আবীর আহাদ


ঐতিহাসিক দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের অনিবার্য ধারায় শুভ-অশুভের পরস্পরবিরোধী অবস্থান সুস্পষ্ট। এ অবস্থার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ চ্যাপটারেও চলছে অশুভশক্তির বিরুদ্ধে শুভশক্তির নিরন্তর নীরব লড়াই। এ লড়াইয়ের ক্রমধারাবাহিকতায় শুভশক্তির ঐক্যাবস্থান দৃশ্যমান না হলেও শ্রমজীবী মেহনতি ও সাধারণ মানুষের অবচেতন মনে ঠিকই একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তনের আকাঙ্খা বিরাজ করছে, যা ক্রমান্বয়ে জাগ্রত হচ্ছে।

আপাত: সুপ্ত শুভশক্তির নীরবতার সুযোগ নিয়ে রাষ্ট্রশক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় দুর্নীতিবাজ লুটেরা ধর্মান্ধ ও মাফিয়া অপশক্তি সমাজের সর্বত্র দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। অশুভশক্তির পুঁজির বিকৃত কার্যক্রমের ফলশ্রুতিতে নীতি-নৈতিকতা, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক মূল্যবোধে ঘটছে সীমাহীন বিপর্যয়। অন্যায় মিথ্যাচার নিষ্ঠুরতা ও নৃশংসতা সমাজের বুকে জেঁকে বসেছে। মানুষের মধ্যে শ্রদ্ধাবোধ, দয়ামায়া, সহমর্মিতা ও সম্প্রীতির চরম বিপর্যয় ঘটেছে। সুদূর অতীত থেকে চলে-আসার পথপরিক্রমায় সমাজও দু'টি শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। Have & Have not শোষক ও শোষিত = ধনী ও দরিদ্র।

সমাজ-রাষ্ট্র যখন সংখ্যায় ক্ষুদ্র ধনিক ও ব্যাপক দরিদ্রে পর্যবসিত হয়, তখন পরস্পরবিরোধী উভয় শ্রেণীর নিরাপত্তার বিষয়টিও কিন্তু অনিবার্যভাবে বিঘ্নিত হয়ে পড়ে। তাই নির্দ্বিধায় বলা যায়, যে সমাজে ব্যাপক মানুষের জীবনের আশা-আকাঙ্খা ও আর্থসামাজিক নিরাপত্তা থাকে না, সে-সমাজে ক্ষুদ্র শোষক-ধনিকগোষ্ঠীরও নিরাপত্তা থাকে না। এমনি একটি অনুভবের কথা আমরা একদা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইজেন হাওয়ারের বক্তব্য থেকেও জানতে পারি । তিনি বলেছিলেন : If a free society cannot help the poor who are much, it cannot save the rich who are few.

কারণ ব্যাপক দরিদ্র মানুষের জাগরণের মধ্যেই ক্ষুদ্র ধনিকগোষ্ঠীর মৃত্যুবাণ নিহিত। এজন্য সংখ্যায় ক্ষুদ্র ধনিক শোষকশ্রেণী তাদের কর্তৃত্ব প্রবহমান রাখার লক্ষ্যে নানান পন্থায় বিশেষ করে সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে তাদের পক্ষে মাঠে নামিয়ে দেয়। কারণ ব্যাপক সাধারণ শ্রমজীবী দরিদ্র মানুষের আদর্শ হয়ে থাকে সমাজতন্ত্র। আর তাদের ঐক্যের সোপান হয় ধর্মনিরপেক্ষতা।

গণবিরোধী লুটেরা শাসক-শোষকদের নিত্যসঙ্গী সাম্প্রদায়িক মোল্লাতন্ত্র ঠিক এখানেই ধর্মের কুঠার আঘাত হানে। ধনিক শোষকদের অর্থশক্তিতে বলীয়ান হয়ে ধর্মীয় মোল্লারা নানান সভা সমাবেশ জলসা ধর্মসভা প্রভৃতি জনসমাবেশে শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের পক্ষে কিছু নীতিকথা আউড়ে তাদের মন জয় করার একটা কৌশল অবলম্বন করে। তারা তাদের পক্ষে মেকী সমবেদনা জানানোর জন্য ধর্মগ্রন্থ ও ধর্মীয় সমাজের ইতিহাস থেকে কিছু মানবিক গল্পকথা তুলে ধরে । যেমন, কোনো একটা উদাহরণ দিয়ে বলে, শ্রমিকের গায়ের ঘাম শুকিয়ে যাওয়ার পূর্বেই তাদের পারিশ্রমিক প্রদান করলে বহু সওয়াব পাওয়া যায়। এ ধরনের কিছু মানবীয় উদাহরণ দিয়েই তারা অতি কৌশলে শ্রমজীবী মানুষের আদর্শ সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে কুফরি মতবাদ, নাস্তিকতার দর্শন বলে বিষোদগার করে থাকে। সমস্ত ধর্মীয় সমাজ তারস্বরে এভাবে সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, বিজ্ঞান, তর্কশাস্ত্র, দর্শন প্রভৃতি মতবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার ফলে বিশাল অজ্ঞ ও অর্ধশিক্ষিত শ্রমজীবী সাধারণ মানুষ বিপুলভাবে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। ফলে ধর্মের বেড়াজালের কারণে তাদের মধ্যে সহজে আদর্শিক ঐক্য গড়ে উঠতে পারে না। শ্রমজীবী সাধারণ মানুষের মধ্যকার অনৈক্যের সুযোগ নিয়ে ধনিক শোষকশ্রেণী এভাবেই তাদের শাসন ও শোষণ নিরুদ্বিগ্নে চালিয়ে যাওয়ার মওকা পেয়ে যায়।

