অরিত্র কুণ্ডু, ঝিনাইদহ : ঝিনাইদহে সামাজিক কর্মসূচির টাকা বিশেষ করে বিধবা, বয়স্ক ও প্রতিবন্ধিদের টাকা ‘নগদ’ একাউন্ট থেকে উধাও হয়ে গেছে। একাউন্ট হ্যাক করে কে বা করা হতদরিদ্রদের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এদিকে টাকার শোকে হতদরিদ্ররা আহাজারি করলেও কোন প্রতিকার পাচ্ছে না। প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির টাকা হ্যাক করার পর সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসুচির কোটি কোটি টাকা হ্যাক করে উঠিয়ে নেওয়া হলো। কিন্তু এ ব্যাপারে নগদ ও সমাজসেবা অধিদপ্তরের গড়িমসির কারণে শহর ও গ্রামাঞ্চলে শত শত বিধবা, প্রতিবন্ধি ও বয়স্ক ব্যক্তিদের মাঝে হা-হুতাশ বাড়ছে। তথ্য নিয়ে জানা গেছে, চলতি বছরের মার্চ এপ্রিল মাসে ঝিনাইদহে প্রাইমারির প্রায় শাতাধিক শিক্ষার্থীর উপবৃত্তির টাকা প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া হয়। সেই টাকা আজো উদ্ধার হয়নি।শনাক্ত করা যায়নি প্রতারক চক্রকে। প্রতারকদের প্রাইমারির মিশন সফল হওয়ার পর তাদের নজর পড়ে সমাজসেবার সামাজিক নিরাপত্তা খাতে প্রদেয় শিক্ষা উপবৃত্তি, বিধবা, বয়স্ক ও প্রতিবন্ধি ভাতার উপর। 

শৈলকূপা উপজেলার ফুলহরি গ্রামের হাসি রানী অভিযোগ করেন, তিনি নতুন ভাতাভোগী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। কিন্তু প্রথম কিস্তির টাকা তিনি পাননি। নগদ একাউন্ট চেক করে দেখেন তার টাকা কে বা কারা হ্যাক করে তুলে নিয়েছে। ফুলহরি ইউনিয়নে হাসি রানীর মতো অনেকের টাকা হ্যাক করে উঠিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ করেন ঝিনাইদহ জেলা পরিষদের সদস্য অনিতা বিশ্বাস।

ঝিনাইদহ পৌর এলাকার কালিকাপুর গ্রামের ফারজানা আফরিন এ্যানী জানান, অহসায় প্রতিবন্ধি হিসেবে তিনি প্রতিমাসে ভাতা পেয়ে আসছেন। তিনি নগদ একাউন্ট খোলার পর তার নগদ ০১৯৬৯১৯০১৪৩ নাম্বারের সাড়ে চার হাজার টাকা প্রতিবন্ধি ভাতা আসে। কিন্তু উক্ত টাকা গত ৯ জুলাই কে বা কারা ০১৯০৬৪৯৩৩৯১ নাম্বারে ট্রান্সফার করে নেয়। এ ঘটনায় তিনি ১৯ আগষ্ট ঝিনাইদহ সদর থানায় একটি জিডি (যার নং ৯৯২) করেছেন। কিন্তু এখনো টাকা ফিরে পাননি।

তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, উন্নত তথ্য প্রযুক্তির যুগে হ্যাকারদের চিহ্নিত করা কি খুব কঠিন কাজ ? তাহলে কেন টাকা উদ্ধার হচ্ছে না। এই হ্যাকিংয়ের সঙ্গে কারা জড়িত ? ফারজানা আফরিন এ্যানীর ঝিনাইদহের ৬ উপজেলায় এ ভাবে শত শত নগদ একাউন্ট হ্যাক করে উপবৃত্তি, বিধবা, বয়স্ক ও প্রতিবন্ধি ভাতার টাকা তুলে নেওয়া হচ্ছে।

ঝিনাইদহ জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, সারা জেলা থেকে এ রকম শত শত অভিযোগ পাচ্ছি, কিন্তু তাদেরকে কোন সহায়তা দিতে পারছি না। তথ্য নিয়ে জানা গেছে সারা জেলায় মোট ভাতাভোগীর সংখ্যা ১ লাখ ১৬ হাজার ৭৬২ জন। এর মধ্যে প্রতিবন্ধি শিক্ষা উপবৃত্তি পান ১১৬৬ জন, বয়স্ক ভাতা পান ৫৭ হাজার ৫৬৩, বিধবা ভাতা পাচ্ছেন ২৯ হাজার ৪২৭ ও প্রতিবন্ধি ভাতা পাচ্ছেন ২৮ হাজার ৬০৬ জন।

