তারেক হাবিব, হবিগঞ্জ : হবিগঞ্জ শহরের বুক চিরে বয়ে যাওয়া আন্তঃ সীমান্ত খোয়াই নদীর দুই পাশে অবৈধ দখলের প্রভাব বিস্তার দিনের পর বেড়েই চলছে। দখলদার প্রভাবে অস্তিত্ব হারাতে বসেছে ঐতিহ্যবাহী পুরাতন খোয়াই নদী। 

নদীর উৎস অনুসন্ধানে জানা যায়, ভারতের ত্রিপুরার আঠারমুড়া পাহাড় থেকে উৎপত্তি হয়ে নদীটি সিলেটের বাল্লা নামক স্থান দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে এ নদী। নদীটি হবিগঞ্জ জেলার পূর্বপ্রান্ত দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মেঘনা নদীতে গিয়ে মিশেছে।

উইকিপিডিয়া থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, নদীটির দৈর্ঘ্য ৯১ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ১০৬ মিটার। হবিগঞ্জের দুঃখ হিসেবে পরিচিত খোয়াই নদীকে শহর বাঁচাতে স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে ১৯৭৮-৭৯ সালে শহর থেকে প্রায় ১ কিলোমিটার বাইরে নেওয়া হয়। এরপর থেকে নদীর শহরের অংশ পরিচিত হতে থাকে ‘পুরাতন খোয়াই নদী’ নামে। সত্তর দশকের শেষে নদী বাইরে নিয়ে যাওয়ার এরপর থেকে পুরাতন খোয়াইয়ের দুই পাড় দখলদারদের কূনজরে পড়ে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড হবিগঞ্জ-এর তথ্য মতে, হবিগঞ্জ শহর রক্ষার জন্য ৭০-এর দশকের শেষে মাছুলিয়া-রামপুর ও খোয়াই মুখ-গরুর বাজার পর্যন্ত দুই দফায় ৫ কিলোমিটার লুপ কাটিংয়ের মাধ্যমে খোয়াই নদীর গতি পরিবর্তন করে শহরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত করে দেওয়া হয়। ২০১৬ সালে হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসনের এক হিসেবে দেখা গেছে, শহরের মাছুলিয়া থেকে হরিপুর পর্যন্ত পুরাতন খোয়াই নদীর দৈর্ঘ্য ৪ কিলোমিটার। আর অবৈধ দখলদারের সংখ্যা প্রায় ৬ শতাধিক।

সরেজমিনে নদী ও তার আশ-পাশ এলাকা ঘুরে দেখা যায়, নদীর দুইপাশ দখল করে বাড়ি-ঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে তুলেছেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা। মাঝে মধ্যে জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা ব্যাপক তোড়জোর নিয়ে মাঠে নামলেও সামান্যতম উদ্ধার অভিযানে বর্তমানে অজ্ঞাত কারনে থমেক আছে উদ্ধার অভিযান।

এদিকে, হবিগঞ্জবাসীর বহুদিনের স্বপ্ন পুরাতন খোয়াই নদীকে দখলমুক্ত করে নান্দনিক প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে না বলে জানা গেছে। খোয়াই নদী ও পুরাতন খোয়াই নদী নিয়ে প্রস্তাবিত ২ হাজার কোটি টাকার মেঘা প্রকল্প থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে পুরাতন খোয়াই নদীর অংশ। গত বছরের শেষ দিকে ‘হবিগঞ্জ জেলার খোয়াই রিভার সিস্টেম উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্প নিয়ে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় এই অংশটি বাদ দেওয়া হয়। এতে করে হতাশা দেখা দিয়েছে হবিগঞ্জবাসীর মাঝে।

হবিগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, এক হাজার ৯৫৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘হবিগঞ্জ জেলার খোয়াই রিভার সিস্টেম উন্নয়ন’ প্রকল্পটি প্রস্তাব করে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়। প্রক্রিয়াকরণ শেষে অনুমোদন পেলে ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে এটি বাস্তবায়নের লক্ষ্য রয়েছে। কিন্তু পরিকল্পনা কমিশনের আপত্তির মুখে পুরাতন খোয়াই নদীর ২ দশমিক ৩১ কিলোমিটার খনন ও সংরক্ষণ বাবদ ৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা, পাঁচটি ব্রিজ নির্মাণের জন্য ২৪ কোটি টাকা, একটি পাম্প হাউজ নির্মাণে ১৮ কোটি টাকা, সাড়ে চার কিলোমিটার প্রতিরক্ষা কাজের জন্য ১৫ কোটি টাকার প্রস্তাব বাদ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া প্রকল্পে চার দশমিক ৬৩ কিলোমিটার ড্রেন, ওয়াক ওয়ে ও ফেন্সিং নির্মাণে সাড়ে ২৭ কোটি টাকা, ৫০টি কমিউনিটি গ্রোথ সেন্টার ও রিক্রিয়েশন এরিয়া নির্মাণে ৩৯ কোটি টাকার প্রস্তাব বাদ দেওয়া হয়েছে এতে স্বপ্নভঙ্গ হয়ে গেছে জেলাবাসীর।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন বাপা হবিগঞ্জ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল সোহেল বলেন, পুরাতন খোয়াই নদী দখলমুক্ত করার জন্য আমরা দীর্ঘদিন যাবৎ আন্দোলন করে আসছি। হবিগঞ্জ শহরকে বাচানোর জন্যই এই নদী উদ্ধার প্রয়োজন। জেলা প্রশাসন উচ্ছেদ অভিযান শুরু করলে রহস্যজনক কারণে তা বন্ধ রয়েছে। পুরাতন খোয়াই নদী নিয়ে গৃহিত প্রকল্প বাস্তবায়ন না করা হলে সেটিকে আর রক্ষা করা যাবে না।

বাপার আজীবন সদস্য ও শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জহিরুল হক শাকিল বলেন, পুরাতন খোয়াই নদী দখলমুক্ত করলেই হবে না। এটিকে নিয়ে প্রস্তাবিত নান্দনিক প্রকল্পও বাস্তবায়ন করতে হবে। হবিগঞ্জ শহরকে বাচাতে এই প্রকল্পের বিকল্প নেই।

হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক ইশরাত জাহান জানান, মূল প্রকল্পে যাতে জেলা পুরাতন খোয়াই নদীর বাদ দেয়া অংশ পুনর্বিবেচনা করা হয় তার জন্য জেলা প্রশাসন থেকে চেষ্টা চালানো হচ্ছে।

(টিএইচ/এসপি/সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২১)