শিতাংশু গুহ


এবার দুর্গাপূজায় হিন্দুদের ওপর আক্রমন আবারো প্রমান করেছে যে, ইসলামী মৌলবাদী গোষ্ঠী সু-পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশ থেকে হিন্দুদের বিতাড়নের জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছে। হিন্দুরা ‘পয়েন্ট অফ নো রিটার্ন’-এ চলে গেছে। একদিকে ধর্মান্ধ মৌলবাদ, অন্যদিকে ডিজিটাল সিকিউরিটি এক্ট ব্লাসফেমী হিসাবে ব্যবহার করে প্রশাসন বাংলাদেশে হিন্দুদের জীবন অতিষ্ট করে তুলেছে। পুলিশ লোক দেখানো অনেক গ্রেফতার করেছে, প্রতিটি ঘটনার পরই পুলিশ তাই করে, ঐ পর্যন্তই, আজ পর্যন্ত একজনেরও বিচার হয়নি। সরকার বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে সবকিছু এড়িয়ে যায়। এবার কুমিল্লার ঘটনা ছড়ায় ৪টি মহানগর এবং ২৮টি জেলায়, আবারো প্রমাণিত, এটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, সুপরিকল্পিত। অথচ সরকার ঢিলেঢালা মুডে আছেন।  

বলা হচ্ছে, ইকবাল নাকি ভবঘুরে, প্রতিবন্ধী। ক’জনা মন্ত্রীর কথাবার্তা শুনে মনে হয়, বাংলাদেশ ভবঘুরে, প্রতিবন্ধীদের ঘূর্ণাবর্তে আবর্তিত হচ্ছে? দেশে এখন প্রচ্ছদে ধর্মনিরপেক্ষতা, ভেতরে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। ঢাকায় সিআইডি এখন বলছেন, ইকবাল পেশাদার অপরাধীদের মতো ‘প্রশিক্ষিত’? পুলিশ প্রথমে ইকবালকে আটক করেও ছেড়ে দিয়েছিলো। সবই নাটক? কোরান অবমাননার প্রথম অভিযোগ ছিলো হিন্দুর বিরুদ্ধে, এরপর বলা হলো দুর্বৃত্ত, ইকবাল ধরা পড়লে বোঝা গেলো তিনি মুসলমান, এখন ভবঘুরে পাগল। ধর্ম অবমাননা করেছে ইকবাল, তাঁর বাড়ীতে একটা ঢিলও পড়েনি। বাড়ী পুড়েছে হিন্দুর, সম্পত্তি লুটপাট, ধর্ষণ, মন্দির-মূর্তি ভেঙ্গেছে? এতে বোঝা যায়, বিষয়টি ধর্ম অবমাননার নয়, বরং ‘গনিমতের মাল’ দখল নেয়া, হিন্দু খেদানো?

কোরানের ভেতর ইয়াবা পাচার করলে, বায়তুল মোকাররমে প্রকাশ্যে কোরান পুড়ালে ধর্ম অবমাননা হয়না, তখন এই ধর্মপ্রেমীরা কোথায় থাকেন? দূর্গা মণ্ডপে কোরান রেখে যে হিন্দুদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা হলো এর বিচার কে করবে? হিন্দুরা পায়ে সাদা কাগজ লাগলেও প্রণাম করে, কখনো কোন ধর্মগ্রন্থকে অপমান করেনা, ওটা ইকবালরাই পারে, যাঁরা ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্বার্থে নিজ ধর্মকে অপমান করে। কোরানে ইয়াবা হিন্দুরা রাখেনি, দূর্গা মণ্ডপে কোরান হিন্দু রাখেনি, কাবার ওপরে শিবের মূর্তিও হিন্দু রাখেনি, কিন্তু সবক’টি ঘটনায় খেসারত দিয়েছে হিন্দু বা বৌদ্ধ। তবু আইনমন্ত্রী বলে দিয়েছেন, সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইনের প্রয়োজন নেই, সংবিধানে তাঁদের সুরক্ষার বিধান আছে?

দেশে হিন্দুর বিরুদ্ধে সন্ত্রাসে রাজনৈতিক দল, প্রশাসনের ভেতরে ধর্মান্ধ-প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ মদত আগের মত এবারো ছিলো। আমরা শ্লোগান দেই, ধর্ম যার যার উৎসব সবার’, এখন হয়তো বলা যায়, ‘’ব্যথা যার যার লজ্জ্বা রাষ্ট্রের’। কুমিল্লার ঘটনার পর এটা স্পষ্ট যে, হিন্দুদের ওপর আক্রমন হয়েছে সর্বদলীয়ভাবে। এ সত্য লুকিয়ে লাভ কি, বা লুকানো কি যাবে? অথচ আওয়ামী লীগ বলেছে, বিএনপি করেছে। বিএনপি বলছে, আওয়ামী লীগ করেছে। রিজভী বলেছেন, মন্দির ভাঙ্গনের পরিকল্পনা হয়েছে গণভবনে। তথ্যমন্ত্রী বলেছেন, দুর্গাপূজার আক্রমণের পরিকল্পনা হয়েছে লন্ডনে। কি চমৎকার বাহাস! এ নাটক বন্ধ হোক, ভিকটিম বলছেন, সবাই করেছেন, আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জামাত-হেফাজত-খেলাফত সবাই?