তবে এটাই শেষ নয়। ধনিক শোষকশ্রেণী যতোই তাদের অপশাসন ও শোষণকার্য পরিচালনা করুক না কেনো, তাদের সীমাহীন ভোগবিলাস ও বল্গাহীন লুটপাটের প্রেক্ষিতে শ্রমজীবী সাধারণ মানুষ ভেতরে ভেতরে প্রতিবাদ মুখর হওয়ার কোনো এক পর্যায়ে কোনো শুভ রাজনৈতিক শক্তির নেতৃত্বে সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব ভেঙে দুর্বারগতিতে শোষকশ্রেণীর মারণাস্ত্র মাড়িয়ে রাজপথে বেরিয়ে এলেই শোষক-প্রতারক শ্রেণীর পতন ঘটে। পৃথিবীর বহু দেশে এ-ধরনের শ্রমজীবী মানুষের বৈপ্লবিক কর্মধারার উদাহরণ রয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের বুকে আরেকটা উপদ্রব সৃষ্টি হয়েছে। সেটা হলো ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। আর এ ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাও সৃষ্টির পশ্চাতে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও গণবিরোধী শাসক ও সুযোগ সন্ধানীদের একধরনের পরশ্রীকাতরতা ও প্রতিহিংসা। মুক্তিযোদ্ধা কারা এ ফয়সালা স্বয়ং মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই ১৯৭২ সালেই দিয়ে গেছেন। মুক্তিযুদ্ধের কৃতিত্বের সিংহভাগ অধিকারী সাধারণ দরিদ্র পরিবার থেকে আগত বীর মুক্তিযোদ্ধারা। এসব তারা মানতে রাজি নয়। তাই বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞাকে পাশ কাটিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সরকার সরকারের সাথে জড়িত, নিজেদের দলীয় ও আত্মীয়স্বজনদের মুক্তিযোদ্ধা বানানোর লক্ষ্যে নানান গোঁজামিলের সংজ্ঞা আবিষ্কার করার ফলশ্রুতিতে সেগুলির ফাঁকফোকর গলে পরবর্তীতে অর্থ আত্মীয়তা ও রাজনৈতিক বিবেচনায় যে-সে মুক্তিযোদ্ধা বনে যাচ্ছে। এ প্রক্রিয়ায় প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধারা অপমানিত ও অবমূল্যায়িত হচ্ছেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাও পদদলিত হচ্ছে। এসবের প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের বুকে মুক্তিযোদ্ধা ও ভুয়ামুক্তিযোদ্ধার দ্বন্দ্ব ও সংঘাত সৃষ্টি হয়েছে। যদিও এখন বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বয়স, আর্থসামাজিক ও সামাজিক অবস্থান তাদের অনুকূলে নয়, তবুও মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত সমাজশক্তি ক্রমান্বয়ে তাদের চেতনাকে জাগ্রত জনগণের কর্ণকূহরে প্রবেশ করতে পেরেছেন। তারই ফলশ্রুতিতে সচেতন জনগণও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠছেন। সেদিন বেশি দূরে নয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত জনগণই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের পিটিয়ে তাদের ভবলীলা সাঙ্গ করে দেবে। সুতরাং আজ ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের দাপট ও দৌরাত্ম দেখে হতাশ হবার কিছু নেই। ক্রিয়ার সমপ্রতিক্রিয়া অনিবার্যভাবেই সংঘটিত হবে। কেউ তা রোধ করতে পারবে না।

উপসংহারে এটাই বলা যায়, মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ সমাজে যেভাবে এক সর্বগ্রাসী দুর্নীতিবাজ লুটেরা ধর্মান্ধ মাফিয়া অশুভশক্তির প্রতিবিপ্লবী তাণ্ডব চলছে, সেই প্রতিবিপ্লবী তাণ্ডবের প্রতিক্রিয়ায় সাধারণ মানুষের মধ্য থেকে অবলীলাক্রমে শুভশক্তির উদ্ভব ঘটবেই। আজ যেমনি ব্যাপক দরিদ্র-শোষিত মানুষের জীবনের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে, কাল তেমনি ক্ষুদ্র ধনিক-শোষক-প্রতারক শ্রেণীর নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবেই। এটাই ঐতিহাসিক দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের সার কথা।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা লেখক গবেষক।