আবীর আহাদ


কুখ্যাত আলবদর কমাণ্ডার একাত্তরের যুদ্ধাপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা আলী আহসান মুজাহিদ যতোদূর মনে হয় ৭ম জাতীয় সংসদের পবিত্র অঙ্গনে দাঁড়িয়ে তাচ্ছিল্যের সাথে উচ্চকণ্ঠে বলেছিলেন, এ দেশে কোনো মুক্তিযুদ্ধ হয়নি! সংসদের ধারাবিবরণী ও সেসময়ের পত্রপত্রিকায় অনুসন্ধান করলে তার বক্তব্যটি নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। মাওলানা মুজাহিদের এ ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্যের উৎস নিহিত রয়েছে আমাদের জাতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনার ( Preamble of the Constitution) মধ্যে । যেমন, আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনার শুরুতে বলা হয়েছে :"আমরা বাংলাদেশের জনগণ ১৯৭১ খ্রীস্টাব্দের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়া জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক মুক্তিসংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করিয়াছি"।

দেশটা যে ঐতিহাসিক রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভ করেছে সেকথাটি নেই! এজন্যই আলবদর নেতা আলী আহসান মুজাহিদের মতো মানুষেরা সংবিধানদৃষ্টে ঠিকই বলেন যে, একাত্তরে যা ঘটেছিলো তা ছিলো গণ্ডগোলের বছর, পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ, ভাইয়ে ভাইয়ে যুদ্ধ, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ ইত্যাদি! ভাসুরের নামের মতো 'মুক্তিযুদ্ধ' বলে না! যেহেতু মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানী মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় মিত্রবাহিনী দেশটি স্বাধীন করেছিলো, এজন্য 'মুক্তিযুদ্ধ' শব্দটি বলা যাবে না এবং মুক্তিযুদ্ধের যোদ্ধা 'মুক্তিযোদ্ধদের' অবদানটুকুও স্বীকার করা হবে না! সংবিধানে জনগণ ও শহীদদের কথা থাকলেও মুক্তিযোদ্ধাদের কথা নেই! আমরা এ জন্য কাউকে দায়ী করছি না। আমরা বিষয়টিকে এভাবেই নিয়েছি যে, মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পর দেশকে সাংবিধানিক আইনের শাসনে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সংবিধান প্রণয়ন করতে যেয়ে হয়তো মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা শব্দদ্বয় সংবিধানে আসেনি। জাতীয় নিরিখে তা পরবর্তীতে সংবিধানে আনা যাবে না, সেটা তো হতে পারে না ! সংবিধান তো কোনো কোরানের বাণী নয় যে, তাতে হাত দেয়া যাবে না! ইতিমধ্যে বিভিন্ন প্রয়োজনে সংবিধানে অনেক সংযোজন সংশোধন বিয়োজন প্রভৃতি সাধিত হয়েছে।

সংবিধানে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা শব্দদ্বয়ের স্বীকৃতি না থাকার ফলে অহরহ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত হচ্ছে এবং মুক্তিযোদ্ধা নয়, এমন ব্যক্তিরা, এমনকি স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার আলবদররাও গোঁজামিলের সংজ্ঞার সুযোগে অর্থের বিনিময়ে, আত্মীয়তা প্রেমে ও রাজনৈতিক প্রভাব ও বিবেচনায় মুক্তিযোদ্ধা হয়ে যাচ্ছে। যেমন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী শম রেজাউল করিম এমপি, লে:কর্নেল মুহম্মদ ফারুক খান (অব:) এমপি, জহিরুল হক মোহন এমপি, জাতীয় পার্টির রুস্তম আলী ফারাজী, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মির্জা আব্বাস প্রমুখ মুক্তিযুদ্ধ না করেই ক্ষমতা ও অন্যান্য উপায়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা বনে গেছেন! বিশেষ করে সামরিক বাহিনীর সদস্য হয়েও নিয়মানুযায়ী সেনা গেজেটে মুক্তিযোদ্ধা না-হতে পেরে বেসামরিক গেজেটে মুক্তিযোদ্ধা খাতায় নাম লিখিয়ে লে: কর্নেল মুহম্মদ ফারুক খান ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন! ধন্য ফারুক খান, ধন্য জামুকার মহারথীরা! ধন্য মাননীয় মুবিমমন্ত্রী!

