প্রবাস ডেস্ক : ২০২১ সালের শারদীয় দুর্গোৎসবে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর ধর্মীয় মৌলবাদী ও উগ্রপন্থীদের সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের প্রতিবাদে নিউইয়র্কে সংবাদ সম্মেলন করেছে হিন্দু কমিউনিটি। 

সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা বলেন, সম্প্রতি সমাপ্ত সনাতন ধর্মালম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা চলাকালে দেশের ছাব্বিশটি জেলায় সুপরিকল্পিতভাবে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর একটানা ছ’দিন ব্যাপী বীভৎস সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসী হামলা চালানো হয়। সন্ত্রাসীরা গত ১৩ই অক্টোবর কুমিল্লার নানুয়ার দিঘীরপাড় পূজামণ্ডপে হিংস্র অক্রমণ দিয়ে শুরু করে নোয়াখালীর ইসকন মন্দির, চৌমুহনী, ফেনী, চট্টগ্রাম এবং ১৮ই অক্টোবর পীরগঞ্জের জেলে পল্লী ভষ্মীভূত করা পর্যন্ত খুন,যখম, নারী ও শিশু ধর্ষণ, মন্দির ও দেব-দেবীর প্রতিমা ভাঙচুর, বাড়িঘর ও ব্যবসা লুটপাট করে অগ্নি সংযোগ করার যে নারকীয় তাণ্ডব চালিয়েছে সেটা ১৯৪৬-এর অক্টোবরে নোয়াখালীতে, ১৯৬৪ সালে খুলনা, ঢাকা ও দেশের অন্যান্য অঞ্চলে, ১৯৭১ সালে, ১৯৯২ সালে, ২০০১ থেকে ২০০৫ সালে সারা দেশে, ২০১২-’১৩ সালে রামুতে, এবং তৎপরবর্তীকালে নাসির নগর, সাঁথিয়া, শাল্লা, মুরাদনগর প্রভৃতি স্থানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতি বর্বরতার ভয়াবহ স্মৃতি স্মরণ করিয়ে দেয়।

উক্ত ছয় দিনে ধর্মীয় মৌলবাদী ও সন্ত্রাসীরা নোয়াখালীর ইসকন মন্দির সহ দেশের সহ বিভিন্ন মন্দির ও মণ্ডপের পুরোহিত ও ভক্ত সহ সাত জনকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে, তিনজন মা-বোনকে ধর্ষণ করেছে,পূজামন্ডপ, প্রতিমা ধ্বংস করছে, ১০০র মত হিন্দু বাড়ীঘর লুটপাট করে ভষ্মীভূত করেছে। ওই ধর্মবাজদের ধর্ষনের পৈশাচিকতায় প্রাণ হারিয়েছে একটি দশ বছরের নাবালিকা,গতকালও মারা গেছেন নানুয়ার দিঘীর পাড়ে আক্রমণের শিকার একজন, আরও কতজন মারা যাবেন সেটা এখনও বলা যায়না। গৃহহীন অবস্থায় শত শত হিন্দু পরিবার সম্ভাব্য অগামী আক্রমণের আশঙ্কায় দিশেহারা। হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর এই নৃশংস সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসী হামলার রিপোর্ট করেছে নিউ ইয়র্ক টাইমস ও গার্ডিয়ান সহ অসংখ্য দেশী বিদেশী সংবাদ মাধ্যম, প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়েছে বিভিন্ন সভ্য দেশের দূতাবাস, ইউনাইটেড নেশনস এবং হিউমেন রাইটস ওয়াচ সহ অনেক মানবাধিকার সংস্থা।

এবারকার নৃশংসতার অজুহাত তৈরি করা হয়েছে পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কুরআন অবমাননার নাটক সাজিয়ে, যেমনটা অতীতেও করা হয়েছে। ধর্ম অবমাননার জিগির তুলে হিন্দুদের উপর পরিকল্পিত এই জঙ্গী সন্ত্রাসী হামলা বাংলাদেশে এখন রুটিন ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর উদ্দেশ্য, বাংলাদেশকে অ-মুসলমান শূন্য করা।

আপনারা জানেন যে, বাংলাদেশ সরকার বেশ উচ্চকণ্ঠে আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের কাছে এটা দাবি করে থাকে যে, সরকার ধর্মীয় সামপ্রদায়িকতা বিরোধী, কিন্তু আপনারা এ’টাও জানেন যে সেখানে সংখ্যালঘু নির্যাতকদের কোন দিনই বিচার ও শাস্তি হয়নি, যে কথাটা ২০১৭ সালের ১৩ই নভেম্বর বি.বি.সি. বাংলা “বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের উপর হামলার বিচার হয় না কেন?” শিরোনামে লিখেছিল। ২০০১-এ বিএনপি-জামাতের নৃশংস অত্যাচার ও সন্ত্রাসী হামলার প্রেক্ষিতে জজ্ সাহাবুদ্দিন কমিশন রিপোর্টে চিহ্নিত কয়েক হাজার সংখ্যালঘু নির্যাতকদের একজনেরও বিচার হচ্ছে না কেন? আশ্চর্যের ব্যাপার, বরাবরের মতই গত ক’দিনের হামলার জন্য হাজার হাজার ধর্মীয় মৌলবাদী ও জঙ্গী প্রস্তুতি নিল কিন্তু ট্রেনিং প্রাপ্ত গোয়েন্দা বিভাগ বা আইন রক্ষাকারী সংস্থাগুলো কিছুই আঁচ করতে পারল না, সেটা কি করে হয় ! সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা বিধানে সরকারের অনীহা এবং বিচারহীনতার সরকারী নীতির কারণেই হিন্দুদের উপর সাম্প্রদায়িক এই হামলা নিরন্তরভাবে চলছে। কোন কোন সরকার প্রত্যক্ষভাবে,আর কোন কোন সরকার তাদের বিচার না করার মাধ্যমে পরোক্ষভাবে এই বর্বরতাকে সমর্থন করে সংখ্যালঘুদের দেশত্যাগে বাধ্য করছে। ভাবুন তো সংখ্যালঘু নির্যাতনের এই অশুভ নীতি বিশ্বব্যাপী সকল সরকার গ্রহণ করলে আমরা যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসীরা সহ বিশ্বের কোটী কোটী ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানুষের কি করুণ পরিণতী হবে।

