পীযূষ সিকদার : শওকত ওসমানের ওই ‘বাঁধ’ এ গল্প নিয়ে লেখা ‘বাঁধ’ দেখলাম বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর মূল মঞ্চে। ৩০ আগস্ট শনিবার ছিল শিল্পকলা একাডেমীর উদ্যোগে ৬৪ জেলার সাহিত্য নির্ভর নাটকের শেষ দিন। নাটকের সমস্যা-সম্ভাবনা, চলমানতা, অর্থায়ন ইত্যকার বিষয় নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন সব্যসাচি লেখক সৈয়দ শামসুল হক, গোলাম কুদ্দুছ, মামুনুর রশীদ, মান্নান হীরা, বিশ্বজিত ঘোষ, আখতারুজ্জামান প্রমুখ। সভাপতি ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর মহাপরিচালক লিয়াকত আলীর লাকী সমাপনী বক্তব্যের মধ্য দিয়ে ইতি টানেন ৮দিন ব্যাপী নাট্যোৎসবের। তারপর শুরু হয় নাটক ‘বাঁধ’। এর রচনা ও নির্দেশনায় ছিলেন মোহাম্মদ বারী।

নিয়ামত নগরের উত্তর ও দক্ষিনপাড়া পরস্পরের আজন্ম শত্রু। কেন এই শত্রুতা কেউ জানে না। কবে এই শত্রুতা তৈরী হয়েছিল উত্তর ও দক্ষিণ পাড়ার মানুষের মধ্যে তা নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। তবু দম্ভের অহঙ্কারে শত্রুতা চলে অহর্নিশ। দ্বন্দ্বময় জীবনের দ্বান্দ্বিক ব্যাখ্যাই উঠে এসেছে এ নাটকে। যদিও ঐক্যের শক্তিই এ নাটকের সারকথা। নদীবর্তী বাঙালি জনপদের প্রকৃতির সাথে লড়াই-সংগ্রামের ছবি এ নাটকের মূল সুর। প্রকৃতি থেকেই শিক্ষা নিয়ে ঐক্যের শক্তিতে বলিয়ান হয়ে শেষ পর্যন্ত মুক্তির জয়গান গেয়েছেন, তাইতো সলি মাদবরের কণ্ঠে উচ্চারিত হয়...খামাখা কাটাকাটি মন কষাকষি। বলা যায় সলিম চরিত্রটি নাটককারের বিবেক হয়েই নাটকে ঢুকে পড়েছে। সমস্যা, মোকাবেলা, সমাধান তারই হাত ধরে এগিয়েছে। ফজল চরিত্রের মধ্যে যার পূর্ণতা পায়। বানের জল ফজলের স্ত্রীকে কেড়ে নেয়। ফজলই মূলত এই প্রজন্মের প্রতিনিধিত্ব করে। সেও দক্ষিণ পাড়ার সাথে বিরোধ পোষে। কিন্তু স্ত্রী বিয়োগের মধ্য দিয়ে সে এক মহাজীবনের সন্ধ্যান পায়। যেখানে উত্তর দক্ষিণ বলে কিছু নেই। বাম ডান বলে কিছু নেই। প্রকৃতির সাথে বেড়ে ওঠা ফজল তাই মানুষে মানুষে ঐক্যের মধ্যেই মুক্তি খোঁজে। তাইতো দেখি বানের জলে উত্তর পাড়ার সব ভাসিয়ে নিয়েছে বাড়িঘর, বসতভিটা কিন্তু ফজল নিয়ামতনগর সমিতির সাইনবোর্ডটি ভেসে যেতে দেয়নি। নিজের জীবন তুচ্ছ করে সাইনবোর্ডটি সে তুলে এনেছে। এইখানেই নাটকের মধ্যে আরেক নাটক বিমূর্ত থেকে মূর্ত হয়ে উঠেছে। আব্বাস চরিত্রটিও আমাদের সমাজের চেনা চরিত্রের মধ্যে অন্যতম। সে ফজলের বন্ধু। বন্ধুকে সে ভালবাসে কিন্তু কোনদিকে যাবে সে বুঝতে পারে না! তাই তার কোনো সিদ্ধান্তও নেই। এ দলে না ওই দলে- শেষ পর্যন্ত আব্বাস কিনার পায়, যখন সে দেখে বাঁধ ভেঙ্গে গেলে আমার অস্তিত্বও সঙ্কটময় হবে। তাই সে হাত দেয় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বাঁধ রক্ষার কাজে।

