রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : ২৮ নভেম্বর রবিবার সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলার ১২টি ইউনিয়নে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে কাঙ্খিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। ভোটারদের কাছে টানতে শেষ মুহুর্তে  প্রচার প্রচারণা, গণসংযোগ, পথসভা, পদযাত্রাসহ নানামূখী জনসংযোগ চালাচ্ছেন প্রার্থীরা। তবে আওয়ামী লীগ দলীয় নৌকা প্রতীকের নেতা কর্মীদের গোপন বৈঠকে প্রতিপক্ষকে অবৈধভাবে ঘায়েল করার নানা কুটকৌশল নিয়ে আলোচনার বিষয়বস্তু ফাঁস হওয়ায় জনমনে নতুন আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।

এদিকে ২ নং বিষ্ণুপুর ইউপি’র স্বতন্ত্র প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলমের ভাই আলমগীর হোসেনকে মুকুন্দমধুসুধনপুর সরদারপাড়া মোড়ে তাদের নির্বাচনী কার্যালয়ে বুধবার সকাল ১০টায় হামলা চালায় ফিরোজ লস্কর, ফিরোজ মোড়ল, রবিউল ইসলামসহ কয়েকজন। সশস্ত্র হামলাকারিদের পুলিশ ভিডিও করে। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে পুলিশের সামনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী শেখ রিয়াজউদ্দিনের নির্দেশে আলমগীরকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা হয়। পুলিশ হামলাকারিদের প্রতিহত করার চেষ্টা করলে শেখ রিয়াজউদ্দিন এক পুলিশ কর্মকর্তাকে খাগড়াছড়ি বা বান্দর বনে বদলী করিয়ে দেওয়ার হুমকি দেন বলে দাবি প্রত্যক্ষদর্শীদের। এরপর আলমগীরকে কালিগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। যদিও শেখ রিয়াজউদ্দিন এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

বিষয়টি নিয়ে বিষ্ণুপুরসহ গোটা উপজেলায় চলছে নানামূখী আলোচনা ও সমালোচনা। মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার পর থেকে বেশ কয়েকবার হামলা, পোস্টার ছেড়া, ব্যানার খুলে নেয়া, কর্মী সমর্থকদের হুমকি ও মারপিটের বিষয়ে রিটার্নিং অফিসার, থানার অফিসার ইনচার্জ ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েও কাঙ্খিত প্রতিকার পাননি স্বতন্ত্র প্রার্থী। নির্বাচনী আচরনবিধি ভঙ্গ করে উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি সাঈদ মেহেদীকে নিয়ে শেখ রিয়জিউদ্দিন বিষ্ণুপুর হরিবাসরে (মঠ) নৌকার প্রতীকের সমর্থনে ভোট চেয়েছেন। মঠে ভিক্ষা স্বরুপ টাকা দিয়েছেন। এ ছাড়া রসিকানন্দ মঠ, জয়পত্রকাটি মঠ ও কোমরপুর মঠে নৌকা প্রতীকে ভোট চেয়ে ভিক্ষা স্বরুপ টাকা দিয়েছেন শেখ রিয়াজউদ্দিন। বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় ও জাতীয় দৈনিকে প্রকাশ পাওয়ার পর জাহাঙ্গীর আলম সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবে সংবাদ সস্মেলন করেছেন। তাতে কোন প্রতিকার না হলেও রাতেই জাহাঙ্গীর আলমের নির্বাচন কর্মী বন্দকাটি গ্রামের মোহাম্মদ আলীর ছেলে বাবুকে হোগলা গ্রামের কালভার্টের উপর পেটানো হয়েছে। বর্তমানে বাবু ও আলমগীর কালিগঞ্জ উপজেলা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। নৌকার পক্ষে মাঠে না নামায় সমীর মণ্ডল, শঙ্কর সরদার, দুলাল মণ্ডল ও আনন্দ দাসকে ডাকযোগে চিঠি পাঠিয়ে হিন্দু রাজাকার হিসেবে আখ্যায়িত করে হুশিয়ার করা হয়েছে। নৌকা প্রতীকের কর্মী জনৈক কৃষ্ণপদ কর্মকার বিষ্ণুপুর হাইস্কুল কেন্দ্রে শঙ্কর সরদার ভোট দিতে গেলে তাকে প্রকাশ্যে নৌকায় ছিল না মারলে ভোট দিতে দেওয়া হবে না বলে হুমকি দিয়েছে।

সাধারণ মানুষ সত্যিই নিরাপদে ভোট দিয়ে তাদের পছন্দের প্রতিনিধি বেছে নিতে পারবেন কী না সে বিষয়ে নতুন করে সংশয় দেখা দিয়েছে বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগী স্বতন্ত্র প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম। তিনি বলেন, তার প্রতিদ্বন্দি প্রার্থী শেখ রিয়াজউদ্দীন জনগণের রায়ের উপর আস্থা রাখতে পারছেন না।

