রিপন মারমা, রাঙামাটি : রাঙামাটি নানিয়ানচর উপজেলা মাত্র ৫০০ মিটারের (আধা কিলোমিটার) একটি সেতু বিশাল একটি জনপদের জীবনমান পাল্টে দিয়েছে। অর্থনৈতিক উন্নতির পাশাপাশি স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ নানাভাবে জীবনমান উন্নয়নের সুযোগ সৃষ্টি করেছে রাঙামাটির দুর্গম নানিয়ারচর উপজেলার অর্ধলক্ষ মানুষের। উঠছে পাকা ঘর পাকা ডালাই হচ্ছে সড়ক। ভরা বর্ষা কিংবা শুষ্ক মৌসুমে যেখানে নদী পার হওয়া দুরূহ ব্যাপার ছিল, সেতু হয়ে যাওয়ায় এখন সেই নদী পার হওয়া মিনিটের ব্যাপার মাত্র।  

স্থানীয় সূত্রে জানান যায়, দীর্ঘদিন পর তিন উপজেলা নানিয়ানচর, বাঘাইছড়ি, লংগদু উপজেলা বাসিন্দাদের স্বস্তি ফিরে এসেছে। নানিয়ারচর এলাকা হল ঊর্বর একটি জনপদ। আম, জাম, কাঁঠাল, আনারস, ড্রাগন ফল,কাজু বাদাম, চায়না লিচুসহ এখানে দেশীয় ফলের ব্যাপক ভাবে চাষ করা হয়। তাছাড়া ধান চাষসহ নানা ধরনের সবজিতে কৃষকের ক্ষেত ভরে উঠে।

একমাত্র চেঙ্গী নদীর কারণে কৃষকেরা ফসলের দাম পেত না। নানা কষ্টে দুর্গম পথ বেয়ে বাজারে অল্প ফসল নিয়ে পৌঁছতেই ঘাম ঝরে যেত। পরিবহন ব্যয়ও ছিল অনেক বেশি।অর্ধ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতুটিই নানিয়ারচর এলাকার অর্ধলক্ষাধিক মানুষের কাছে স্বপ্নের ‘পদ্মা সেতু।’ এই সেতুর উদ্যোগ নেয়ার জন্য তারা সরকারকে এবং বাস্তবায়ন করার জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে ধন্যবাদ জানান।

নানিয়ানচর উপজেলা বাসিন্দার পলাশ চাকমা মটো ফোনে জানান, একসময় এক থুরং ফসল বাজারে নিয়ে বিক্রি করতে সারাদিন চলে যেত। বাজারে ফসল একবার নিয়ে গেলে তা ফেরত আনার সুযোগ ছিল না। যে কারণে দাম কম হলেও তারা বিক্রি করতে বাধ্য হতেন। কারণ যাতায়াত ব্যবস্থা ভাল ছিল না। এখন সেতু নির্মাণের ফলে ট্রাক নিয়ে ব্যাপারিরা সরাসরি এখানে আসার সুযোগ পাবেন।

ইতিমধ্যে অনেকেই এখানে পাকা বাড়ি নির্মাণের কাজ শুরু করছে এবং স্থানীয় ছেলে মেয়ে স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পাবেন। রোগীদের সহজেই সদর হাসপাতালে নেয়ার সুযোগ হয়েছে।

সংশ্লিষ্টদের মাধ্যমে জানা যায়, সেতু না হওয়ার আগে চরম ভোগান্তিতে পড়তো এখানকার মানুষ আর এদিকে রাঙামাটি সদর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতো এই জনপদের মানুষ। এমনকি জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে পড়লেও তাদের হাতে বিকল্প কোন পথ ছিল না। একারণে বছরের বেশির ভাগ সময় নানিয়ারচর এলাকার মানুষকে যোগাযোগ ব্যবস্থায় চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হয়েছে। সূর্য একটু হেলে পড়ে সন্ধ্যা নামলে তো সদর হাসপাতালে যাওয়ার বিষয়টি চিন্তাই করতে পারতো না। কারণ অন্ধকারে নৌযান চালানো আরো কঠিন। পার হতে না পেরে অনেক গর্ভবতী মহিলাকে চরম মূল্য দিতে হয়েছে। গুরুতর অসুস্থ বয়স্ক কত রোগীর পরিবারকে মূল্য দিতে হয়েছে। যুগের পর যুগ এই জনপদের মানুষ এভাবেই চরম কষ্টের মধ্য দিয়ে সদরের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেছেন। শান্তি চুক্তির পর তাদের যোগাযোগের কষ্টে লাঘবে উদ্যোগ নেয় সরকার।

সরকারের পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির একটি অংশ হিসেবে এই সেতুটি সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের তত্ত্বাবধানে ২০ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্যাটালিয়নের ব্যবস্থাপনায় নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করেছে। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে নির্মিত এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত হয় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর। প্রকল্পটির মূল কাজ চেঙ্গী নদীর উপর ৫শ মিটার পিসি গার্ডার সেতুটি নির্মাণ করা হয়। এর সাথে রয়েছে ২.২০ কিলোমিটার এপ্রোচ সড়ক। এর সাথে রয়েছে নদী রক্ষার কাজ এবং সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের একটি পরিদর্শন বাংলো নির্মাণ।

নানিয়ারচর সেতু প্রকল্প অফিস সূত্রে জানা গেছে, এটি পার্বত্য চট্টগ্রামের সবচেয়ে দীর্ঘতম সেতু। এটির দৈর্ঘ্য ৫০০ মিটার এবং প্রস্থ ৯.৮ মিটার। এই সেতু প্রকল্পের মোট বাজেট ২২৭ কোটি ৬১ লাখ টাকা। এর মধ্যে ভূমি অধিগ্রহণের জন্য খরচ হয়েছে ৪৬ কোটি ৬১ লাখ টাকা।

(আরএম/এসপি/ডিসেম্বর ০৩, ২০২১)