রাষ্ট্রীয় বৈষম্য এখন স্পষ্ট এবং সর্বত্র, এটি প্রতিদিন বাড়ছে। ১৫ বছরের পরিতোষকে আদালত ১০দিনের রিমান্ড দেন্, আর ইকবালকে ৭দিনের? ইকবাল বজ্রংবলীর কোলে কোরান রেখেছিলো, আর পরিতোষ ফেইসবুকে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ছবি দিয়েছিলো, কার অপরাধ বেশি? একটি ভুল ভিডিও শেয়ার করার জন্যে শিক্ষিকা রুমা সরকারকে পুলিশ যেভাবে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছিলো তাতে একটা ‘বিজাতীয় বিদ্বেষ’ ছিলো, তাঁর অপরাধ কি ইকবালের চেয়েও বেশি? কুমিল্লার ওসি হাতে কোরান রেখে যখন ফেইসবুকে লাইভ করতে দেন্ তখন সমস্যা হয়না, অন্যায় শুধু রুমা সরকার বা পরিতোষের পোষ্টে? ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে সরকার এবার রুমা, পরিতোষ ছাড়াও শোভন দাস, ২৭; প্রান্ত সমাদ্দার, ১৫; হৃদয় সরকার, ২০; মহেন্দ্র বৈদ্য;, জয় মন্ডল, ২০; নরেশ কুমার দাস; রিপন দাস; বিষ্ণু ঢালী, অসীত বরন দাস ও আশীষ মল্লিক-কে গ্রেফতার করেছে, হয়তো আরো আছে, আমরা জানিনা?

যারা মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে হিন্দু পল্লীতে আগুন লাগায় বা ওয়াজে হিন্দুধর্ম নিয়ে আবোল-তাবোল বলে তারা বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়, আর নিরীহ হিন্দু ভয়ে কুঁকড়ে থাকে? দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলার দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী দীপ্তি রানী দাসকে এক বছর আগে ট্রেন থেকে টেনে-হিঁচড়ে নামিয়ে থানায় সোপর্দ করা হয় এবং তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়। ১৬ মাস বিনা বিচারে জেল খেটে দিপ্তী রানীকে দেশের সর্বোচ্চ আদালত জামিন দিলে দিনাজপুরের জেলা প্রশাসক তার জামিন বাতিল চায়? দীপ্তির অপরাধ তিনি এক মহিলার কোলে একটি কোরানের ছবি পোষ্ট করেছিলেন?

অভিযোগ উঠেছে, কুমিল্লা সিটি মেয়র মনিরুল হক সাক্কু’র পিএস মঈনুদ্দিন আহমদ বাবু’ কুমিল্লায় প্রথম মূর্তি ভাঙ্গেন। পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করতে চেয়েছিলো, মেয়র তাঁকে ছাড়িয়ে নিয়েছেন। এদিকে আন্তর্জাতিক সুফী ঐক্য সংহতি (সুফিজ) একটি ব্যানার নিয়ে সদ্য রাস্তায় নেমেছে, তাঁদের ব্যানারে লেখা, ‘ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা মুসলমানদের কাছে আমানত’। আমাদের দেশে আমানত শব্দের অর্থ অনেকটা ‘গৃহস্থের মুরগী পোষা’? গৃহস্থ মুরগীকে খুব ভালোবাসে, বাড়ীতে অতিথি এলে মুরগীর দফারফা শেষ! আমানত শব্দটি’র সাথে কুমীরের পাঠশালার মিল অনেক? আমানত থাকতে থাকতে হিন্দু ২০% থেকে ১০%-এ নেমে এসেছে! হিন্দু কারো আমানত নয়, বাংলাদেশের ভূমিপুত্র।

দেশে হিন্দুরা বলছেন, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দিতে বাংলাদেশ ব্যর্থ। আসলে কি তাই? বাংলাদেশ কি চাইলে নিরাপত্তা দিতে পারেনা? পারে, প্রশ্নটা হলো সদিচ্ছার, সরকার চাচ্ছে কিনা? পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড: মোমেন বলেছেন, কোন মন্দির পুড়েনি, কেউ ধর্ষিতা হয়নি। আইনমন্ত্রী বলেছেন, সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইনের দরকার নেই। এসব বক্তব্যে সরকারি অবস্থান স্পষ্ট হয়, অর্থাৎ সরকার এত কিছুর পরও ‘বাংলাদেশে চমৎকার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিদ্যমান’ অবস্থানে অনড়। হিন্দুর মাথায় আঘাত করাই যখন সম্প্রীতি, তখন হিন্দুদের ‘নিজেদের রাস্তা নিজেদেরই দেখে নিতে হবে? বঙ্গবন্ধু’র ভাষায় ‘যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে হিন্দুদের শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে’?

লেখক : আমেরিকা প্রবাসী।