আমাদের আজকের এই সংবাদ সম্মেলনের প্রধান উদ্দেশ্য হল অপনাদের মাধ্যমে এই অশুভ, মানবতা বিরোধী সামপ্রদায়িক শক্তির মূলোৎপাটনে করতে দেশের সকল সচেতন প্রগতিশীল নাগরিকদের ঐক্যবদ্ধ সক্রিয় ভুমিকা গ্রহনের জন্য অহ্বান জানানো। এটা তো চলতে পারে না - এর অবসান হতেই হবে। আর, কাজটা প্রধানত: করতে হবে দেশের সংখ্যাগরীষ্ঠ ধর্মীয়গোষ্ঠীর প্রগতিশীল মানুষকেই।

সংখ্যালঘুদের উপর নিরন্তর সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনাবলীর প্রেক্ষাপটে “বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উজ্জ্বল উদাহরণ” বলে যে সরকারী দাবী সেটা আজ বিশ্বের সভ্য সমাজকে বিশ্বাস করানো কঠিন হয়ে পড়েছে। আমাদের মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী এবার সামপ্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান ঘোষণা করেছেন। অপরাধীদের বিচার ও শাস্তি প্রদান এবং এবং নির্যাতিতদের বিদ্ধস্ত ও ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়িঘর পুনর্ণিমানের এবং সার্বিক সহায়তা দানের প্রতিশ্রুতিকে আমারা অভিনন্দন জানাই। আমরা আশা করব যে সংখ্যালঘু নির্যাতকদের বিচার ও শাস্তি প্রদান প্রক্রিয়া শিঘ্রই শুরু করা হবে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিম্নলিখিত দাবিসমূহ বাস্তবায়নের জন্য অনুরোধ:

১। অবিলম্বে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে অপরাধীদের বিচারের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা হোক।

২। মৌলবাদী-সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত,আহত,গৃহহীন সংখ্যালঘু পরিবারসমূহকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ ও বাসস্থান পুনর্ণিমান করে দেয়া হোক, এবং নিহতদের পরিবারগুলোর একজনকে করে সরকারী চাকরি দিয়ে তাঁদের বেঁচে থাকার ব্যবস্থা করা হোক।

৩। আহতদের বিনা খরচে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হোক।

৪। এই হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত, বিদ্ধস্ত, ও ধ্বংসপ্রাপ্ত সকল মন্দির ও মণ্ডপসমূহ পুনর্ণিমান করে দেয়া হোক।

৫। একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করে সাম্প্রতিক ঘটনা সহ অতীতের সকল সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনাবলীর একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হোক, এবং তাতে যারা অপরাধী বলে চিহ্নিত হবে তাদের জজ্ সাহাবুদ্দিন কমিশন কর্তৃক চিহ্ণিত অপরাধীদের নামের তালিকায় যোগ করে, সেটা প্রকাশ করে, তাদের বিচার ও শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক।

৬। অবিলম্বে সংখ্যালঘু কমিশন, হিন্দু, বৌদ্ধ, ও খ্রিষ্টান ফাউণ্ডেশন, ও একটি সংখ্যালঘু মন্ত্রনালয় গঠন করা হোক; এবং একটি হেইট স্পীচ -ক্রাইম আইন ও সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা হোক।

৭।অবিলম্বে বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত ১৯৭২-সালের সংবিধান পুনর্বহাল করে দেশকে একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য অবশ্য প্রয়োজনীয় প্রথম পদক্ষেপটি গ্রহন করা হোক।

সাংবাদিক বন্ধুগণ, আপনাদের কাছে আমাদের অনুরোধ, মানবতার খাতিরে আপনারা বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের পাশে থাকবেন। দেশ থেকে সংখ্যালঘু নির্যাতনের সংস্কৃতি বন্ধ হোক, বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হোক।
“ধর্মীয় পরিচয় নয়, আমরা বাঙালী” -- এই হোক আমাদের পরিচয়।
ধৈর্য সহকারে আমাদের বক্তব্য শোনার জন্যে আন্তরিক ধন্যবাদ।

(এস/এসপি/অক্টোবর ২৩, ২০২১)