এমদাদুল হক স্বপন, ঝালকাঠি : জালিয়াতির মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছে জাতীয় পরিচয়পত্র। পিতামাতার নাম, আইডি নাম্বার ও জন্ম তারিখ ভুল, এমন কি নিজের নামেও ভুল। আর এসব দেখেও প্রিজাইড গ্রীণ সিটি লিমিটেড নামে একটি কোম্পানীর অনুকুলে পৃথক দুটি দলিলে ১ একর ৮২ শতাংশ জমি রেজিস্ট্রি করে দিয়েছেন ঝালকাঠির নলছিটি সাব রেজিস্ট্রার নুরুল আফসার। দেশের প্রচলিত আইন ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরের বিধিবিধান লংঘন করে মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে তুগলগি কায়দায় দলিল রেজিস্ট্রি করেছেন সাব রেজিস্ট্রার নুরুল আফসার। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনা ধরা পরলে অসহায় জমির মালিক প্রকৃত বিষয়টি নিয়ে আদালতে মামলা দায়ের করেছেন। এছাড়াও সরকারের বন্দোবস্ত দেয়া সম্পত্তি হস্তান্তর না করার শর্ত থাকলেও অসাধু সাব রেজিষ্ট্রার গত ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখে সরকারের আইন পদদলিত করে রিজিয়ার অংশের ৫৬.২৫শতাংশ সম্পত্তি মোঃ মোসলেম আলী মাঝীর অনুকুলে হেবা দলিল(নং ২৫০৫) রেজিস্ট্রি করে দিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

একটি সূত্র জানায়, উপজেলার পূর্ব চরদপদপিয়া মৌজার ১৬১ ও ১৬৬ খতিয়ানের ৯৫.৫০ শতাংশ জমির রেকর্ডীয় মালিক মোকতার আলী ফকির ও স্ত্রী মালেকা বেগমের মৃত্যুতে ওয়ারিশ সুত্রে তাঁর ছেলে মো. হাসমত আলী মালিক হয়। জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী মো. হাসমত আলীর আইডি নম্বর ৪২১৭৩১৫৩৭৮০৭৭ ও জন্ম ১৯৪৫ সালের ৭ এপ্রিল। গত ৩০ মে বরিশাল-পটুয়াখালী আঞ্চলিক মহাসড়কের কাছাকাছি ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অদূরে হাসমত আলীর সাড়ে ৯৫ শতাংশ জমি হাসমত ফকির নামে এক ব্যক্তির জাতীয় পরিচয়পত্র জাল তৈরি করে নলছিটি সাবরেজিস্ট্রার অফিস থেকে ২৩ লাখ ৮৮ হাজার টাকায় প্রিজাইড গ্রীন সিটি লিমিটেডের নামে বিক্রির সাব কবলা দলিল (নং ১৪৬৪) রেজিস্ট্রি করা হয়।

ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্রে (নম্বর ৪২১৭৩১৫৩৯০২১৭) উক্ত জমি বিক্রেতা হাসমত ফকিরের বাবার নাম মোক্তার আলী, মায়ের নাম ফুল বানু লেখা ও জন্ম তারিখ ১৯৭৫ সালের ২ জানুয়ারি উল্লেখ করা হয়। এসব জালিয়াতী প্রত্যক্ষ করেও কোনরকম যাচাই বাছাই না করেই নলছিটি সাব রেজিস্ট্রার নুরুল আফসার দলিল রেজিস্ট্রি করে দেন।

জালিয়াতির মাধ্যমে তৈরি করা জাতীয় পরিচয়পত্রটি নলছিটি উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে যাচাই করা হলে কাঞ্চন হাওলাদার নামে এক ব্যক্তির বলে জানানো হয়। মূলত এই কাঞ্চন হাওলাদারের জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর ঠিক রেখে হাসমত ফকির নিজের ছবি, বাবা মায়ের নাম ও জন্ম তারিখ বসিয়ে জালিয়াতি করেন।

একইভাবে মো. হাসমত আলীর বড় ভাই মৃত আঃ রশিদ ফকিরের একই মৌজায় সাড়ে ৮৬ শতাংশ জমি তার মৃত্যুর পর ছেলে মো. আল মামুন ও মেয়ে সুমনা বেগম ওয়ারিশ সূত্রে মালিক হলেও তাদের অজান্তে গত ১২ এপ্রিল জাল জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে ভূয়া দুইজনকে বিক্রেতা সাজিয়ে সাবরেজিষ্ট্রার নুরুল আফসার রেজিস্ট্রি করেন। মিনারা বেগম ও মাহামুদ ফকির নামে উক্ত দুই জন জাল জালিয়াতির মাধ্যমে একই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান প্রিজাইড গ্রীন সিটি লিমিটেডের কাছে ২১ লাখ ৬৫ হাজার টাকা মূল্যে একটি দলিল (নং- ১৩০৩) রেজিস্ট্রি করেন। আর এ দুটি জালিয়াতীপূর্ন দলিল রেজিষ্ট্রির কাজেই সাবরেজিষ্ট্রার নুরুল আফসারের সাথে সহযোগীর দায়িত্ব পালন করেন দলিল লেখক মিজানুর রহমান পাপ্পু।