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু অবশ্য মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সঠিক সংজ্ঞা দিয়েছিলেন, যে সংজ্ঞাটি হলো : "Freedomfighter' means any person who had served as a member of any force engaged in the War of Liberation = মুক্তিযোদ্ধা মানে এমন একজন ব্যক্তি যিনি যেকোনো একটি সশস্ত্র বাহিনীর সাথে জড়িত থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন।" কিন্তু বঙ্গবন্ধুর তিরোধানের পর থেকে অদ্যাবধি জিয়া, এরশাদ, খালেদা-নিজামী এবং শেখ হাসিনা সরকার সেই সংজ্ঞাটিকে এড়িয়ে গেছেন। খালেদা-নিজামী সরকার বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞা পাশ কাটিয়ে গোঁজামিল দিয়ে প্রায় ৪০ হাজার অমুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকারদের মুক্তিযোদ্ধা বানিয়েছে, অপরদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ আরেকটি গোঁজামিলের সংজ্ঞায় প্রায় অনুরূপ সংখ্যক অমুক্তিযোদ্ধা এমনকি রাজাকারদের মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞার আলোকে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা কোনো অবস্থাতেই ১ লক্ষ ৫০ হাজার হবে না, কিন্তু বিএনপি-আওয়ামী লীগ মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বাড়িয়ে নির্ধারণ করেছে ২ লক্ষ ৩৫ হাজারেরও উর্দ্ধে! অর্থাৎ বিএনপি-আওয়ামী লীগ আশি/পঁচাশি হাজার অমুক্তিযোদ্ধাকে মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে দিয়েছে!

মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে আমরা একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পক্ষ থেকে সর্বপ্রথম ২০১৮ সালে সরকারের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাব রেখেছি যে, ইতিহাস ও জাতীয় গর্বের পবিত্রতার স্বার্থে সংবিধানের যথাযথ স্থানে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা শব্দদ্বয় সংযোজন করুন। পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞার আলোকে বিচার বিভাগ ও সামরিক বাহিনীর সমন্বয়ে মুক্তিযোদ্ধা কমিশন গঠন করে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়ন করা হোক, যাতে এ-বিষয়ে আর কোনো বিতর্কের সৃষ্টি না হয় । সেই থেকে দাবি দু'টি তথা ' (১)মুক্তিযোদ্ধাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও (২) ভুয়ামুক্ত মুক্তিযোদ্ধা তালিকা'র দাবি সর্বস্তরের সচেতন মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধাদের জাতীয় দাবিতে পরিণত হয়েছে। আজ কয়েকটি বছর এসব বিষয়ে বিস্তার লেখালেখি, আলোচনা সভা, সংবাদ সম্মেলন, সভা-সমাবেশ, অবস্থান কর্মসূচি এমনকি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে স্মারকলিপি পেশ করা হয়েছে কিন্তু সরকার লা-জবাব ! তাদের কিসের এতো দেমাগ, কিসের এতো ড্যামকেয়ার ভাব, তা আমাদের বোধগম্য নয়। সংগতকারণে বলতে হয়, যাদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের কোনোই সম্পর্ক নেই, আর আজকে যারা জীবনে যা কল্পনাও করেননি, তার থেকে অনেক বড়ো অবস্থানে উঠে এসেছেন, সেটি হয়েছেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের বদৌলতে। সেই বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধকে অবমূল্যায়ন করা হলে তার পরিণতি শুভ হবে না। মনে রাখতে হবে, প্রতিদিন ইতিহাস সৃষ্টি হচ্ছে এবং ইতিহাসের সেসব বৈশিষ্ট্য নিয়ে ইতিহাস সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে।

