রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : নির্যাতন চালিয়ে এক গৃহবধুকে হত্যার অভিযোগে স্বামীসহ পাঁজনের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলার ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন ও ভিসেরা  প্রতিবেদনে মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত  করতে না পারায় বাদিপক্ষের ন্যয় বিচার পাওয়া নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। মামলার তদন্তকাারি কর্মকর্তা এটি হত্যা নয় মর্মে দাবি করে সকল আসামীদের দু’ এক দিনের মধ্যে আদালতে চুড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিলের উদ্যোগ নিয়েছেন বলে আশঙ্কা করছেন।

এদিকে অপহরণ ও ধর্ষণ মামলায় জেল হাজতে থাকা স্বামীকে গ্রেপ্তার দেখানো হলেও চার মাসেও গ্রেপ্তার হয়নি মামলার অন্য চার আসামী। অভিযোগ আসামীরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ালেও পুলিশ তাদেরকে গ্রেপ্তার করছে না। এমনকি মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা বাদিকে তার ছোট মেয়ের সঙ্গে আসামী মশিয়ারের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে মামলা মিটিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন।

মামলায় চাঁদখালি ইউনিয়নের কালুয়া গ্রামের মশিয়ার রহমান সরদার, মশিয়ারের ভাই মহসিন সরদার, তার বাবা কামরুল ইসলাম সরদার, মা সানোয়ারা বেগম ও তাদের আত্মীয় চাঁদমুখী গ্রামের মোজাম সরদারের ছেলে মান্নান সরদারকে আসামী করা হয়।

মামলার বিবরনে জানা যায়, চলতি বছরের ১৭ জানুয়ারি গভীর রাতে নির্যাতন চালিয়ে খুলনা জেলার পাইকগাছা উপজেলার চাঁদখালি ইউনিয়নের কালুয়া গ্রামের এক ভাটা শ্রমিকের মেয়ে ও একই গ্রামের ব্যবসায়ি মশিয়ার রহমানের স্ত্রীকে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়। প্রভাব খাটিয়ে বিষয়টি আত্মহত্যার প্রচার দিয়ে ময়না তদন্ত ছাড়াই লাশ দাফন করা হয়। পরবর্তীতে হত্যার বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে গত ৪ মে মৃতের বাবা ভাটা শ্রমিক বাদি হয়ে পাইকগাছা থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। বিচারক এজাহারটি মামলা হিসেবে রেকর্ড করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পাইকগাছা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেন।

৬ মে মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা পাইকগাছা থানার উপপরিদর্শক তরুন কুমার দত্ত লাশ উত্তোলনের আবেদন ও জেল হাজতে থাকা মশিয়ারকে ৯ মে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাত দিনের রিমাণ্ড আবেদন জানান। আদালত লাশ উত্তোলনের পর ময়না তদন্ত প্রতিবেদন না পাওয়া পর্যন্ত রিমাণ্ড আবেদন শুনানী স্থগিত করেন। ৩১ মে কবর থেকে লাশ উত্তোলন করা হয়। ওই দিন এক কবরের পাশে এক বিশাল মানববন্ধনে আসামীরা প্রবাব খাটিয়ে ময়না তদন্ত প্রতিবেদন ও ভিসেরা প্রতিবেদন প্রতিবেদন পরিবর্তণ করতে পারে বলে আশঙ্কা করেন। এর কিছুদিন পর মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা পরিবর্তণ করে পাইকগাছা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (তদন্ত) স্বপন কুমার রায়কে দায়িত্ব দেওয়া হয়। সব মিলিয়ে মামলার চার মাসেও এজাহারভুক্ত চার আসামী গ্রেপ্তার হয়নি। তারা বর্তমানে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

অপরদিকে স্ত্রীকে হত্যার পর মশিয়ার রহমান শ্বশুর বাড়ির সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখে। গত ১১ এপ্রিল সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার গোয়ালডাঙা গ্রামের অসুস্থ শ্বাশুড়িকে দেখতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে কাটাবুনিয়ার একটি বাড়িতে আটক রেখে দু’দিন আটক রেখে শালিকাকে ধর্ষণ করে মশিয়ার। এ ঘটনায় ধর্ষিতার বাবা ভ্যানচালক বাদি হয়ে মশিয়ারের নাম উল্লেখ করে ২০ এপ্রিল পাইকগাছা থানায় পর্ণোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন তৎসহ ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের সংশোধিত ২০০৩ এ জিআর-১০৭ নং মামলা দায়ের করেন। ওইদিন পুলিশ মশিয়ারকে গ্রেপ্তার করে। এ মামলায় পুলিশ তাকে তিন দিন রিমাণ্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে।

পাইকগাছা থানার উপপরিদর্শক তাপস কুমার দত্ত মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা হিসেবে নিহতের বোনকে অপহরণকে ধর্ষণ মামলায় জেল হাজতে থাকা মশিয়ার রহমানকে স্ত্রী হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে ৬ মে লাশ উত্তোলন করার অনুমতি চেয়ে আদালতে আবেদন করেন। জ্যেষ্ট বিচারিক হাকিম পলাশ কুমার দালাল আবেদন মঞ্জুর করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য খুলনা জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেন। গত ৯ মে মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা একই আদালতে মশিয়ার রহমানকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাত দিনের রিমাণ্ড আবেদন জানান। মঙ্গলবার শুনানী শেষে লাশের ময়না তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর রিমাণ্ড শুনানীর জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। সে অনুযায়ি গত ৩১ মে লাশ উত্তোলন শেষে ময়না তদন্তের জন্য খুলনা ৫০০ শয্যা হাসপাতালে পাঠানো হয়।

একইসাথে ভিসরা প্রতিবেদনের জন্য পহেলা জুন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগে পাঠানো হয় মৃতদেহের বিশেষ অংশ বিশেষ। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসক ডাঃ নজরুল ইসলাম গত ১৬ জুন মৃতদেহের নমুনাগুলোতে কোন বিষ পাওয়া যায়নি মর্মে প্রতিবেদনে উল্লেখ করে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠান। সে অনুযায়ি খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের ডাক্তার বাপ্পা গৌতম, ডাঃ রাশেদ রবি ও ডাঃ লোপা সাহার সমন্বয়ে গঠিত মেডিকেল বোর্ড ওই নারীর মৃত্যু সম্পর্কে কোন মতামত দেওয়া গলে না বলে গত ৩০ জুন তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মামলার বর্তমান তদন্তকারি কর্মকর্তা পাইকগাছা থানার পুলিশ পরিদর্শক স্বপন কুমার রায় জানান, ময়না তদন্ত প্রতিবেন না পেয়ে মামলার কোন আসামীকে গ্রেপ্তার করা সঠিক হবে না বিধায় তিনি কোন আসামীকে গ্রেপ্তার করেননি। তবে মেডিকেল রিপোর্ট পর্যালোচনা শেষে এটি হত্যার বিপক্ষে গেছে বলে তিনি বিশেষজ্ঞদের কাছে জেনেছেন। সেই আলোকে তিনি খুব শ্রীঘ্রই আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করবেন। তবে বাদিকে তার ছোট মেয়ের সঙ্গে মশিয়ারের বিয়ে দিয়ে মামলা নিষ্পত্তি করতে বলার বিষয়টি অস্বীকার করেন তিনি।

(আরকে/এসপি/সেপ্টেম্বর ০৪, ২০২১)