বাগেরহাট প্রতিনিধি : বাগেরহাটের মোংলায় নানা আয়োজনে পালিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের অকৃত্রিম বিদেশী বন্ধু, শিক্ষানুরাগী, অনুবাদক, কবি ও সাহিত্যিক ফাদার মারিনো রিগনের ৪র্থ মৃত্যুবার্ষিকী।

বুধবার মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ফাদার রিগনের সমাধিতে র‌্যালী সহকারে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ, আলোচনা সভা, শিশু চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়।

মোংলার মিশনারী সেন্ট পলস উচ্চ বিদ্যালয়, ফাদার মারিনো রিগন শিক্ষা উন্নয়ন ফাউন্ডেশন ও সম্মিলিত সাংস্কৃৃতিক জোট যৌথভাবে মৃত্যুবার্ষিকী আয়োজন করেন। বুধবার সকালে র‌্যালী করে ফাদার মারিনো রিগনের সমাধিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পন করেন মোংলা পোর্ট পৌর মেয়র, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, মোংলা সরকারি কলেজ, ফাদার রিগন শিক্ষা উন্নয়ন ফাউন্ডেশন, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, সেন্ট পলস উচ্চ বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন।

সমাধিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পন শেষে সেন্ট পলস বিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন ফাদার রিগন শিক্ষা উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের সভাপতি সুভাষ চন্দ্র বিশ্বাস। বক্তব্য রাখেন মোংলা পোর্ট পৌরসভার মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ আব্দুর রহমান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কমলেশ মজুমদার, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আহ্বায়ক সাবেক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান সাংবাদিক মো. নূর আলম শেখ, সেন্ট পলস ধর্মপল্লীর পালক পুরোহিত দানিয়েল মন্ডল, উপাধ্যক্ষ বিভাষ চন্দ্র বিশ্বাস ও সেন্ট পলস উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ব্রাদার এন্ড্রু জয়ন্ত কস্তা। পরে শিশু চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার বিতরন করা হয়।

সভায় বক্তারা বলেন, মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ অবদান রাখার পাশাপাশি ফাদার রিগন বাংলার সাংস্কৃতিক সম্পদকে বহির্বিশ্বে তুলে ধরেছেন। তিনি ধর্ম জীবন ও শিল্প জীবনকে পৃথকভাবে দেখেননি। তাঁর মস্তকে ছিলো রবীদ্রনাথ আর অন্তরে ছিলো লালন। বাংলাদেশে শিক্ষা-সংস্কৃতি ও মনুষ্যত্ব বিকাশে অনন্য ভূমিকা পালন করেছেন ফাদার মারিনো রিগন। তিনি লালনের সাড়ে তিনশত গান, গীতাঞ্জলিসহ বিশাব কবি রবীদ্রনাথ ঠাকুরের ৪৮টি বই এবং কবি জসিম উদ্দিনের নকশী কাঁথার মাঠ, নির্বাচিত কবিতা, সুজন বাদিয়ার ঘাট ইতালি ভাষায় অনুবাদ করে বাংলা সাহিত্যে উচ্চ আসনে আসীন হয়ে আছেন ফাদার মারিনো রিগন।

মুক্তিযুদ্ধের অকৃত্রিম বন্ধু ফাদার মারিনো রিগন ১৯২৫ সালে ৫ ফেব্রুয়ারি ইতালির ভিল্লাভের্লা গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন।একজন খ্রিস্ট ধর্মযাজক হিসেবে তিনি ১৯৫৩ সালে এদেশে আসেন। বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে অবশেষে তিনি বাগেরহাটের মোংলার শেলাবুনিয়া প্রামে একটি চার্চ ও একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন এবং শেলাবুনিয়ায় তিনি স্থায়ী আবাস গড়ে তোলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি ছিল তার অকুণ্ঠ সমর্থন। যুদ্ধ চলাকালে তিনি যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবা প্রদানের জন্য চার্চে গোপনে একটি চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপন করেন। তার এ ক্যাম্পে চিকিৎসাসেবা নিয়ে অনেক মুক্তিযোদ্ধা সুস্থ হয়ে পুনরায় রণাঙ্গনে ফিরে গেছেন। তাদের মধ্যে বিখ্যাত হেমায়েত বাহিনীর প্রধান হেমায়েত উদ্দিন বীরবিক্রমও ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে ফাদার মারিনো রিগনের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার তাকে ২০০৯ সালে নাগরিকত্ব ও ২০১২ সালে ‘মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা’ প্রদান করে।

উল্লেখ্য, ২০১৪ সালে বাংলাদেশের মোংলার ক্যাথলিক মিশনে থাকা অবস্থায় অসুস্থ্য হয়ে পড়লে ফাদার রিগনকে তার পরিবারে সদস্যরা ইতালি নিয়ে যায়। জন্মস্থান ইতালির ভিল্লাভেরলা গ্রামে ২০১৭ সালের ২০ অক্টোবর ৯৩ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই ধর্মযাজক। কিন্তু তাঁর অন্তিম ইচ্ছানুযায়ী বাংলাদেশ সরকার ২০১৮ সালের ২১ অক্টোবর ফাদার রিগনের মরদেহ ইতালি থেকে এদেশে এনে তার হাতে গড়া বাগেরহাটের মোংলার শেহলাবুনিয়া মিশনারীতে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়।

(এসএকে/এসপি/অক্টোবর ২০, ২০২১)