অভিযোগ রয়েছে মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে দলিল লেখক ও সাবরেজিস্ট্রার মিলে মূল মালিক দুই ভাইয়ের এক একর ৮২ শতাংশ সম্পত্তি প্রিজাইড গ্রীন সিটি লিমিটেডের নামে একটি হাউজিং কোম্পানীকে রেজিস্ট্রি করে দেন। দলিল রেজিস্ট্রির পরে প্রিজাইড গ্রীন সিটি লিমিটেডের পক্ষ থেকে উক্ত জমি দখল নিয়ে কয়েকটি সাইনবোর্ড লাগানো হলে বিষয়টি মুল মালিক পক্ষ জানতে পেরে তারা খোজ খবর নিলে চাঞ্চল্যকর এ জালিয়াতীর ঘটনা জানাজানি হয়, বেড়িয়ে পড়ে থলের বেড়াল।

এ অবস্থায় মৃত আঃ রশিদ ফকিরের প্রকৃত ওয়ারিশ মেয়ে সুমনা বেগম বাদী হয়ে গত ২০ জুন ঝালকাঠির আমলী আদালতে (সি,আর ১৩২/২০২১) একটি মামলা দায়ের করলে আদালত মামলাটি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নলছিটি থানার ওসিকে নির্দেশ দেন। মামলায় সাবরেজিস্ট্রার নুরুল আফসারকে সরাসরি আসামি না করা হলেও ঘটনার বিবরণের মাধ্যমে জালিয়াতির বিষয়টি উল্লেখ করে প্রিজাইড গ্রীন সিটি লিমিটেডের চেয়ারম্যান মঞ্জু ফরাজী, এমডি ওয়াহেদুর রহমান প্রিন্স, ম্যানেজার মো.কামরুল ও দলিল লেখক মিজানুর রহমান পাপ্পুকে আসামী করা হয়েছে।

এ বিষয়ে হাসমত আলীর ছেলে মেহেদি হাসান অভিযোগ করেন, আমার বাবার জমি, তাঁর আইডিকার্ড (জাতীয় পরিচয়পত্র) জাল করে অন্য লোক সাজিয়ে জাল দলিলের মাধ্যমে বিক্রি করে দেয়। এ ঘটনার সঙ্গে দলিল লেখক, সাবরেজিস্ট্রার ও যারা কিনেছেন সবাই জড়িত। এই চক্রটি আমার চাচার জমিও জালিয়াতি করে নিয়েছে। আমাদের জমি ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য আমরা সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি।

মৃত আঃ রশিদ ফকিরের স্ত্রী জাহানারা বেগম বলেন, আমাকে মৃত দেখিয়ে আমার ছেলে ও মেয়ের নামের জমিও পাপ্পু ভেন্ডার ও সাবরেজিস্ট্রার দলিল করে প্রিজাইড গ্রীণ সিটি লিমিটেডকে দিয়ে দিছে। আমরা তাদের সাথে যোগাযোগ করলে শিগ্রই বিষয়টি মিমাংসা করে ফেলবে বলে আশ্বাস দিলেও কিছুই করছেনা।

জমির ক্রেতা দাবীদার প্রিজাইড গ্রীন সিটি লিমিটেডের ম্যানেজা মো. কামরুল সাংবাদিকদের বলেন, দপিদপিয়া এলাকার সাইদুল ডাক্তার (পল্লী চিকিৎসক) প্রতারণা করে এই জমি বিক্রি করেছেন। বিষয়টি আমরা জানার পরে প্রকৃত মালিক পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। বিষয়টি অচিরেই মিমাংসা হয়ে যাবে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে দলিল লেখক মিজানুর রহমান পাপ্পু বলেন, বিষয়টি নিয়ে আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। জাল জালিয়াতির বিষয়টি আদালতই ফয়সালা করবেন। এখানে আমার কোন বক্তব্য নেই।

আর নলছিটির সাবরেজিস্ট্রার নুরুল আফসার বলেন, আমি উর্ধ্বতন কর্তপক্ষের অনুমতি না নিয়ে কোন বক্তব্য দিতে পারি না। এটা যেহেতু কোর্ট পর্যন্ত চলে গেছে, এখানে অন্য কারো নাক গলানোর কিছুই নাই। ‘এখন আমি এজলাসে আছি, বিষয়টি নিয়ে পরে কথা বলবো’ জানিয়ে ফোন কেটে দেন।

এ ব্যাপারে জেলা রেজিস্ট্রার আব্দুল বারী বলেন, তিনি এখন পর্যন্ত কোন অভিযোগ পাননি বা মামলার বিষয়ে তিনি কিছুই অবগত নয়। তবে সাবরেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে যদি কোন অভিযোগ পাওয়া যায়, তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
নলছিটি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আতাউর রহমান বলেন, আদালতের আদেশ আমরা পেয়েছি। জাল জালিয়াতির বিষয়ে তদন্ত চলছে। জমি জমার বিষয়, তাই তদন্ত করতে একটু সময় লাগছে।

(এস/এসপি/অক্টোবর ২০, ২০২১)