ঝিনাইদহ জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আব্দুল্লাহ আল সামি জানান, সারা জেলা থেকে কত জনের নগদ একাউন্ট থেকে টাকা হ্যাক করে উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে তার কোন সঠিক পরিসংখ্যান আমাদের কাছে নেই। তবে কোন কোন উপজেলায় ৫% থেকে ১০% টাকা হ্যাকিংয়ের শিকার হতে পারে।

তিনি বলেন, ঝিনাইদহ পৌরসভা এলাকার বিভিন্ন পাড়া মহল্লার ১৩৬ জন বয়স্ক, ৪ জন বিধবা, ২৩ জন প্রতিবন্ধি ও ৪ জনের শিক্ষা উপবৃত্তির টাকা তাদের নগদ একাউন্ট থেকে উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে। এই টাকার পরিমাণ প্রায় ৪৭ লাখ বলে তিনি জানান।

উপজেলা সমাজসেবা অফিসারদের ভাষ্য, অনেক ভাতাভোগীর একাউন্ট খোলার আগেই টাকা উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে। এটা কি ভাবে সম্ভব প্রশ্ন তোলেন তারা।

তথ্য নিয়ে জানা গেছে, নগদ এর নিজস্ব কোন দক্ষ কর্মী দিয়ে ভাতাভোগীদের একাউন্ট করেনি, করেছে পারটাইম কর্মীরা। একাউন্ট খোলার পর গোপন পিন নাম্বার ওই পারটাইম কর্মীদেরই জানা ছিল। দেশের সংঘবদ্ধ চক্রের সঙ্গে যোগসাজস করে তারাই এই হ্যাকিংয়ের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে বলে সমাজসেবার মাঠকর্মীদের ধারণা। জেলা সমাজসেবা অফিসের হিসাবমতে ২০২০-২০২১ অর্থ বছরে চতুর্থ কিস্তির টাকা শৈলকূপায় ১২ জনের, সদর উপজেলায় ১৭ জনের, কালীগঞ্জে ৭ জনের, হরিণাকুণ্ডুতে ১৪ জনের ও ঝিনাইদহ পৌরসভায় ১৫২ জনের উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে।

এছাড়া দ্বিতীয় কিস্তির টাকা শৈলকূপায় ১৪ জনের, কোটচাঁদপুরে ৫ জনের, ঝিনাইদহ সদর উপজেলায় ১৮ জনের, মহেশপুর উপজেলায় ১৫৯ জনের, কালীগঞ্জে ২৮ জনের ও হরিণাকুণ্ডুতে ৪৯ জনের নগদ একাউন্ট থেকে লোপাট হয়েছে। এই হিসাব সমাজসেবা অধিদপ্তরে লিখিত ভাবে জানানো হলেও ভাতাভোগীরা কোন প্রতিকার পাচ্ছেন না।

বিষয়টি নিয়ে ঝিনাইদহ জেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা আব্দুল লতিফ শেখ জানান, নগদ একাউন্ট খোলার পর নগদ কর্মীদের দেওয়া গোপন পিন নাম্বার দিয়ে একাউন্টে প্রবেশ করতে পারেনি ভাতাভোগীরা। সমাজসেবা থেকে এমন অভিযোগ অধিদপ্তরে দিলে সব গোপন পিন ‘অটো রিসেট’ করে দেওয়া হয়। পরে ভাতাভোগীরা গোপন পিন রিসেট করে দেখেন তাদের একাউন্টের টাকা আগেই তুলে নেওয়া হয়েছে।

ওই কর্মকর্তা জানান, ঝিনাইদহ থেকে ঠিক কত জনের টাকা নগদ একাউন্ট হ্যাক করে তুলে নেওয়া হয়েছে তার সঠিক হিসাব নেই। তবে আমরা প্রাথমিক ভাবে এক হাজার ভাতাভোগীকে সনাক্ত করতে পেরেছি। তাদের তালিকা সমাজসেবা অধিদপ্তরকে দিয়েছি। সেখান থেকে নগদ কর্তৃপক্ষের কাছে গেছে। তিনি বলেন, টাকা উদ্ধারের কোন সুখবর তার কাছে নেই।

(একে/এসপি/সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২১)