স্টাফ রিপোর্টার : বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে ডাকাত আখ্যা দিয়ে রোগী আটকে রাখার অভিযোগ উঠেছে সংসদে। এছাড়া চিকিৎসক, চিকিৎসাসেবা ও বেসরকারি হাসপাতাল নিয়ে সংসদে কঠোর সমালোচনা হয়। ডাক্তারদের রাজনীতি করা নিয়েও প্রশ্ন উঠে।

বুধবার (১৫ সেপ্টেম্বর) সংসদে Medical Colleges (Governing Bodies) (Repeal) Bill 2021 বাছাই কমিটিতে পাঠানো ও বিলটির সংশোধনী প্রস্তাবের ওপর আলোচনাকালে এসব সমালোচনা করেন জাতীয় পার্টি ও বিএনপির সংসদ সদস্যরা।

চিকিৎসকরা কেনো রাজনীতি করবেন সেই প্রশ্নও উঠে আসে তাদের বক্তব্যে। চিকিৎসার বিল দিতে না পারায় বেসরকরি হাসপাতালগুলো রোগী আটকে রাখে বলে তারা অভিযোগ করেন। পরে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সংসদ সদস্যদের বক্তব্যের জবাব দেন। দেশের নাগরিক হিসেবে রাজনীতি করার অধিকার সবার আছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

আলোচনাকালে জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, বিএনপি করে গিয়েছিল ড্যাব, আওয়ামী লীগ এসে করেছে স্বাচিপ। সেক্ষেত্রে আমরা কী কারণে বসে থাকছি? এই আইনের মধ্যে যদি উনি আনতেন যে ডাক্তার এবং বৈজ্ঞানিকরা রাজনীতি করতে পারবে না তাহলে খুব খুশি হতাম। কিন্তু সেটা আনা হয়নি। ডাক্তাররা যদি এই দেশে রাজনীতি করেন তাহলে আমরা কী করবো? আমাদের কাজটা কী? তারা চলে আসুক রাজনীতি করতে। তারা যদি রাজনীতি করেন তাহলে আমরা সেবা বঞ্চিত হচ্ছি।

বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদ বলেন, বর্তমানে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বেহাল দশা। দেশের পঞ্চশ বছর অতিক্রম করেছি। আমরা এখন পর্যন্ত সরকারি হাসপাতাল ও বেসরকারি হাসপাতালের মধ্যে কোনো পার্থক্য করতে পারিনি। যারা সরকারি হাসপাতালে কর্মরত তারাই বেসরকারি হাসপাতালের ব্যবসা করছেন।

তিনি বলেন, এতগুলো বেসরকারি মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছেন, এগুলো মানসম্মত? আজকে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ থেকে যারা শিক্ষা অর্জন করছেন তারা কয়জন বিসিএসে টিকছেন? ২০১৩ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত মেডিকেল কলেজে ভর্তির ক্ষেত্রে যে অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে এ ব্যাপারে কী ব্যবস্থা নিয়েছেন? যে ছাত্ররা অনিয়ম করে সেখানে ভর্তি হয়েছেন, সে ব্যাপারে সরকার বলেছিল এখানে কোনো অনিয়ম হয়নি। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে সিআইডি রিপোর্ট দিচ্ছে এখানে সাত বছর অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে।

বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য রুমিন ফারহানা বলেন, করোনাকালে অর্থনৈতিকভাবে কতগুলো পরিবার পঙ্গু হয়ে গেছে সেই খবর কী আমাদের কাছে আছে? করোনাকালে হাতে গোনা কিছু রিপোর্ট আসছে যেখানে দেখা যাচ্ছে, করোনায় সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় পড়ে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা না পেয়ে নিরুপায় হয়ে মানুষ বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়ে একেবারে সর্বশান্ত হয়ে গেছে।

তিনি বলেন, অনেকে প্রাণে হয়তো বেঁচে গেছেন কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু হয়ে গেছেন। জমানো টাকা শেষ হওয়া থেকে শুরু করে বিরাট ঋণের জালে আটকা পড়েছেন বহু মানুষ। করোনার আগে যেখানে মধ্যবিত্ত ছিল ৭০ শতাংশ সেখানে মধ্যবিত্ত নেমে দাঁড়িয়েছে ৫০ শতাংশ। দরিদ্র মানুষ যেখানে ছিল ২০ শতাংশ সেটা বেড়ে দাড়িয়েছে ৪০ শতাংশ। করোনাকাল বলে হয়তো এ ব্যাপারে মিডিয়ার কিছুটা মনযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু বেসরকারি মেডিকেলে গিয়ে সর্বশান্ত হওয়ার ইতিহাস নতুন কিছু নয়।

