নাটোর প্রতিনিধি : নাটোরের চলনবিল অধ্যুষিত সিংড়া উপজেলায় পৌরসভা কর্তৃক নির্মিত প্রায় সোয়া কোটি টাকা ব্যয়ের বাস টার্মিনাল এখন নেশাখোরদের অভয়াশ্রমে পরিনত হয়েছে। এছাড়া টার্মিনাল ভবনটি রিক্সা,কার-মাইক্রোবাস সহ বিভিন্ন যানবাহন চালক ও মালিক সমিতির অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, পৌর কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও গাফিলতির কারণে প্রায় দেড় কোটি টাকা পানিতে ফেলা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, সিংড়া-বগুড়া মহাসড়ক যানজট মুক্ত রাখতে সিংড়া পৌরসভা ২০১০-১০ অর্থবছরে ১কোটি ২০লাখ টাকা ব্যয়ে মহাসড়ক সংলংগ্ন এলাকায় একটি বাসটার্মিনাল নির্মান করে।

২০১১সালের ২জুলাই বাস টার্মিনালটি উদ্বোধন করা হয়। টার্মিনালটি উদ্বোধনের পর আন্তজেলা সহ অভ্যন্তরিন রুটের বাস সহ অবৈধ নসিমন-করিমন মহাসড়ক থেকে সরিয়ে টার্মিনালে ঢুকিয়ে যাত্রি ওঠানো নামানো হয়। কিন্তু ক’মাস পর আবারও মহাসড়কের ওপর দাঁড়িয়ে যাত্রি ওঠানো-নামানো শুরু হয়। ফলে সোয়া কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত বাস টার্মিনালটি অব্যবহৃত অবস্থায় গত প্রায় দু’বছর ধরে পড়ে রয়েছে। অব্যবহৃত টার্মিনালে ট্রাক,কার- মাইক্রেবাস ও রিক্সা ভ্যান সহ বিভিন্ন হালকা যানবাহন রাখা শুরু হয়। এইসব যানবাহন যত্রতত্র রাখার কারনে টামিনালে নোংরা পরিবেশের সৃষ্টি হয়।

এদিকে টার্মিনালটি অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকায় টার্মিনালের ভেতরে বখাটে ও নেশাখোরদের আনাগোনা বেড়ে যায়। রাত-দিন প্রকাশ্যে চলে তাদের নেশার আড্ডা। সুযোগ বুঝে কার-মাইক্রেবাস চালক ও মালিক সমিতির নামে টার্মিনাল ভবনের বিভিন কক্ষ অফিস হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

সম্প্রতি ভবনের যাত্রিদের বসার একটি কক্ষে উপজেলা রিক্সা চালক সমিতির অফিস হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে রিক্সা-ভ্যান চালক শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারন সম্পাদক ও জাতীয় শ্রমিক লীগের উপজেলা সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম জানান, তাদের সমিতির অফিসটি ভেঙ্গে পড়ায় টার্মিনালের অব্যবহৃত একটি কক্ষ অস্থায়ীভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। সমিতির নিজস্ব ঘরটি মেরামত করা হলে অফিসের মালামাল সরিয়ে নেওয়া হবে। তিনি টার্মিনালে মাদকসেবী সহ জুয়ারু ও বখাটেদের উৎপাতের সত্যতা স্বীকার করে জানান,এবিষয়ে জানানোর পর স্থানীয় প্রশাসন মাঝে মধ্যে অভিযান চালালেও তাদের দৌরত্ব কমছেনা। সড়কের ধারে নির্মিত যাত্রি ছাউনিও অবৈধ দখলদারদের কবলে চলে গেছে। ইতিপুর্বে টার্মিনালটি পুনরায় চালু করে মহাসড়ক যানজট মুক্ত রাখা সহ টার্মিনাল ও যাত্রি ছাউনী থেকে অবৈধ দখলদারদের অপসারনের জন্য উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে লিখিত দাবী জানানো হয়েছে।

এদিকে দীর্ঘদিন ধরে বাস টার্মিনাল অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকায় আসবাবপত্র সহ ভবন ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে । এছাড়া মহাসড়কের ওপর যাত্রী ওঠানামার কারণে নিয়মিত যানজট লেগে থাকছে। যানজটের কারনে প্রায়ই ছোটখাটো দুর্ঘটনা ঘটছে। যাত্রি ছাউনী অবৈধ দখলের কারনে খোলা আকাশের নিচে বৃষ্টিতে ভিজে, রোদে পুড়ে বাসে ওঠানামা করতে যাত্রীদের চরম ভোগান্তি সহ দুর্ভোগ পোহাতে হয়।


