শেরপুর প্রতিনিধি : ‘আমাদের আওয়ামী লীগের এখন বেড়াছেড়া অবস্থা। দলে কোন শৃঙ্খলা নেই। দলে আছি কি নেই কিছুই বুঝতে পারছি না। কোন সভাও হচ্ছেনা।’ কথাগুলো বলছিলেন নালিতাবাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক সরকার গোলাম ফারুক। কিছুদিন আগে দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে উপজেলা নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ায় উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হালিম উকিলকে দলীয় পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এর আগেই সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান কৃষিবিদ বদিউজ্জামান বাদশাকে কেন্দ্রীয় কৃষক লীগ থেকে বহিস্কার করা হয়।

তার বিরুদ্ধে অভিযোগ-দলীয় প্রার্থী মতিয়া চৌধুরীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। আর এবার স্বেচ্ছায় নালিতাবাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদকের পদ থেকে অব্যাহতি নিলেন মুকছেদুর রহমান লেবু। তিন প্রভাবশালী নেতার অব্যাহতি-বহিস্কা ঘটনায় নালিতাবাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের মধ্যেকার দীর্ঘদিনের অভ্যন্তরীন দ্বন্দ্ব, চাপা ক্ষোভ-অসন্তোষই যেন ফুটে ওঠেছে।

শারীরিক অসুস্থতা আর নিজের দলের নেতা-কর্মীদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থতার কারণ দেখিয়ে দলীয় পদ থেকে স্বেচ্ছায় অব্যাহতি নিলেন শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোকছেদুর রহমান লেবু। ডাকযোগে প্রেরিত মোকছেদুর রহমান লেবুর অব্যাহতি পত্রটি ১২ সেপ্টেম্বর শুক্রবার বুঝে পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন দলের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক শহীদ-উল্লাহ তালুকদার মুকুল। এর আগে গত ৩০ এপ্রিল বুধবার শেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভায় দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে উপজেলা নির্ভাচনে প্রার্থী হওয়ায় নালিতাবাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল হালিম উকিলকে তার পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। তারও আগে গত ফেব্রুয়ারী মাসে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান বিদিউজ্জামান বাদশাকে কেন্দ্রীয় কৃষক লীগ থেকে বহিস্কার করা হয়। সেসময় বাদশা’র পক্ষে উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির ৬৭ নেতার মধ্যে ৪২ জন বাদশার পক্ষে নির্বাচনে অংশ নেন। বাদশাকে বহিস্কার করলেও অন্য ৪২ জনের বিরুদ্ধে কোন সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। কিন্তু তাদেরকে দলীয় কোন কার্যক্রমেও অদ্যাবধি ডাকা হয়নি। ওইসব নেতাকর্মীরাও দলের কোন কার্যক্রমের সাথে নিজেদের জড়িত করতে পারছেন না। এনিয়ে হ-য-ব-র-ল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে নালিতাবাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগে।

দলীয় সূত্রগুলো জানায়, সম্প্রতি শেষ হওয়া নালিতাবাড়ী উপজেলা পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নালিতাবাড়ী উপজেলার আওয়ামী রাজনীতিতে বিশৃংখলা দেখা দেয়। উপজেলা নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী হিসেবে মুকছেদুর রহমান লেবু প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও আরেকজন বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ায় বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীর নিকট তারা পরাজিত হন। নির্বাচনের পরপরই দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ায় উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ থেকে আব্দুল হালিম উকিলকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এতে দলের কমান্ডিং ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ায় নেতাকর্মীরা এলোমেলো হয়ে পড়ে।

শুধু তাই নয়, দলের অনেক নেতাকর্মী পুলিশি হয়রানীসহ নানাভাবে নির্যাতিত হতে থাকে। এমন পরিস্থিতিতে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে নেতাকর্মীদের বিষয়ে বিশেষ কোন ভূমিকা নিতে পারছিলেন না মুকছেদুর রহমান লেবু। ফলে গত কয়েক মাসে দলীয় শৃংখলা অনেকটা ভেঙে পড়ে। তাই শারিরিক অসুস্থ্যতা আর নেতাকর্মীদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থতার কারণ দেখিয়ে ১১ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার একটি পত্রের মাধ্যমে দলের যুগ্ন-সাধারণ সম্পাদক শহীদ- উল্লাহ তালুকদার মুকুলের কাছে নিজের দায়িত্ব অর্পণ করেন এবং নিজ দায়িত্ব থেকে স্বেচ্ছায় অব্যাহতি নেন লেবু।