বিএনপির এই সংসদ সদস্য বলেন, করোনাকালে যে কয়টি বেসরকারি হাসপাতালের বিরুদ্ধে মানুষকে সর্বশান্ত করার অভিযোগ আসছে তার মধ্যে সব থেকে শীর্ষ আছে সরকার দলীয় একজন সংসদ সদস্যের হাসপাতাল এবং মেডিকেল কলেজ। এই দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সরকার ধীরে ধীরে বেসরকারি খাতে তার কর্মীদের হাতে এমনভাবে তুলে দিচ্ছে যে চট্টগ্রামে সিআরবি নামে যে জায়গাটি আছে, যেটিকে চট্টগ্রামের অক্সিজেন বলা হয় সেটিও নাকি এখন বেসরকারি হাসপাতাল করার জন্য জায়গা বরাদ্দ দেওয়া হবে। রেলওয়ের জায়গা বলতে তো কিছু নেই, সবই রাষ্ট্রীয় জায়গা। এই রাষ্ট্রীয় জায়গা বেসরকারি খাতে তুলে দেওয়া অত্যন্ত দুঃখজনক।

বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য মোশারফ হোসেন বলেন, চিকিৎসকরা রাজনীতি করছেন। আমরা রাজনীতি করি রাজনীতিবিদের জায়গায় থাকবো। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আইনশৃঙ্খলার জায়গায় থাকবেন। ডাক্তাররা ডাক্তারদের জায়গায় থাকবে। সেই জায়গাগুলোকে রিপেয়ার করা দরকার। বেসরকারি হাসপাতালগুলো যেভাবে মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে টাকা রোজগারের পথ খুলে নিয়েছে সেখানে মানুষগুলো নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছেন।

জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য মুজিবুল হক বলেন, অ্যাডমিন ক্যাডারের লোক, জজ বা পুলিশ ক্যাডারের লোক তারা তো চাকরি করে প্রাইভেট কোনো বিষয়ে কনসালটেন্সি করতে পারবেন না। বিসিএস অফিসার হয়ে তার ডিউটির পর যদি প্রাইভেট প্যাকটিস করেন সেক্ষেত্রে তার যে মূল কাজ সেটি ঠিক থাকে না। এটা দীর্ঘদিনের একটা সমস্যা। মন্ত্রীকে বলবো যদি উপকার করতে চান তাহলে ডাক্তারদের প্রাইভেট প্র্যাকটিস দয়া করে বন্ধ করার চেষ্টা করুন। জনগণের পয়সা দিয়ে তাদের বেতন দেবেন, তারা প্রাইভেট প্যাকটিস করবেন এটা আমরা করতে পারি না। ভর্তির জন্য বেসরকারি মেডিকেল কলেজ কয়েক লাখ টাকা নেয় আনঅফিশিয়ালি। অন্যায়ভাবে এত টাকা নিচ্ছে তারা।

তিনি বলেন, আমরা দেখি ঢাকা শহরে ইউনাইটেড, ল্যাবএইড এই সমস্ত হাসপাতালগুলো ডাকাত। এখানে দেখা যায়, যখন মানুষ চিকিৎসা করতে যায় তখন এক লাখ, দুই লাখ, দশ লাখ টাকা বিল করে তাদেরকে আটকে রাখে। মাননীয় মন্ত্রী আপনি একটা কমিটি করে বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসার জন্য নির্দিষ্ট রেট করে দেন। এগুলো বন্ধ হওয়া দরকার।

জাতীয় পার্টির পীর ফজলুর রহমান বলেন, বেসরকারি মেডিকেল ও হাসপাতালে চিকিৎসা করতে গিয়ে অনেক মানুষ নিঃস্ব হয়ে গেছেন। বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা ব্যয় নিয়ন্ত্রণে কোনো ব্যবস্থা নেই। টেকনোলজিস্টের ব্যাপক সংকট। অনেক মেশিন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

জবাবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহেদ মালেক তার বক্তব্যে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ওয়াদা দেশের প্রতিটি জেলায় মেডিকেল কলেজ হবে। সেটা পর্যায়ক্রমে হবে। সেই অনুযায়ী ৩৮টি মেডিকেল কলেজের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ধীরে ধীরে সব জেলায় হবে।

মন্ত্রী বলেন, ডাক্তারদের অ্যাসোসিয়েশন রয়েছে। স্বাচিপ, বিএমএ রয়েছে। রাজনীতিতো সবাই করতে পারে। প্রকৌশলী, আইনজীবীরা রাজনীতি করতে পারেন। সেই অনুযায়ী চিকিৎসকরা তাদের অ্যাসোসিয়েশন করলে, তাতে কোনো দোষ বা অন্যায় দেখি না। তারাতো সেবা দিচ্ছেন।

তিনি বলেন, বেসরকারি হাসপাতালগুলো করোনার সেবা দিয়েছে। সেখানকার চিকিৎসা ফি নির্ধারণে আমরা বৈঠক করছি। আশা করি সেটার সমাধান হবে।

মন্ত্রী আরও বলেন, বিমানবন্দরে পিসিআর ল্যাব স্থাপনের বিষয়ে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নিবে। আর বিমানবন্দর জায়গা দিবে। আমরা শুধু কারিগরি সহযোগিতা দেবো। আমরা শুনেছি দুই একদিনের মধ্যে বিমানবন্দরে পিসিআর ল্যাব স্থাপন করা হবে।

(ওএস/এসপি/সেপ্টেম্বর ১৫, ২০২১)