রবিবার সরেজমিন গেলে সিংড়া বাসস্ট্যান্ডে কথা হয় বাস যাত্রী শিল্পি খাতুন ও শামসুল আলমের সাথে। তারা জানান, সার্বক্ষনিক যান চলাচল করায় মহাসড়কের পাশে দাড়িয়ে থাকা ঝুঁকিপূর্ণ। মহাসড়কে পাশে অবৈধভাবে নির্মিত দোকান পাটের কারনে দাঁড়ানোর জায়গা পাওয়া যায়না। রাজশাহী, চাঁপাই,খুলনা, কুষ্টিয়া, বরিশাল, বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর, গাইবান্ধাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যাতায়াতে এই মহাসড়ক ছাড়া বিকল্প কোন পথ নেই। তাই এ মহাসড়কটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু নাটোর-বগুড়া মহাসড়কের সিংড়া বাজার এলাকায় মহাসড়কটি দীর্ঘদিন থেকেই বাসস্ট্যান্ড হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। গুরুত্বপূর্ণ এই মহাসড়কের ওপর যাত্রী ওঠানামার কারণে নিয়মিত যানজট লেগে থাকে। স্কুলগামী ছাত্র -ছাত্রীদের ঝুঁকি নিয়ে সড়ক পারাপার হতে হয়।

স্থানীয়দের অভিযোগ,যাত্রিদের সুযোগ সুবিধাসহ যানবাহন নিয়ন্ত্রণ এবং টার্মিনাল রক্ষানাবেক্ষনের নামে প্রতিদিন পৌরসভার নামে বিভিন্ন যানবাহন থেকে টোল আদায় করা হয়। টোল আদায়ের জন্য চলতি বছরে ৫ লাখ টাকায় টার্মিনাল ইজারা দেওয়া হয়েছে। অথচ যাত্রিদের সুযোগ সুবিধার কোন ব্যবস্থা নেই। যাত্রি ছাউনি নির্মান করা হলেও তা অবৈধ দখলের কারনে যাত্রিরা ব্যবহার করতে পারেনা। এসব দখল মুক্ত করে টার্মিনালটি দ্রুত চালুর দাবি জানান তারা।

স্থানীয় রিক্সা ভ্যান, সিএনজি ও ইজিবাইক চালকরা জানান, বাস মালিক সমিতির দাপটের কারনে বাস টার্মিনালটি পরিপূর্ণভাবে চালু করা যাচ্ছে না। তবে স্থানীয় লোকাল বাস চালকরা জানায়, রাস্তার ধারে গড়ে ওঠা অবৈধ দোকান এবং ঢাকার লোকাল বাসগুলো সড়কের ওপর দীর্ঘসময় দাঁড় করিয়ে যাত্রি ওঠানোর জন্য যানজটের সৃষ্টি হয়। টার্মিনালটি চালুর মুল প্রতিবন্ধক ব্যাটারি চালিত ইজিবাইক ও থ্রিহুইলার। টার্মিনালের ভেতরে বাস প্রবেশ করালেই রাস্তা থেকে ব্যাটারি চালিত ইজিবাইক ও থ্রিহুইলার সিএনজি গাড়িতে যাত্রী উঠিয়ে নিয়ে যায়। ফলে তারা যাত্রী পান না। এসব অবৈধ যান বাসস্ট্যান্ড এলাকা থেকে আপসারণ করা হলে বাস চালকরা টার্মিনাল ব্যবহার করবেন।


সিংড়া পৌরসভার প্যানেল মেয়র আদনান মাহমুদ টার্মিনাল ইজারা দেওয়ার সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, নানা ভাবে তাগিদ দিয়েও বাস চালকদের টার্মিনালমূখী করা যায়নি। চালকরা নিজেদের ইচ্ছেমতো মহাসড়কেই বাস রাখেন। বাস মালিক সমিতির দাপটের কারনে পরিপূর্ণভাবে বাসস্ট্যান্ডের কার্যক্রম পরিচালনা করা যাচ্ছে না। ইতিপুর্বে তাদের দাবীর প্রেক্ষিতে ব্যাটারি চালিত ইজিবাইক ও থ্রিহুইলার সিএনজি সহ বেশ কিছু অবৈধ যান বাসস্ট্যান্ড এলাকা থেকে অপসারণ করা হয়।

এই সময় টার্মিনালটি চালু হয়। কিন্তু কিছুদিন পর আবার পুর্বের অবস্থায় ফিরে আসে। এই সময় বিদ্যুৎ বিলও পরিশোধ করা হয়নি। বিদ্যু সংযোগ না পাওয়ার কারণে নির্মানের প্রায় এক বছর পর টার্মিনালটি চালু করা হয়। টার্মিনালটি বর্তমানে অরক্ষিত থাকায় মাদক সেবীদের আনাগোনা বাড়ে। তবে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন মাঝে মধ্যেই হানা দিয়ে মাদক সেবীদের আটক করে। অযত্নে পড়ে থাকা ঘর নিজেরাই পরিস্কার করে রিক্সা সমিতি অস্থায়ীভাবে একটি ঘর ব্যবহার করছে। তাদের ভেঙ্গে পড়া অফিস ঘর মেরামত হলেই তারা তাদের অফিস গুটিয়ে নিবে।

সিংড়া থানার ওসি শফিকুল ইসলাম জানান, প্রায় প্রতিদিনই টার্মিনাল এলাকায় অভিযান চালানো হয়। গত একমাসে অভিযান চালিয়ে ৫০ জন মাদকসেবীকে আটক করা হয়। এদের মধ্যে ৩৭ জনকে ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে জেল-জরিমানা করা হয়েছে। টার্মিনাল এলাকায় অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

(এমআর/এএস/সেপ্টেস্বর ১১, ২০১৪)