আবীর আহাদ


গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মজলুম জননেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মুক্তিযুদ্ধের মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গতাজ তাজউদ্দিন আহমেদ ও বঙ্গবন্ধু-কন্যা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার ধারাবাহিক নেতৃত্বের বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আজ একটানা বহু বছর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। আওয়ামী লীগের সাথে এদেশের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অঙ্গীকার, অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক মুক্তি, বাঙালির জাত্যাভিমান, জাতীয় মর্যাদা ও গর্ব তথা গণমানুষের আশা-আকাঙ্খা জড়িত।

মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ এদেশের বৃহত্তম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ, বিশেষ করে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাণপ্রিয় রাজনৈতিক দল। সেই আওয়ামী লীগ, যে দলটির নেত্রী-নেতা-কর্মীরা দল ও দেশ পরিচালনায় দীর্ঘ সংগ্রাম ও অভিজ্ঞতায় পরিপূর্ণ। কিন্তু আজ বাস্তব দৃষ্টিতে বিচার-বিশ্লেষণ করলে, অতি পরিতাপের সাথে বলতে হয়, এতো অভিজ্ঞতা অর্জন করার পরেও দল ও দেশ পরিচালনা করতে তারা, বলা চলে, সীমাহীন ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে আসছেন!

আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব মনে হয় বুঝতেই পারছেন না, দল ও রাষ্ট্র পরিচালনায় কাকে কাকে কোথায় কোথায় বসাতে হয়! আজ তাদেরকে আত্মসমালোচনা ও আত্মশুদ্ধি করতে হবে যে, তাদের দলে ও সরকারে যাদেরকে গুরুত্বপূর্ণ পদ-পদবী দেয়া হয়েছে, তারা কারা, কী তাদের পরিচয়, কী তাদের ব্যাকগ্রাউন্ড, তারা কে কোথায় বসে কী করছে? দল ও সরকার এমন কী দেউলিয়ায় হাবুডুবু খাচ্ছে যে, এতো লক্ষ-কোটি নিবেদিতপ্রাণ ত্যাগী সৎ মেধাবী ও জাতীয় ক্ষেত্রে নানান অবদান রাখা আদর্শবান নেতা-কর্মী ও শুভানুধ্যায়ী থাকতে দলে ও সরকারে আওয়ামী আদর্শ ও চরিত্রবিরোধী লোকদের জামাই আদরে স্থান দিতে হবে?

আজ তৃণমূল পর্যায়ে দলটি প্রায় পুরোপুরি চলে গেছে তার এমপি-লীগের হাতে, যেখানে সরবে ঠাঁই পেয়েছে বিএনপি, জামায়াত, ছাত্রদল, শিবির, ফ্রিডমপার্টি, রাজাকার সন্তানসহ সমাজের অপরাধীচক্র ! আর প্রকৃত আওয়ামী লীগের কর্মী ও মুক্তিযোদ্ধা সন্তানরা তাদের কনুইয়ের গুঁতোয় দল থেকে ছিটকে পড়েছে। এ-অপকর্ম করতে এমপিদের বাধেনি, কারণ তারা অনেকেই ব্যবসায়ী, কালো টাকার মালিক, বা অন্য দল থেকে এসে বিপুল অর্থের বিনিময়ে মনোনয়ন লাভ করে এমপি হয়েছে। তারা আওয়ামী লীগ বা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কোনো ধার ধারে না। তারা এ দলে অর্থের বিনিময়ে এসে যেকোনো ভাবেই হোক অর্থ কামাই করে চলেছে। আওয়ামী লীগের দলীয় প্রতীক 'নৌকো'কে উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন পর্যায়ে দিয়ে দেয়ার ফলে ঐসব এমপিরা আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতা-কর্মীদের বাদ দিয়ে বিশাল এক মনোনয়ন বাণিজ্য ফেঁদে ভিন্ন দল বা অর্থওলাদের কাছে নৌকো প্রতীক বিক্রি করে দিয়েছে। ফলে তৃণমূলে আওয়ামী লীগ বলতে আছে এমপিদের বশংবদ সমর্থক ও দালাল লীগ ! তাদের পদভারে আওয়ামী লীগের আসল নেতা-কর্মীরা মাটির সাথে মিশে গেছে। এভাবে সারা দেশে, বলা চলে, আওয়ামী লীগ আজ সর্বস্তরের অপরাধীচক্রের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। ফলশ্রুতিতে সৎ মেধাবী ও ত্যাগী লোকদের পক্ষে দলটির রাজনীতি করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সবচেয়ে দুর্বিষহ জীবন যাপন করছে দেশের সূর্যসন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারবর্গ। বিশেষ করে বীর মুক্তিযোদ্ধারা আজ আওয়ামী লীগ, রাজাকার ও সুবিধাবাদীচক্রের প্রতিহিংসার পাত্র। তাদের জাতীয় বীরত্বের মর্যাদায় ভাগ বসিয়ে তাদের অবদানকে ঢেকে দেয়ার লক্ষ্যে অর্থ আত্মীয়তা ও রাজনৈতিক প্রভাবে সবাই বীর মুক্তিযোদ্ধা সাজার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। এমন একজনকে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীসহ এমন কতিপয়কে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের সদস্য করা হয়েছে, যাদের মূল কাজ হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা তালিকার ভুয়াদের রক্ষা করার পাশাপাশি যখন তখন যাকে তাকে মুক্তিযোদ্ধা বানানো। নিয়ম কানুন নীতি নৈতিকতার কোনো ধারই তারা ধারেন না। সরবে নিরবে অমুক্তিযোদ্ধাকে বানানোর মেশিন চালু রেখে মুক্তিযোদ্ধাই নন, সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, যিনি দেশের অতি ক্ষমতাশালী বলে ব্যাপক পরিচিত, তাকে স্বাধীনতার ৫০ বছর পর বেসামরিক গেজেটে বীর মুক্তিযোদ্ধা (!) বানিয়ে দেয়ার মতো জঘন্যতম কর্মটি করতে কারো বিবেকেও বাঁধেনি! অথচ এখনো প্রকৃত বেশকিছু বীর মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত হয়ে নিরবে সরবে চোখের জল ফেলছঃ। এমনকি গত বছর রাজাকার তালিকায় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নাম প্রকাশ করে, পরবর্তীতে কঠিন সমালোচনার মুখে পিছুটান দিয়ে বেআক্কেলের মতো মুবিমমন্ত্রী মহোদয় নিজেকে বেআক্কেল বলে তিরস্কার করলেও তিনি সমহিমায় বহাল তবিয়তে বসে এখনো মুক্তিযোদ্ধা তালিকার নামে অমুক্তিযোদ্ধাদের মুক্তিযোদ্ধা বানানোর অপকর্মের নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন। মাঝখান থেকে তার অপকর্মের দায়ভার গিয়ে পড়ছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ওপর!

