অহিদুজ্জামান কাজল, মাদারীপুর : মাদারীপুর সদর উপজেলার ‘৬৯নং উত্তর বিরঙ্গল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। শিশু বান্ধব অনন্য এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। রঙ তুলির আঁচড়ে বাঙালির সকল স্বাধিকার আন্দোলন ও অর্জনসহ ইতিহাস সমৃদ্ধ ও নানা বর্ণে সুসজ্জিত করে তোলা হয়েছে। কোমলমতি শিশু শিক্ষার্থীদের মন আকৃষ্ট করার জন্য বিদ্যালয়ের প্রতিটি কক্ষ ও দেওয়ালে অঙ্কণ করা হয়েছে ভাষা আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধের নানা স্মৃতিময় চিত্র। শুধু তাই নয় বিদ্যালয়ের সামনে নির্মাণ করা হয়েছে শেখ রাসেল কচিকাঁচা সড়ক ও বঙ্গবন্ধু পুষ্পকানন। বিদ্যালয়ের প্রবেশ দ্বারে একটি দৃষ্টিনন্দন গেট নীলকন্ঠ ফুল গাছের লতায় আকর্ষনীয় করে তোলা হয়েছে। নবনির্মিত বিদ্যালয় ভবনের শ্রেণিকক্ষসহ বিভিন্ন স্থানে পবিত্র কোরআন, আল-হাদিস, শ্রীমদ্ভগবদ গীতা, বেদ, উপনিষদ, মুনি, ঋষি ও সাংস্কৃতিক মনীষীদের অমরবাণী, ইংরেজী ও বাংলা বর্ণমালা এবং আল্পনা এঁকে জেলায় সাড়া জাগিয়েছেন। প্রাক-প্রাথমিকের কক্ষটি আরো দৃষ্টিনন্দন। দ্বিতল ভবনের সিড়ির দুই পাশে সাটিয়ে দেয়া হয়েছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি। এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধ কর্নার, বঙ্গবন্ধু কর্নার, জাতীয় স্মৃতি সৌধ, শহিদ মিনারসহ বিভিন্ন দৃশ্য এঁকে শিক্ষার্থীদের মন প্রফুল্য করা হয়েছে। বিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু পুষ্পকানন, আল্পনা ও অমর বানী দেখার জন্য বিভিন্ন স্থানের লোকজন নিয়মিত আসছেন। বিদ্যালয়টি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য সার্বক্ষণিক কাজ করে যাচ্ছেন প্রধান শিক্ষক দীপা রানী মন্ডল। বঙ্গবন্ধু পুষ্পকাননে রোপন করা হয়েছে শিউলি, বেইলি, হাসনাহেনা, গোলাপী রঙ্গন, লাল রঙ্গন, রক্ত জবা, ঝুমকা জবা, পুনে জবা, টগর, মিনি টগর, সকাল-সন্ধ্যা, গন্ধরাজ, মৌচন্দ্রা, বেগুনি চেরি, মনুন্দা, বাগান বিলাস, গাঁদাসহ বিভিন্ন প্রজাতির ফুলের গাছ। এছাড়াও তিনি ফলজ ও বনজ বৃক্ষের চারা রোপন করেছেন কৃতিত্বের দাবীদার সৌখিন প্রধান শিক্ষক দীপা রানী মন্ডল।

সরেজমিন গিয়ে এবং খোঁজ-খবর নিয়ে জানা গেছে, নদী বেষ্টিত সদর উপজেলার ধুরাইল ইউনিয়ন। আডিয়াল খাঁ নদীর ভাঙ্গা গড়ার খেলায় ইউনিয়নটির মানচিত্র পাল্টে গেছে একাধিকবার। ইউনিয়নটিকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে রেখেছে আড়িয়াল খাঁ নদী। এক সময় যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল নৌকা। উচ্চ শিক্ষা তো দূরের কথা, প্রাথমিক শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত ছিল এ ইউনিয়নের কোমলমতি শিক্ষার্থীরা। তাই অবহেলিত এই অঞ্চলে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে ১৯৪৩ সালে উত্তর বিরঙ্গল (জালালপুর) গ্রামের মনোহর মন্ডল ও তাদের পরিবার স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য ৩৩ শতাংশ জমি দান করেন।

এই জমির উপরই প্রতিষ্ঠা করা হয় প্রাথমিক শিক্ষার বাতিঘর একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়। শুরু থেকে আজ দীর্ঘ ৭৮ বছর ধরে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে ইউনিয়নের হাজারও শিক্ষার্থীকে উচ্চ শিখরে দাঁড় করিয়ে ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই বিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া করে এ অঞ্চলের অসংখ্য ব্যক্তি সচিব থেকে শুরু করে উচ্চ পদস্থ পদে চাকুরী করেছেন এবং এখনও উচ্চপদে অনেকে চাকুরীতে কর্মরত আছেন। শিক্ষার আলোয় উদ্ভাসিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির অবকাঠামো উন্নয়ন ও লেখা পড়ার মান উন্নয়ন দেখে উচ্চসিত এ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও এলাকাবাসী। মনের মাধুরী দিয়ে স্কুলটি সাজিয়ে তোলায় প্রধান শিক্ষকের প্রশংসা শোনা গেলো সকলের মুখে মুখে।

বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রী দীপা রানী মন্ডল। তিনি এই বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে রাজৈর উপজেলার বাজিতপুর ইউনিয়নের রাজকুমার এডওয়ার্ড ইনস্টিটিউশন থেকে মাধ্যমিক পাস করে ১৯৯৩ সালে একই ইউনিয়নের দাসেরচর রেজিঃ বেসরকারি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুর করেন। তিনি দীর্ঘ ২৫ বছর দাসেরচর রেজিঃ বেসরকারি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শেষে ২০১৮ সালে তার নিজ অধ্যয়নকৃত বিদ্যালয়ে বদলী হয়ে আসেন এবং ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।

তিনি বিদ্যালয়টির অবকাঠামো ও শিক্ষার মান উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের কারণে দীর্ঘ প্রায় দেড় বছর বন্ধ ছিলো। করোনার দাপট কমতে শুরু করলে গত ১২ সেপ্টেম্বর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার আগে তিনি বিদ্যালয়ের কক্ষগুলো একাধিকবার পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করেছেন। বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক শওকত আলীকে নিয়ে নিজ হাতে বিদ্যালয়ের শ্রেণি কক্ষ থেকে শুরু করে পুরো ভবনটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করেন। সরকারের নির্দেশিত শতভাগ স্বাস্থবিধি মেনে বিদ্যালয়টি পরিচালিত হচ্ছে।

বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র অর্ক মন্ডল জানায়, দেড় বছর পর বিদ্যালয়ে আসতে পেরে খুব ভালো লাগছে। বিদ্যালয়ের মনোরম দৃশ্য দেখে আরো ভালো লেগেছে। আমরা মাস্ক পড়ে নিয়মিত বিদ্যালয়ে আসছি এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্যারেরা ক্লাস করাচ্ছেন।

বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র ও ম্যানেজিং কমিটির সাবেক সভাপতি হাজী সুলতান হোসেন মাতুব্বর বলেন, ‘৬৯নং উত্তর বিরঙ্গল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি হচ্ছে ঐতিহ্যের ধারক-বাহক। বিদ্যালয়ের অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি এই বিদ্যালয়েরই প্রাক্তন ছাত্রী প্রধান শিক্ষক (ভারপ্রাপ্ত) দীপা রানী মন্ডলের অক্লান্ত পরিশ্রমে বিদ্যালয়টি শিক্ষার মনোরম পরিবেশে পরিনত হয়েছে। আমি এই ব্যতিক্রমধর্মী উদ্যোগের জন্য প্রধান শিক্ষককে অভিনন্দন জানাই।’

বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র আওয়ামী লীগ নেতা মোঃ হাবিবুর রহমান হাওলাদার বলেন, ‘বিদ্যালয়টি ৭৮ বছর ধরে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে আসছে। বর্তমান প্রধান শিক্ষক দীপা রানী মন্ডল তার ভালবাসা দিয়ে বিদ্যালয়টিকে নতুন আঙ্গিকে সাজিয়ে সকলের মন আকৃষ্ট করেছেন।’

বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি আহাদুজ্জামান মৃধা জানান, বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দীপা রানী মন্ডলের অক্লান্ত পরিশ্রমে বিদ্যালয়টি মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক (ভারপাপ্ত) দীপা রানী মন্ডল বলেন, ‘আমি একজন শিক্ষক। আমার দায়িত্ব ও কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করছি। এক সময় আমি এই বিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলাম। বিদ্যালয়ের হাজারো শিক্ষার্থী দেশের বিভিন্ন স্থানে উচ্চ পদে আসীন আছেন। বিদ্যালয়টির ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য কাজ করে যাচ্ছি। আমার স্বপ্ন ছিল বিদ্যালয়টিকে মনের মতো সাজানোর। সেই আলোকেই কাজ করে যাচ্ছি।’

মাদারীপুর সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ওবাইদুর রহমান খান বিদ্যালয়টি পরিদর্শনে এসে বিদ্যালয়ের দৃষ্টিনন্দন দৃশ্য, বঙ্গবন্ধু পুষ্পকানন ও শেখ রাসেল কচিকাঁচা সড়ক দেখে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন এবং প্রধান শিক্ষকের এ ধরণের ব্যতিক্রমধর্মী উদ্যোগের ভূয়সী প্রশংসা করেন।

(ওকে/এসপি/সেপ্টেম্বর ২৩, ২০২১)