দলীয় নেতাকর্মীদের সাথে কথা বলে জানান গেছে, দীর্ঘদিন ধরেই শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগে সংকট চলছে। প্রায় ১১ বছর আগের মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি দিয়েই চলছে দলীয় কার্যক্রম। সহযোগী সংগঠনগুলোর অবস্থাও তাই। মুলত: নালিতাবাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যক্রম অনেকটা স্থানীয় সংসদ সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীকে ঘিরেই আবর্তিত হয়। নেতাকর্মীরা জানান, দলে পদ-পদবী যাই থাকুক মতিয়া চৌধুরীর আশির্বাদ যার ওপর থাকবে তিনিই সকল কর্মকান্ডে নের্তৃত্ব দিয়ে থাকেন। এভাবেই সাম্প্রতিককালে নালিতাবাড়ীর রাজনীতির মঞ্চে কখনোও বাদশা, কখনোও হালিম উকিল, কখনোও মুকছেদুর রহমান লেবু কর্তৃত্ব করেছেন।

মতিয়া চৌধুরীর আশির্বাদ পরিবর্তনের সাথে সাথে নিয়ন্ত্রনকারীও পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু সাংগঠনিক কর্মকান্ডে সংকট কাটেনি। বরং বেড়েছে উপ-দলীয় কোন্দল। দৃশ্যপটে এখন স্থানীয় কিছু যুবলীগ নেতা সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছেন। দলীয় নেতাকর্মীদের অভিযোগ-এভাবে দলের মাঝে বিভাজনের সৃষ্টি হয়েছে। যার প্রেক্ষিতে দলীয় কর্মকান্ডে স্থবিরতা এসেছে। আর এর প্রভাব পড়েছে মাঠ পর্যায়ে। যে কারণে নালিতাবাড়ী উপজেলা ও পৌরসভা নির্বাচনে বিপুল সম্ভাবনা থাকা স্বত্তেও দু‘টি নির্বাচনেই আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা পরাজয় বরণ করেছেন। সংসদ নির্বাচনে মতিয়া চৌধুরীর বিরুদ্ধে বাদশা ও উপজেলা নির্বাচনে লেবুর বিরুদ্ধে হালিম উকিল বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছিলেন।

আবার কেউ কেউ বলেন, মতিয়া চৌধুরী এখানকার রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেন না। কিন্তু তিঁনি যাকে বিশ্বাস করে দায়িত্ব দেন, দেখা যায় সেই তার বিশ্বাসের অমর্যাদা করতে থাকেন। একেকজন তাঁর দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে সবকিছুর নিয়ন্ত্রক বনে যান। কিন্তু যখন তিঁনি কটোর হন, তখন সুবিধাভোগীরা তাকে বিব্রত করতে চেষ্টা করেন। এটা এক কঠিন বাস্তবতা।

দলীয় সূত্রগুলো জানায়, সম্প্রতি সীমান্তে পাহার ও নদী থেকে পাথর-বালি উত্তোলন, মধুঠিলা ইকোপার্ক ও নন্নী এলাকায় দলীয় নেতাকর্মীদের ওপর পুলিশী হয়রানির ঘটনাবলী নিয়ে লেবুর সাথে মতিয়া চৌধুরীর সম্পর্কের কিছুটা অবনতি ঘটে। যার প্রেক্ষিতেই লেবু দলীয় পদ থেকে সরে গিয়ে মতিয়া চৌধুরীর ওপর চাপ সৃষ্টির কৌশল নেন।

এ ব্যাপারে মোকছেদুর রহমান লেবু‘র সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি তার স্বেচ্ছায় অব্যাহতি নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, সরকারী দলে থেকেও দলীয় নেতাকর্মীদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছি। কাজেই সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আমার দায়িত্ব পালনের কোন যৌক্তিকতা নেই। তাই আমি দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়িয়ে যুগ্ন-সাধারণ সম্পাদক শহীদ উল্লাহ তালুকদার মুকুলকে বুঝিয়ে দিয়ে বৃহস্পতিবার একটি পত্র দিয়েছি।

নালিতাবাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ন-সাধারণ সম্পাদক শহীদ-উল্লাহ তালুকদার মুকুল বলেন, আমি দলীয় পদ থেকে অব্যাহতি চেয়ে সাধারন সম্পাদক লেবুর পাঠানো চিঠিটি হাতে পেয়েছি। বিষয়টি দলীয় উর্ধ্বতন নেতৃবৃন্দকে অবহিত করেছি।

(এইচবি/সেপ্টেম্বর ১৩, ২০১৪)