দেশের মধ্যে আজকে যে সর্বগ্রাসী দুর্নীতি ও লুটপাটের হোলিখেলা চলছে, তার সঙ্গে যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত তারা কারা? হাতেগণা দু'চারজন দলীয় পুরনো ব্যক্তি ছাড়া, বাইরে থেকে, অর্থাত্ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধীরা দলে ও সরকারে স্থান করে-নেয়া লোকজনই এসব দুর্নীতি ও লুটপাটের সাথে জড়িত। সুইস ব্যাংক ও পানামাতে যেসব বাংলাদেশী লুটেরাদের বিপুল অর্থ গচ্ছিত রয়েছে বলে বিভিন্ন সময় দেশেবিদেশী মিডিয়ায় যাদের নাম ছাপা হয়েছে, তারা সবাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কারো নাম পাওয়া যায়নি । এসব অর্থ পাচারকারীরা অধিকাংশই এখন বর্তমান আওয়ামী লীগের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। এসব দেখে ও বুঝে এতোদিনেও কি আওয়ামী নেতৃত্ব বুঝতে পারছেন না যে, ঐসব দুর্নীতিবাজ আমলা লুটেরা মাফিয়া তথা অপরাধী চক্র আওয়ামী লীগের জন্য আশীর্বাদ, না অভিশাপ? এসব দুর্নীতিবাজ ও লুটেরাগোষ্ঠী কি দল ও রাষ্ট্রের চেয়েও অধিক শক্তিশালী যে, তাদেরকে দল ও সরকারের সাথে জড়িয়ে রাখতেই হবে? এসব দুর্নীতিবাজ আমলা লুটেরা মাফিয়া ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তির সাথে আওয়ামী লীগের এমন কী রাখী বন্ধন বাঁধা যে, তাদেরকে নিয়েই পথ চলতে হবে? জানি এসব প্রশ্নের জবাব কোনো দিনই পাওয়া যাবে না। কেনো পাওয়া যাবে না, তাও সহজে অনুমেয়।

এসব বিষয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে এখনি আত্মসমালোচনা ও আত্মশুদ্ধি করতে হবে। অন্যথায় আজ যে চাকচিক্যময়তা ও ক্ষমতার অন্ধত্বে তারা আবিষ্ট হয়ে আছেন, সবকিছুই রঙিন দেখছেন, কখন যে তা বালির বাঁধের মতো ধসে পড়বে সবকিছুই ফিকে হয়ে যাবে তা তারা ঘূর্ণাক্ষরেও টের পাবেন না!।

লেখক :মুক্তিযোদ্ধা লেখক গবেষক।