আবু তালহা

দেশ হতে দেশান্তরে উড়োজাহাজ ছুটতো যার হাতের দক্ষতায় আর তিনি ফিরে এলেন নিশ্চুপ নিরবতায়। ককপিটের পাইলটের আসনে বসে নয় বরং কফিনে বন্দী মরদেহের বেশে চিরচেনা চির আপন হযরত শাহজাহাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। শোকার্ত ক্যাপ্টেনদের কাঁধে কফিনটি তখন আকাশ সমান ভারি। আবেগে আপ্লুত সহকর্মীরা রানওয়েতে দাড়িয়ে টুপি খুলে শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। আকাশপথে বিমানের ত্রুটি কিংবা নিজের অসুস্থতার মাঝেও যিনি যাত্রীদের নিরাপত্তাকেই সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়েছেন এমন পাইলটকে হারিয়ে পুরো বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস পরিবারের মাঝে নেমে এসেছে শোকের ছায়া।

অত্যন্ত মেধাবী ও সাহসী ক্যাপ্টেন নওশাদ মাত্র তিন দিনের জীবন যুদ্ধে হার মানলেন। ক্ষণস্থায়ী এই পৃথিবীতে মাত্র চুয়াল্লিশ বছর বয়সে বীরের বেশে চলে গেলেন না ফেরার দেশে।

মাত্র দুই যুগ কর্ম করে গেলেন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসে কিন্তু তার সদাচারণ, কর্মনিষ্ঠা ও সাহসিকতাই তাকে যুগের পর যুগ বাঁচিয়ে রাখবে।

এটা কোন সিনেমার গল্প নয় বাস্তব জীবনের গল্প । চৌকস এই ক্যাপ্টেনের বুদ্ধিমত্তায় রক্ষা পেয়ে যায় শত শত যাত্রী ও তার সহকর্মীরা। আর সেইসাথে প্রশংসার দাবিদার বিমানের ফার্স্ট অফিসার ও অন্যান্য ফ্লাইট ক্রুরা যারা বড় ধরনের দুর্ঘটনার সময় কিভাবে মাথা ঠাণ্ডা রেখে কাজ করতে হয় সেই সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন।

পরিশেষে ফ্লাইট এর ফার্স্ট অফিসার মোস্তাকিম পিয়াসের ব্যাপারে কিছু কথা না বললেই নয়, ফার্স্ট অফিসার মোস্তাকিম পিয়াস মূলত পর্দার অন্তরালে থাকা একজন প্রকৃত নায়ক। ভারতের রায়পুরের মাঝ আকাশে থাকাকালীন সময়ে ক্যাপ্টেন আতাউল কাইয়ুম নওশাদ হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। আর তখনই এই চৌকস ফার্স্ট অফিসার ককপিটের পুরো কন্ট্রোল নিয়ে নেন নিজের আয়ত্তে। অনতিবিলম্বে ঘোষণা করেন মেডিকেল ইমার্জেন্সি। দ্রুততম সময়ের মধ্যে নাগপুরের ডক্টর বাবাসাহেব আম্বেদকার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করাতে সক্ষম হন এই সুদক্ষ ফার্স্ট অফিসার। যিনি মাত্র চার বছর আগে বিমানে যোগদান করেছেন। বয়সের দিক দিয়ে একদম তরুণ হলেও সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে বিন্দুমাত্র কালক্ষেপণ করেননি। আমাদের প্রত্যাশা এই তরুণ পাইলট একদিন ক্যাপ্টেন নওশাদ এর মতো আরো যশ ও খ্যাতি অর্জন করবে। উনাদের মতো দক্ষ ক্যাপ্টেনদের এর জন্যই গড়ে উঠেছে আকাশে শান্তির নীড় Your Home In The Sky বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস।

ইতোপূর্বে ২০১৬ সালের ২২ ডিসেম্বর রাত তিনটার দিকে ওমানের মাস্কাট বিমানবন্দর থেকে দেড় শতাধিক আরোহী নিয়ে বোয়িং ৭৩৭-৮০০ এয়ারক্রাফটি নিয়ে চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওয়ানা দেয় কিন্তু বিমানটির উড্ডয়নের সময় একটি চাকা বিকট শব্দে ফেটে যায়। বিষয়টি ক্যাপ্টেন উপলব্ধি করার পর মাসকট বিমানবন্দরে আর সেটি জরুরি অবতরণ সম্ভব হচ্ছিল না। ঝুঁকির সম্ভাবনা আছে সেটি নিশ্চিত জেনেও বাংলাদেশের উদ্দেশে পাড়ি দেয় ক্যাপ্টেন নওশাদ। একটু এদিক সেদিক হলেই বড় ধরনের দুর্ঘটনায় কবলিত হতে পারত এয়ারক্রাফটি। প্রাণ যেতে পারত সব আরোহীর। তবে মহান আল্লাহর অশেষ রহমতে আর ক্যাপ্টেনের সাহসী ভূমিকায় দীর্ঘ পাঁচ ঘণ্টা পর ঢাকার মাটিতে অবতরণ করে বিমানটি। সে সময় ফার্স্ট অফিসার ছিলেন মেহেদী হাসান। এর স্বীকৃতি হিসেবে বৈমানিকদের আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অফ এয়ারলাইন্স পাইলট অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে পেয়েছিলেন সম্মাননা।

প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম যেন ক্যাপ্টেন নওশাদ এর জীবনী জানতে পারে সেজন্য এই ক্ষণজন্মা বীরের বীরত্বগাথা জীবনী যেন ঠাঁই পায় জাতীয় পাঠ্যপুস্তকে।

জন্মিলে মরিতে হবে অমর সে কোথা কবে, তবে তিনি বেঁচে থাকবেন যতদিন আকাশ পথ চালু থাকবে। চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন লাল সবুজের পতাকা বহনকারী ন্যাশনাল এয়ারলাইন্স বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের প্রতিটি কর্মীর হৃদয়ে।

সক্রেটিসকে যখন হেমলক বিষ দিয়ে হত্যা করা হয় ঠিক সেই সময় তার শিষ্যরা সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন অশ্রুসিক্ত নয়নে দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে তারা সক্রেটিসকে বিদায় জানাতে এসেছিলেন। তখন সক্রেটিস হাসিমুখে তার শিষ্যদের বলেছিলেন The soul of man cannot die. অর্থাৎ মানুষ মারা যাবে কিন্তু তার নামটা রয়ে যাবে। ঠিক তাই সক্রেটিসকে যে রাজা হত্যা করেছিলেন মানুষ তার নামটা পর্যন্ত জানে না। কিন্তু সক্রেটিস হয়ে আছেন চির অমর চির অম্লান।

প্রতিদিন শত শত মানুষ পৃথিবী থেকে বিদায় নিচ্ছেন কিন্তু কয়জনের সেই সৌভাগ্য আছে যাদের নাম ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে মুদ্রিত হয়। ক্যাপ্টেন নওশাদ ঠিক তেমনি একটি নাম যেটি সমগ্র জাতি ও দেশবাসীর মনে চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তাই বলতে হয় Heroes live forever.

লেখক-
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস।
গ্রাউন্ড সার্ভিস এসিস্ট্যান্ট।