আয়শা সিদ্দিকা আকাশী, মাদারীপুর : ‘এসএসসি এবং এইচএসসি ফুল ব্যাকগ্রাউন্ট কমার্স থাকায় উদ্যোক্তা শব্দটার সাথে অনেক আগে থেকেই পরিচিত। খুব ইচ্ছে ছিলো নিজ প্রচেষ্টায় কিছু করার। কিন্তু পড়াশোনার চাপে কখনো সুযোগ হয়ে উঠেনি। তবে সেই সুযোগটা পেয়েছি এই মহামারীর বা করোনাকালীন সময়ে ই-কর্মাসের মাধ্যমে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে আমার অনেক দিনের ইচ্ছে পূরণ হয়েছে। কারণ সংসারের বড় মেয়ে হওয়ায় ইচ্ছে ছিলো পরিবারের জন্য কিছু করার। আর তার সম্ভব হয়েছে ই-কর্মাসের মাধ্যমে।’ এভাবেই কথাগুলো বললেন মাদারীপুর সদর উপজেলার হাজীর হাওলা ২নং ব্রীজ এলাকার মেয়ে এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ থার্ড ইয়ারের ছাত্রী নুসরাত জাহান ঊর্মি।

ই-কর্মাসের মাধ্যমে নিজের ব্যবসা সর্ম্পকে জানতে চাইলে নুসরাত জাহান ঊর্মি আরো বলেন, একটা সময় সারাদিন ফেসবুকিং করতে করতে খুব বিরক্ত লাগতো। তখন এরিই মাঝে কয়েকটা ই-কমার্স গ্রুপে এড হয়েছি। তারমধ্য সবচেয়ে প্লাটফর্ম উই গ্রুপেই উল্লেখযোগ্য। এটায় দেখতাম নারীরা কতো ধরণের উদ্যোগ নিতে পারেন। এসব দেখে দেখে নিজের মধ্যেও আত্মবিশ্বাস জন্মালো। ভাবলাম আমিও তো কিছু করতে পারি। কিন্তু কি করবো, কোনটা ভালো হবে, এসবের নেগেটিভ পজিটিভ দিক ভাবতে থাকতাম। আর হ্যাঁ, এর মধ্যেই খুঁজে দেখলাম মাদারীপুরের অনেক উদ্যাক্তা আছে কিন্তু তাদের কোনো প্লাটফর্ম নেই। এদের নিয়েও কাজ করার ইচ্ছে হলো। পরে চাচাতো বোনদের সহায়তায় মাদারীপুর ই-কমার্স ফোরাম খুললাম। এটায় সাথে যুক্ত হয়ে নিজের আগ্রহ আরো কয়েকগুণ বেড়ে গেলো। মানে আমার কিছু করতেই হবে। কিন্তু বাসা থেকে চায় আমি গতানুগতিকভাবে পড়াশোনা করে চাকরি করি। তাই তারা আমার উদ্যোগে পাশে থেকে ফিনান্সিয়াল সাপোর্ট দিবেনা। এরমাঝে আমি ভার্সিটি এডমিশনের জন্যে একটা কোচিং সেন্টার দিয়েছিলাম। সেখান থেকে বেশকিছু টাকা পেয়েছি। ২০১৯ সালের নভেম্বরে কোচিং শেষ হওয়াতে ওই টাকাগুলো থেকে নিজের খরচে কিছু রেখে বাকি ১০ হাজার টাকা দিয়ে নিজের কাঙ্খিত স্বপ্নপূরণ করতে শুরু করে দিলাম। ডিসেম্বরের শুরু থেকেই মার্কেট যাচাই করে মাঝামাঝি সময়ে শুরু করে দিলাম কিছু হোমমেইড প্রোডাক্ট নিয়ে বিজনেস। ব্যবসার পেইজের নাম দেই ইচ্ছেতরী। করোনার এই মহামারি সময়ে বিশ^বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় বাড়িতে চলে আসায়, ব্যবসায় বেশি মনোযোগ দিতে পারি। অল্প দিনের মধ্যেই অনলাইনে গ্রাহকদের বিশ্বাস অর্জন করায় দ্রুত ব্যবসা বাড়াতে থাকি।

