রণেশ মৈত্র


গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অনেক কিছুই আমরা ভুলতে বসেছি। এই ভুলে যাওয়ার তালিকা অনেক দীর্ঘ। আবার এ কথাও ভুলে যেতে বিলম্ব ঘটে নি যে পাকিস্তান আমলের দীর্ঘ ২৩টি বছর ধরে আমরা অর্থাৎ বাঙালি জাতি যে ধারাবাহিক আন্দোলন পরিচালনা করেছিলেন তার মূল দাবীগুলি কি কি ছিল? প্রায় সবাই বলবেন ঐ আন্দোলনের দাবীগুলি ছিল “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” “পূর্ব বাংলার পূর্ণ স্বায়ত্ত শাসন দিতে হবে” “ছয় দফা ছয় দফা মানতে হবে মানতে হবে”। মোটামুটি, তাঁদের এই দাবীগুলি মানতে না চাওয়াতেই পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রবল আন্দোলন গড়ে উঠেছিল-যার পরিণতিতে বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ করে নয় মাসে দেশটি স্বাধীন করেন।

মোটা দাগে ভাবলে কথাগুলি সত্য বলে সবার কাছেই মনে হবে। কিন্তু যদি প্রশ্ন করা যায়, কৃষক কোন স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন, কোন স্বার্থে শ্রমিকেরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন, কোন স্বার্থে বেকার যুবক-যুবতীরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন, কোন স্বার্থে মধ্যবিত্ত সমাজ ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন, কোন স্বার্থে, তাঁতি, কুমার, জেলে প্রভৃতি নি¤œ আয়ের মানুষেরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন-তার কোন স্পষ্ট জবাব অনেকের কাছেই নেই।

যাঁরা ঐ পাকিস্তানী দিনগুলিতে আন্দোলন-সংগ্রামগুলিতে সশরীরে যুক্ত ছিলেন বা তার সমর্থনে নানামুখী ভূমিকা পালন করেছিলেন-আজ তাঁরা দু’চার-দশ বা বিশজন ছাড়া কেউই বেঁচে নেই।

এবারে দেখা যাক কিভঅবে নানা দাবীতে সকলকে ঐক্যবদ্ধ করার সম্ভব হয়ছিল। কৃষকের এই দাবীতে কৃষক সমাজ বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন। “ট্রেড ইউনিয়ন করার অবাধ অধিকার চাই এবং নিয়মিত ও ন্যায্য মজুরী চাই”-এই দাবীতে মুখ্যত: দেশের শ্রমিক শ্রেণী ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন; “বেকারত্ব দূর হবে, বেকার জীবনের অবসান ঘটানো হবে”-এই আস্বাসে দেশের যুব সমাজ ঐক্যবদ্ধ হয়ে পথে নেমেছিলেন। নারী সমাজ নারী-পুরুষের মধ্যেকার বৈষম্যের অবসান ঘটানা হবে-এই প্রতিশ্রুতি পেয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে এসেছিলেন; এক কেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা এবং সকল স্তরে বাংলা ভাষা প্রয়োগ করা হবে-এই প্রত্যয়ে উদ্দীপ্ত হয়ে ছাত্র সমাজ ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন।

সাম্প্রদায়িকতা দূর করে একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠণের প্রতিশ্রুতি পেয়ে দেশের সকল ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও আদিবাসী সমাজ ঐক্যের ডাকে সক্রিয়ভাবে সাড়া দিয়েছিলেন। দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে সকল মানুষের জন্য সমান সুযোগ প্রতিষ্ঠা ও বৈষম্য এবং দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গঠনের প্রতিশ্রুতি পেয়ে দেশের সকল শোষিত মানুষ ঐক্যবদ্ধ ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এই দাবী বা প্রতিশ্রুতিগুলি নিয়ে ২৩টি বছর ধরে ব্যাপক গণ আন্দোলন গড়ে তোলা হয়েছিল অসংখ্য জনসভা, কর্মীসভা, সম্মেলন, সমাবেশ, মিছিল করা হয়েছিল। তারই শেষ পর্য্যায়ে একাত্তরের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু জাতীয় ঐক্যের ডাক দেন। লক্ষ্য কোটি মানুষ তাতে উদ্বুদ্ধ হন-ঐক্যবদ্ধ হয়ে গণ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তখন ঐ বিশাল বিশাল জনসভা-কর্মীসভা, সম্মেলন মিছিলগুলিতে টাকা দিয়ে বা গাড়ী ভাড়া করে লোক আনা হতো না মানুষ আসতেন স্বত:ষ্ফূর্তভাবে।