গত ৫ বছরে শেখ রিয়াজের অপশাসনে মানুষ ক্ষিপ্ত হয়ে তার বিরুদ্ধে ভোটবিপ্লব ঘটাবে এটা বুঝতে পেরেছেন। এজন্য নির্বাচনের তফশীল ঘোষণার পর থেকে তার পোষা গুন্ডাবাহিনীকে মাঠে নামিয়েছেন। জনগণের মাঝে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে যাতে তারা ভোটকেন্দ্রে না যায়। বুধবার গভীর রাতে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে গোপন মিটিং করে বিভিন্ন ছক তৈরী করেছেন। নৌকা প্রতীকের এজেন্টদের পক্ষ নিয়ে মহিলা সদস্য ও পুরুষ সদস্যদের এজেন্টদের কাজ করার জন্য মৃদু হুমকি দেওয়া হয়েছে। নির্বাচন আচরণবিধি ভঙ্গের ঘটনায় প্রতিবেদন প্রকাশ করায় এক সাংবাদিক তার চক্ষুশুল হয়েছেন।

নৌকার জয় নিশ্চিত করতে নিজেদের চেনাজানা সমর্থকদের ছাড়া অন্যদের ভোটকেন্দ্রে যেতে বাধা দেয়া হবে। যদি কেউ বাধা উপেক্ষা করে ভোটকেন্দ্রে পৌছায় তাদেরকে প্রকাশ্যে নৌকা প্রতীকে সীল মারতে বাধ্য করা হবে। সুযোগ বুঝে প্রতিপক্ষের এজেন্টদের বের করে দিয়ে ব্যালটে সীল মেরে বাক্সে ভরা হবে। এসব পরিকল্পনা ফাঁস হওয়ায় মানুষের মাঝে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে নারী ভোটাররা এবার ভোটকেন্দ্রে যাবেন কী না তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্ধে ভুগছেন। বিগত ইউপি নির্বাচনেও রাতে ব্যালটে সীল মেরে ও দিনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে তার (জাহাঙ্গীর)নিশ্চিত বিজয়কে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছিল। এবারও শেখ রিয়াজ উদ্দীন একই পথে হাটছেন বলে অভিযোগ।

তবে শেখ রিয়াজ উদ্দীন সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অপপ্রচার চালাচ্ছেন।

তবে চম্পাফুল ইউনিয়নের চাঁদখালি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পূর্ব চম্পাফুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও নবীননগর সরকারি প্রাতমিক বিদ্যালয়ে নৌকা প্রতীকের লোকজন আনারস প্রতীকের এজেন্টদের বুথে ঢুকতে না দেওয়া ও বুথ থেকে এজেন্টদের বের দিয়ে ছাপ্পা ভোট মারা প্রস্তুতি নিয়েছে বলে অভিযোগ আব্দুল লতিফের।

দক্ষিণ শ্রীপুর ইউনিয়নে হিন্দুদের কাছে ভোট চাইতে যেতে পারছেন না বলে অভিযোগ করেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী শেখ দিদারুল ইসলাম। ভোট চাইতে গেলে নৌকার প্রার্থী গোবিন্দ মণ্ডল ও ঘোড়া প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রাথী প্রশান্ত সরকারের লোকজনদের হুমকির সম্মুখিন হচ্ছেন ওই সব হিন্দু ভোটাররা।

একইভাবে কৃষ্ণনগর ইউপিয়নে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী শ্যামলী অধিকারীর বাড়ির সামনে ও পথিমধ্যে বোমা হামলার ঘটনা ঘটেছে। এ সব হামলার অভিযোগ উঠেছে জাতীয় পার্টির প্রার্থী সাফিরা পরিভনের বিরুদ্ধে। একইভাবে মাঠ দখল করতে স্বতন্ত্র প্রার্থী রবিউল­াহসহ ছয় জনের বিরুদ্ধে আত্মীয়াকে দিয়ে মামলা করিয়েছেন বলে অভিযোগ সাফিয়া পারভিনের বিরুদ্ধে।

এছাড়া নলতা ইউনিয়নে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আবুল হোসেনের পরাজয় ঠেকাতে ও ভোটারদের দলে ভেড়াতে বুধবার রাতে পাইকাড়ার দলীয় নির্বাচন অফিসে আগুন দিয়ে মামলা করে স্বতন্ত্র প্রার্থীর লোকজনদের মাঠ ছাড়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে বলে বৃহষ।পতিবার সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবে সংবাদ সস্মেলনে অভিযোগ করেছেন আজিজুর রহমান পাড়।

এদিকে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের সাধারণ ভোটারদের সাথে কথা বললে তারা জানান, এখনও পর্যন্ত তারা নিজ পছন্দের প্রার্থীকে নির্ভয়ে ভোট দিতে পারবেন বলে আশা করছেন। তবে সময় যত গড়াচ্ছে নানা ধরণের শঙ্কাও সৃষ্টি হচ্ছে। প্রশাসনিক তৎপরতায় ২৮ নভেম্বর একটি ভোট উৎসব হবে এমন আশা করছেন তারা।

জানতে চাইলে কালিগঞ্জ থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, মোহাম্মদ গোলাম মোস্তফা বলেন, পুলিশের সামনে জাহাঙ্গীর আলমের ভাইকে মারধর করা হয়েছে এমন ঘটনা তার জানা নেই। জনগণ যাতে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারে সেজন্য প্রশাসনের নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। বন্দকাটি, চৌমুহুনীসহ কয়েকটি স্থানে পুলিশ বিশেষভাবে টহল দিচ্ছে।

(আরকে/এএস/নভেম্বর ২৫, ২০২১)