আমাদের ধারাবাহিক আন্দোলন ও লেখালেখির কারণে সরকার বিভিন্ন সময় মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কার্যক্রম পরিচালনা করলেও সরকারের মধ্যকার একটি মতলববাজ চক্র বাণিজ্যিক ধান্দার ফাঁদ পেতে ভুয়াদের পার করে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেছে। যারা ভুয়া সৃষ্টির মহাকারীগর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সেসব জেলা-উপজেলা কমাণ্ডারদেরকেই কমিটি বাণিজ্যের মাধ্যমে যাচাই বাছাই কমিটির সাথে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। ফলে ফলাফল যা হওয়ার তাই হয়েছে। ঐসব ভুয়ার কারিগররা অমুক্তিযোদ্ধাদের মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে দেয়ার সময় অর্থ খেয়েছে, তারাই আবার যাচাই বাছাই কমিটির সদস্য হয়ে নতুন করে বিপুল অর্থ নিয়ে সেসব ভুয়াদের রক্ষা করেছে। তাইতো পরপর চারপর্বের ঘোষিত তালিকা দেখে সহজেই বুঝা যাচ্ছে যে, মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অমুক্তিযোদ্ধা এমনকি রাজাকারদেরও যে সমাবেশ ঘটেছিলো তা বহাল থেকেই যাচ্ছে! এক্ষেত্রে সরকারেরও সদিচ্ছার চরম ঘাটতি রয়েছে। আমরা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা উচ্ছেদের জন্যে কার্যকরি পরামর্শ দিলেও সরকার তা আমলে নেয়নি! হয়তো সরকারের মধ্যকার কোনো গোপন গোপন সরকারের ইশারায় এমনটি হয়েছে। হয়তো সরকার মনে করছে, আসল মুক্তিযোদ্ধারা তো বটেই, যেহেতু সরকার ভুয়াদেরকে বীর মুক্তিযোদ্ধা খেতাবে ভূষিত রাখছে, ভাতাসহ অন্যান্য সুবিধাদি দিচ্ছে, তারই কৃতজ্ঞতাস্বরূপ ভুয়ারা সরকারের পক্ষেই থাকবে। সরকারের এ-ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। যারা বিপুল অর্থকড়ি খরচ করে মুক্তিযোদ্ধা সেজেছে, তারা হলো সমাজের সবচেয়ে বড়ো প্রতারক ও সুযোগ সন্ধানীচক্র, যাদের কোনোই আদর্শ নেই, চেতনা নেই। এরা যখন যেমন তখন তেমন চরিত্রের অধিকারী। বিশেষ করে এদের মধ্যে যে প্রায় ৪০ হাজার বিএনপি-জামায়াতের কর্মী রয়েছে তারা তো আর আওয়ামী সরকারকে পুজো করবে না! মাঝখান থেকে আওয়ামী লীগ সরকারও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা লালনকারী হিশেবেও গণ্য হচ্ছে। এতে করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জাতীয় মর্যাদার চরম ক্ষতি হচ্ছে। এসব কারণেই আমরা মুক্তিযোদ্ধা তালিকা থেকে ভুয়াদের উচ্ছেদের কথা বলে আসছি।

কিন্তু সরকার তবুও নট নড়ন-চড়ন ! তারা চোখ-কান বন্ধ রেখে তাদের গোয়ার্তুমি বহাল রেখেই চলেছে । বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞা পাশ কাটিয়ে নিজেদের সংকীর্ণ ব্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থ করার লক্ষ্যে তারা ভুয়া সংজ্ঞা তৈরি করে কয়েকটি বছর ধরে তারা যাকে-তাকে মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে চলেছে। অমুক্তিযোদ্ধাদের মুক্তিযোদ্ধা বানানোর অর্থ প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের বুকে তীর মারা, তাদের হৃদয়কে রক্তাক্ত করা, তাদের প্রতি নিষ্ঠুরতম উপহাস করা, তাদের মর্যাদাকে পদদলিত করা! জামুকা তথা সরকারের এসব ভাবসাব দেখে মনে হয় যেন, দাবি দু'টি উত্থাপন করে আমরা মহা-অন্যায় করে ফেলেছি ! অথচ আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে এ দাবি তুলেছি, যাতে ভবিষ্যতে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা সম্পর্কে কোনো বিভ্রান্তি ও বিতর্ক সৃষ্টি না হয়।

ঐতিহাসিকভাবে আওয়ামী লীগ হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের উদ্যোক্তা নেতৃত্ব। মুক্তিযোদ্ধারা আওয়ামী লীগের সৃষ্টি। আমরা এসব করতে যেয়ে বরং আওয়ামী লীগকেই মহিমান্বিত করতে চেয়েছি, যাতে ইতিহাসে আওয়ামী লীগের মুখ উজ্জ্বল থাকে, কিন্তু আওয়ামী লীগ সেটাকে তাদের ওপর খবরদারি করার মতো মনে করে আমাদের ন্যায্য দাবিকে কোনোরূপ পাত্তাই দিচ্ছে না! কিন্তু তাদের জানা উচিত, ইতিহাসে কাঠগড়া বলতে একটি আসন আছে। ইতিহাসের কাঠগড়ায় আমরা আওয়ামী লীগকে দেখতে চাই না।

লেখক : চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।