১৯৭১ এ নয় মাস ব্যাপী মুক্তিযুদ্ধ অনুষ্ঠিত হলো-দেশ স্বাধীন হলো। অত:পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় ঐক্যই ছিল তার প্রধান ভিত্তি। হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খৃষ্টান-আদিবাসী মিলিতভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিলেন। বিজয়ের পর পরই বঙ্গবন্ধু সংবিধান প্রণয়ণে হাত দিলেন। ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত হলো সংবিধান প্রণয়ন কমিটি। দ্রুততম সময়ের মধ্যে তাঁরা সংবিধানটি প্রণয়ণের কাজ শেষ করলেন। মাত্র নয় মাসের মধ্যেই বাহাত্তরের সংবিধান প্রণয়ণের কাজ শেষ করে তা চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য সংসদে পেশ করা হয়। কয়েকদিন ধরে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার পর ৪ নভেম্বর, ১৯৭২ সংবিধানটি সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদিত হয়।

এই সংবিদানের প্রস্তাবনয় সুষ্পষ্টভাবে লিখিত হলো:

আমরা, বাংলাদেশের জনগণ, ১৯৭১ খৃষ্টাব্দের মার্চ মাসে স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়া জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করিয়াছি।

আমরা অঙ্গীকার করিতেছি যে, যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে আত্মেিয়াগ ও বীর শহীদ দিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল-জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে।

আমরা আরও অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক সমাজতান্ত্রিক শোষণমুক্ত সমাজের প্রতিষ্ঠা-যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।

মূলনীতি

জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা এই নীতিসমূহ এবং তৎসহ এই নীতিসমূহ হইতে উদ্ভূত অন্য সকল নীতি রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি বলিয়া পরিগণিত হইবে।

ভাষাগত ও সংস্কৃতিগত একক সত্তাবিশিষ্ট যে বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ ও সংকল্পবদ্ধ সংগ্রাম করিয়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জন করিয়াছেন, সেই বাঙালি জাতির ঐক্য ও সংহতি হইবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি।
মানুষের উপর মানুষের শোষণ হইতে মুক্তি ন্যায়ানুগ ও সাম্যবাদী সমাজ লাভ নিশ্চিত করিবার উদ্দেশ্যে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হইবে।

প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে মানবসত্তার মর্য্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে।

ধর্মনিরপেক্ষতা নীতি বাস্তবায়নের জন্য

(ক) সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা;

(খ) রাষ্ট্র কর্তৃক কোন ধর্মকে রাজনৈতিক মর্য্যাদা দান;

(গ) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় অপব্যবহার;

(ঘ) কোন বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাহার উপর নিপীড়ন বিলোপ করা হইবে।

রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব এব মেহনতি মানুষকে কৃষক ও শ্রমিককে এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্তি দান করা।

রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে পরিকল্পিত অর্থনৈতিক বিকাশের মাধ্যমে উৎপাদন শক্তির ক্রমবৃদ্ধি সাধন এবং জনগণের জীবন যাত্রার বস্তুগত ও সংস্কৃতিগত মানের দৃঢ় উন্নতি সাধন, যাহাতে নাগরিকদের জন্য নি¤œলিখিত

বিষয়সমূহ অর্জন নিশ্চিত করা যায়

(ক) অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা;

(খ) কর্মের অধিকার অর্থাৎ কর্মের গুণ ও পরিমাণ বিবেচনা করিয়া যুক্তিসঙ্গত মজুরীর বিনিময়ে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তার অধিকার,

(গ) সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার, অর্থাৎ বেকারত্ব, ব্যাধি বা পঙ্গত্বজনিত কিংবা বৈষম্য, মাতাপিতৃহীনতা বা বার্ধক্যজনিত কিংবা অনুরূপ অন্যান্য পরিস্থিতি জনিত আয়ত্তাতীত কারণে অভাবগ্রস্ততার ক্ষেত্রে সরকারি সাহায্য লাভের অধিকার ।