‘বাঁধ’ নাটকটি একটি বাঁধ দেয়াকে উপজীব্য করে উত্তর দক্ষিণ পাড়ার মধ্যে আজন্ম যে কাটকাটি মারামারি তাকে দমন করার জন্য সঙ্কটসময়ে বাঁচার তাগিদে উত্তর দক্ষিণের শত্রুতার অবসানের নাটক। ঐক্যের মন্ত্রে যার পরিসমাপ্তি বানের জলে ভেসে যাওয়া পিঁপড়াদের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে ঐক্যের মত্ একটি অসাধনকে সাধন করতে পারে! সেই সাধনমন্ত্রই যেন নির্দেশক আমাদের কানে কানে বলে দেন। এ জীন দীক্ষামন্ত্রও। আসলেই ঐক্যের পথ ছাড়া কোনো গতিও নেই জাতির যে কোনো সঙ্কটকালে।

শওকত ওসমানের ‘ওই বাঁধে’ গল্পটির সলিম মাদবর চরিত্রটি ছাড়া একুশটি চরিত্র নতুন সৃজিত। এমনকি বলা যায়, সলিম মাদবর চরিত্রটিও নাটককার মোহাম্মদ বারীর হাতের ছোঁয়ায় ভিন্নতা এসেছে। এ ক্ষেত্রে নাটককার বলেন, “শওকত ওসমান বেঁচে থাকলে আমাকে তিরষ্কার নাকি পুরস্কৃত করতেন জানি না, তবে উত্তর প্রজন্মের নগন্য নাট্যকর্মী হিসেবে তাঁর কাছে ক্ষমা ও আশীর্বাদ প্রার্থনা করি”।

‘বাঁধ’ নাটকটিতে নির্দেশক অনেক সিরিয়াসভাবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। কখনো সরাসি কখনোবা হাসির দমকে দমকে বুকফাটা আর্তনাদ থেকে সরিয়ে রেখেছেন আমাদেরকে অতি সচেতনভাবে। আবার গানের মধ্য দিয়ে অন্ধ বাউলের কণ্ঠেও যেন সেই মুক্তির গানই জুড়ে দেন নির্দেশক । কখনোবা আমাদেও রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের নিয়ে স্যাটায়ার করতে ভুলেননি। ভুলেননি নারী অধিকারের বিষয়টিও।

সলিম মাদবর চরিত্রে তৌফিকুল ইসলাম ইমনের অভিনয় নৈপুন্য বোধ করি দর্শকের মন কেড়েছে। ফজল চরিত্রে এ. কে আজাদ সেতু দারুণ অভিনয় করেছেন। মঞ্চে মঞ্চে ওঁর প্রসার ঘটুক। আব্বাস চরিত্রে এহসানুর রহমানের অভিনয় মনে রাখবার মতো। ওঁর চলায়-বলায়, নিরবতায়, স্তব্ধতায় ওঁর সরব অভিনয় মুগ্ধ করেছে। ময়না চরিত্রে কান্তা জামান অসাধারণ অভিনয় শৈলী দেখিয়েছেন। পারুল চরিত্রে মেরিনা মিতু প্রতি পদবিক্ষেপে বচন কুশলতায় ভিন্নতার ছাপ রেখেছেন। সত্যি কথা বলতে কি, সবার অভিনয় দক্ষতা দর্শককে টেনেছে। মঞ্চ, আলো, আবহ সঙ্গীত, পোষাক, কোরিওগ্রাফি সব মিলিয়ে একটি বাস্তববাদী স্ব-কালের নাটক উপহার দিয়েছেন মোহাম্মদ বারী, আমাদেরকে। নাটক দেখতে দেখতে আমার কেমন জানি উপদেশমূলক নাটক মনে হচিছল! মনে হচ্ছিল নাটকটিতে নির্দেশক প্রজ্ঞার ঝাঁপি খুলে বসেছেন! কিন্তু নাটকের মোহ যখন কাটলো, ঘুম যখন ভাঙলো তখন মনে হলো এ উপদেশ নয়, এ যেন শিক্ষা। প্রকৃতি থেকে শিক্ষা। মহাপ্লাবনে ভেসে যাওয়া পিঁপড়ার দল থেকে শিক্ষা। তাইতো উপদেশ বলে ভ্রম কাটে। ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই। এই মানুষের ভেতরেই আছে আরেক মহাজীবন। ‘বাঁধ’ তাই হয়ে ওঠে মহাজীবনের ঐক্যের মন্ত্রপীঠ।

লেখক : অভিনেতা।

Email: [email protected]

Mobile: 01762193378