকা অফিসের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতাম। ট্যাক্সিগুলো অপেক্ষমান যাত্রী দেখে পথমে গাড়ির গতি কমাতো। কিন্তু যখন তারা আমার বাদামী মুখ দেখতে পেতো, সঙ্গে সঙ্গেই সেখান থেকে চলে যেত।

লোকজন প্রায়ই বিশ্বাসই করতে চাইতেন না যে, তিনি ওয়াশিংটন পোস্টে সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেন। নিউজরুমেও তাকে অনেক বর্ণবাদী আচরণের সম্মুখীন হতে হয়েছে। ডরোথি বলেন, পুরোনো বর্ণবাদী ধ্যান ধারণার অনেক সম্পাদক তখনও ছিলেন ওয়াশিংটন পোস্টে। তাদের একজন একবার বলেছিলেন, আমরা কৃষ্ণাঙ্গদের হত্যাকাণ্ডের খবর কাভার করি না, এগুলো সস্তা মৃত্যু। ডরোথি বলেন, তার মন্তব্য শুনে আমার ইচ্ছে করছিল চিৎকার করে সেখান থেকে পালিয়ে যাই। কিন্তু নিজেকে বুঝিয়েছিলাম আমি কাজ অব্যাহত রাখলেই এ রকম মানসিকতা ধীরে ধীরে কমবে।

কর্মস্থলে সহকর্মীদের আচরণে মাঝে মাঝে খুবই নিঃসঙ্গ বোধ করতেন তিনি। তখন জেট পত্রিকার প্রাক্তন সহকর্মীদের সাথে কথা বলে হালকা হতেন। তার ধর্মীয় বিশ্বাসও তাকে সান্ত্বনা পেতে সাহায্য করত।

তিনি বলেন, ‘নিউজরুমের ভেতরে সহকর্মীদের কেউ কেউ হ্যালো বলতো, মাথা নাড়তো অথবা আমার সঙ্গে কথা বলতো। কিন্তু অফিসের বাইরে আমাকে দেখলে তারা এমন ভান করত যেন আমাকে চেনেই না। এটা খুবই অপমানজনক আচরণ ছিল। তারা অন্য শ্বেতাঙ্গদের সামনে স্বীকার করতে চাইতো না যে একজন কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ তাদের পরিচিত।

কিন্তু ডরোথি সম্পাদকদের কাছে এসব আচরণের ব্যাপারে কিছুই বলতেন না। তিনি আশংকা করতেন, এসব বিষয়ে অভিযোগ করলে তা পরবর্তীতে কৃষ্ণাঙ্গ সাংবাদিকদের নিয়োগ না দেওয়ার অজুহাত হয়ে দাঁড়াবে।

ষাটের দশকে যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গ নারী হিসেবে ডরোথির জন্য দুপুরের খাবার পাওয়াও কঠিন ছিল। ওয়াশিংটনের অনেক রেস্তোরাঁ তখনও বর্ণবাদী মানসিকতা লালন করতো। ওয়াশিংটন পোস্টের কার্যালয়ের কাছাকাছি থাকা রেস্তোরাঁগুলো আফ্রিকান আমেরিকানদের জন্য নিষিদ্ধ ছিল। ডরোথি বেশ কিছুক্ষণ হেঁটে দূরের ক্যাফেটেরিয়াতে খাবার খেতে যেতেন।

তখনকার মার্কিন সংবাদপত্রে কৃষ্ণাঙ্গদের বেশিরভাগ সময়ই নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হতো। ডরোথি তার সামর্থ্য অনুযায়ী নতুনভাবে কৃষ্ণাঙ্গদের গল্প বলার চেষ্টা করেছেন। ডরোথি মনে করেন, আফ্রিকান আমেরিকানদের যে একটা নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছিল তার কারণ কৃষ্ণাঙ্গদের কোনো কথা শোনাই হতো না, তাদের বয়ান আমলে নেওয়া হতো না। তিনি বলেন, আমি কৃষ্ণাঙ্গদের শুধু নেতিবাচক গল্পগুলো না বলে তাদের জীবনের পূর্ণাঙ্গ চিত্র তুলে ধরতে চেয়েছি।

ডোরোথি তার তৃতীয় সন্তান হওয়ার পর ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে ওয়াশিংটন পোস্টের নিয়মিত চাকরি ছেড়ে খণ্ডকালীন কাজ করতে বাধ্য হন। তবে ১৯৭২ সালে তিনি লাইফস্টাইল বিভাগের সহকারী সম্পাদক হিসেবে আবারও নিয়োগ পান।

তিনি বলেন, লাইফস্টাইল পাতায় কৃষ্ণাঙ্গদের সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার কিছু চিত্র তুলে ধরতে পারাটা সত্যিই আনন্দের ব্যাপার ছিল আমার জন্য। তখনও সাদা মানুষরা কৃষ্ণাঙ্গদের সংস্কৃতি সম্পর্কে তেমন কিছুই জানতো না। শুধু কিছু দায়িত্ববান ধনী ব্যক্তিরা হয়তো তাদের বাসার চাকর বা দারোয়ানদের সঙ্গে কথা বলে কিছুটা জানতে পারতেন।

ডরোথি তখন লোক নিয়োগ করার সুযোগও পান এবং এমন সাংবাদিকদের নিয়োগ দেন যারা কৃষ্ণাঙ্গদের জীবনযাত্রা সম্পর্কেও লিখতে পারেন। তারপর ১৯৭৯ সালে তিনি কলাম লেখা শুরু করেন। ১৯ বছর ধরে শিক্ষা, রাজনীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে কলাম লিখেছেন তিনি। ২০০৩ সালে তিনি ওয়াশিংটন পোস্ট থেকে অবসর নেন।

সাংবাদিক হিসেবে ৫০ বছরের ক্যারিয়ারে তার অর্জন অনেক। তিনি ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব ব্ল্যাক জার্নালিস্টস-এর সহ প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি ছিলেন। রবার্ট সি মেনার্ড ইনস্টিটিউটের একজন বোর্ড সদস্য তিনি। এই ইনস্টিটিউট হাজার হাজার কৃষ্ণাঙ্গকে সাংবাদিকতার প্রশিক্ষণ দিয়েছে।

(ওএস/এএস/আগস্ট ৩১, ২০২১)