মূল সংবিধান থেকে রাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতিগুলি বিকল উদ্বৃত করার কারণে কথ্য ভাষায় তা লেখা হলো না। বাহাত্তরের মূল সংবিধান তাই সমগ্র বাঙালি জাতির হৃদয় ছুঁতে পেরেছিল। সবার জন্য-এমন কি পঙ্গুত্বে, বৈধব্যও যাতে কাউকে অসহায়ত্বে নিক্ষেপ না করে তার জন্যেও সরকারি ব্যবস্থার নিশ্চিয়তা দান করা হয়েছিল। তাই মুক্তিযুদ্ধের বা তার পূর্ববর্তী পাকিস্তানী আমলের আন্দোলন সংগ্রামে যে প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে ছিলেন স্বতস্ফূর্ত উদ্যোগ ও তৎপরতার সাথে মুক্তিযুদ্ধে বিধৃত মানুষের তাবৎ আশা-আকাংখার তাতে প্রতিফলন ঘটেছিল।

সংবিধান হলো একটি রাষ্ট্রের মৌলিক আইন-এ আইনের বিপরীতমুখী পরিবর্তন অনাকাংখিত এবং অনৈতিক।
তাই আজ মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণ জয়ন্তী এবং সংবিধান গ্রহণের সুবর্ণ জয়ন্তীতে পর্য্যালোচনা-সমালোচনা-আত্ম সমালোচনা প্রয়োজন-মুক্তিযুদ্ধের প্রদত্ত এবং বাহাত্তরের সংবিধানে গৃহীত অঙ্গীকার সমূহ এই পঞ্চাশটি বছরে কতটা অগ্রসর করে নিতে পেরেছি-অথবা সংবিধানের মূল নীতিগুলিকে কতটা অগ্রসর বা পশ্চাৎমুখী করতে পেরেছি।

যে শ্রমিক, কৃষক, মধ্যত্তি, নি¤œবিত্ত ও বিত্তহীনদের কথা মাথায় রেখে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সহকর্মী-সহযোদ্ধারা সংবিধানটি জাতিকে আপহার দিয়েছিলেন-তার মর্য্যাদাই বা কতটুকু রক্ষা করতে পেরেছি।

আজও সরকার থেকে বিত্তহীন-গৃহহীনদের বাড়ী নির্মাণ করে দেওয়া কি ওই সংবিধানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। বাড়ী তো (আশ্রয়) হিসেবে এবং বেকারত্ব দূরীকরণ তো সংবিধান প্রদত্ত অধিকার। যথাযথভাবে তা রক্ষিত হলে নিশ্চয়ই সরকারকে কারও জন্যে বাড়ী নির্মাণ, কারও জন্যে স্কুটার বা রিক্সা প্রদান করে বাঁচানোর ব্যবস্থা করতে হতো না।
শিক্ষার ক্ষেত্রে একটি পর্য্যায় পর্য্যন্ত বিনামূল্যে বই সরবরাহ কিসের ইজ্ঞিতবহ? আমরা তো ছোটবেলায় কোন পর্য্যায়েই সরকারকে বিনামূল্যে বই সরবরাহ করতে দেখি নি। তাহলে মানুষের আর্থিক অবস্থার আগের চেয়ে অবনয়ন ঘটেছে। জিডিপি ও মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির যে তথ্য সরবরাহ করা হয় তা কি বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। বস্তুত: পুঁজির বিকাশ ঘটেছে কিন্তু তা মুষ্টিমেয়ের হাতে গিয়ে জমা হয়েছে।

এই বিষয়গুলি পর্য্যালোচনা করে এবং সাম্প্রদায়িকতা উচ্ছেদ ও ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ নির্বিশেষে সকলের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠাই বা কতদূর এগুতে পেরেছি-কতটা পারিমাণ। তার হিসেব নিকেস করার দিন আজকেই। তাই প্রতি বছর যথাযোগ্য মর্য্যাদায় ৪ নভেম্বর সবিধান দিবস জাতীয়ভঅবে পালন অপরিহার্য্য।

লেখক : সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ, সাংবাদিকতায় একুশে পদক প্রাপ্ত।