খোজ নিয়ে জানা যায়, নুসরাত জাহান ঊর্মি প্রথমদিকে হোমমেইড আনসল্টেড বাটার, শ্রীমঙ্গলের চা পাতা দিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। আস্তে আস্তে হোমমেইড মোজারেলা চিজ, হোমমেইড এক্সট্রা ভার্জিন কোকোনাট অয়েল, হোমমেইড খাঁটি গাঁওয়া ঘি, হোমমেইড গুঁড়া দুধ, হোমমেইড ট্যাং, প্রাকৃতিক চাকের মধু, সরাসরি সৌদি থেকে আমদানিকৃত খেজুর দিয়ে যাত্রা শুরু হয়। ব্যবসা জমে উঠলে পরিকল্পনা করেন ৬৪ জেলার বিখ্যাত কিছু প্রোডাক্ট নিয়ে কাজ করবেন। সে অনুসারেই শ্রীমঙ্গলের চা পাতা, নঁওগার প্যাড়া সন্দেশ, অষ্টগ্রামের পনির আর রাজশাহীর আমও যোগ হয় তার অনলাইন ব্যবসায়। আস্তে আস্তে সবগুলো প্রোডাক্টেই নিয়ে আসবেন বলে জানান। ইতিমধ্যে তিনি মাদারীপুর জেলাসহ প্রায় ৬৪ জেলাতে তার পণ্য কুরিয়ারের মাধ্যমে গ্রাহকরা কিনেছেন। শুরুর দিকে একা একা কাজ করলেও এখন তার সাথে তার মা লিটু বেগম, বোন কানিজ ফাতেমা, প্রতিবেশি আমেনা বেগম, শিউলি বেগম, ফাতেমা আক্তারসহ প্রায় ১০ জন নারী কাজ করছেন। কাজের চাহিদা অনুযায়ী কর্মচারীরদের সংখ্যা বাড়ে-কমে। সেই সাথে মাদারীপুরে হোম ডেলিভারি ও কুরিয়ার করার জন্য মো. আল-আমিন নামে একজন কাজ করছেন। প্রতিমাসে তার বিক্রি হয় ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা। এর থেকে লাভ হয় ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকার মতো।

নুসরাত জাহান ঊর্মি আরো বলেন, আলহামদুলিল্লাহ আমি শুরু থেকেই অক্লান্ত পরিশ্রম করে খুব সফলভাবে আগাতে পেরেছি। ইতিমধ্যেই আমি প্রায় লাখ টাকা সেলে পৌঁছেছি। প্রথমদিকে ফ্যামেলী সাপোর্ট না পেলেও এখন ফ্যামেলী সাপোর্ট পাচ্ছি। আমি বলবো মেয়েরা ঘরে বসেই ইনকাম করা সম্ভব। তাই অন্যের উপর নির্ভর না হয়ে নিজেই আত্মকর্মসংস্থান করা উচিত।

ডেলিভারী ম্যান মো. আল-আমিন বলেন, আমি ইচ্ছেতরীর সাথে কাজ করে ইনকাম করতে পারছি। কারণ করোনার সময় অনেকেই কাজ হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছিলো। আমি ডেলিভারী কাজ করে কিছুটা হলেও পরিবারকে সহযোগিতা করতে পেরেছি।

মাদারীপুরের উন্নয়নকর্মী ফারজানা আক্তার মুন্নি বলেন, ই-কর্মাসের ব্যাপারে সরকারী ও বেসরকারীভাবে ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করলে উদ্যোক্তারা আরো ব্যাপকভাবে কাজ করতে পারবে।

এ ব্যাপারে মাদারীপুর মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক মাহমুদা আক্তার কণা বলেন, মেয়েরা এখন অনেক এগিয়ে। তারা জানে কিভাবে ঘরে বসে আয় করতে পারবে। ই-কর্মাসের মাধ্যমে মেয়েরা অনেক এগিছেন। মাদারীপুরের ঊর্মি আমাদের উদাহরণ।

(এএসএ/এএস/অক্টোবর ১০, ২০২১)