মানিক সরকার মানিক


পুরো বছরজুড়েই দেশব্যাপী সাড়ম্বরে পালিত হচ্ছে বিজয়ের সুবর্ণ জয়ন্তি ও মুজিব বর্ষ উৎসব। শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও এ উপলক্ষে আয়োজন করা হয়েছে নানা অনুষ্ঠানের। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এ দেশ আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ। আমরাও কৃতজ্ঞচিত্বে স্মরণ করছি সেই মহামানব, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, যার জন্ম না হলে আমরা পেতাম না প্রিয় মাতৃভূমি-এই বাংলাদেশকে, সেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে।

১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চের মধ্যরাত থেকে বাংলাদেশে গণহত্যা কার্যক্রম অপারেশন সার্চ লাইটের অধীনে পরিকল্পিতভাবে শুরু করেছিল পশ্চিমা পাকিস্তানিরা। তৎকালীণ পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের স্বাধীকারের দাবিকে চিরতরে নির্মূল করতে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী এ কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়ে। দীর্ঘ ৯ মাস বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ও তাদের সহায়তাকারী দলগুলো প্রায় ৩ লাখ বাঙালি মা বোনকে ধর্ষণ, নির্যাতন নিপীড়ণসহ প্রায় ৩০ লাখ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করে। পাক সামরিক জান্তাদের এই নির্মম পৈশাচিকতা রুখতে বাঙালি সেনাসহ এদেশের স্বাধীনতা প্রিয় সাধারণ মানুষও ঝাঁিপয়ে পড়েন যুদ্ধে। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। তাঁরা রুখে দাঁড়ান হানাদারদের বিরুদ্ধে।

হানাদারদের অসংখ্য সদস্য নিহত হতে থাকে আমাদের মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধ আক্রমণে। দেশের এই স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনার জন্য অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে প্রথমে তিনজন সেক্টর কমান্ডার নিয়ে গঠন করা হয় তিনটি সেক্টর। এগুলো হলো: সেক্টর এক. চট্রগ্রাম, পার্বত্য চট্রগ্রাম এবং ফেনী নদী। যার স্বল্পকালীণ নেতৃত্বে ছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান। পরবর্তীতে নেতৃত্ব পান মেজর রফিকুল ইসলাম। নোয়াখালী, কুমিল্লা জেলার আখাউড়া ভৈরব রেল লাইন পর্যন্ত এবং ঢাকা ও ফরিদপুর জেলার অংশ বিশেষ নিয়ে গঠিত হয়েছিল সেক্টর দুই। যার নেতৃত্বে ছিলেন লে: কর্ণেল খালেদ মোশাররফ এবং মেজর এ.টি.এম হায়দার। এছাড়া সেক্টর তিন গঠিত হয়েছিল ভৈরবের কিছু অংশ থেকে কুমিল্লার কিছু অংশ, সিলেটের হবিগঞ্জ, ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জ এবং ঢাকা জেলার অংশ বিশেষ। এই ৩ নম্বর সেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন যথাক্রমে লে: কর্ণেল সফিউল্লাহ ও মেজর নুরুজ্জামান। যুদ্ধকালে রংপুর ও দিনাজপুর অঞ্চল ছিল ৬ নম্বর সেক্টরের অধীন।

১০ জুলাই থেকে ১৭ জুলাই পর্যন্ত মুক্তিবাহিনীর কোলকাতার সদর দপ্তরে অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী তাজ উদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে সেক্টর কমান্ডারদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেই সম্মেলনেই সমগ্র বাংলার ভূ-খন্ডকে নিয়ে পুর্নগঠন করা হয় ১১টি যুদ্ধ ক্ষেত্র বা সেক্টরে। ১১টি সেক্টরের মধ্যে ১০ নম্বর সেক্টরটি ছিল নৌ সেক্টর। যেটির নিয়ন্ত্রণ ছিল সেনা প্রধানের। এর কোন আঞ্চলিক সীমারেখা ছিল না। ৫১৭ জন নৌ বাহিনীর কমান্ডো অধিনস্থদের শক্রপক্ষের নৌ যান ধ্বংসের জন্য বিভিন্ন সেক্টরে পাঠানো হতো। প্রতিটি সেক্টরে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীতে কর্মরত বাঙালি সেনা কর্মকর্তা-সদস্য,পুলিশ-ইপিআর, নৌ, বিমান বাহিনীর সদস্য ছাড়াও দেশের ছাত্র যুবক, রাজনৈতিক দলের কর্মী সমর্থক ও বিভিন্ন পেশার মানুষ অংশ নেন। প্রতিটি সেক্টরে নিয়মিত সেনা গেরিলা ও সাধারণ যোদ্ধা ছিল, এরা মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিফৌজ নামে পরিচিত ছিল। পরবর্তীতে সেনা প্রধান তৎকালীণ কর্ণেল আতাউল গণি ওসমানী তিনটি ব্রিগেড আকারের ফোর্স গঠন করেন। সেসবের নামকরণ করা হয় অধিনায়কদের নামের প্রথম অক্ষর দিয়ে।

এই সেক্টরগুলোর দু:সাহসিক ভূমিকায় বাঙালিরা উজ্জীবিত হতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীণ যুদ্ধকে আরো বেগবান ও ত্বরান্বিত করার জন্য তৎকালীণ সেনা প্রধান কর্ণেল পরবর্তীতে জেনারেল আতাউল গণি ওসমানী দেশের প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষকে সব ধরণের সহযোগিতা করার জন্যও সেনাবাহিনীকে নির্দেশ জারি করেন। মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জল ইতিহাসের একটি অংশ হলো নবম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। এর নিক নেইম ছিল ’চার্জিং নাইন’। দেশের সেনাবাহিনীতে চার্জিং নাইন ঐতিহ্যবাহী ইউনিটগুলোর অন্যতম। যেটি ৭১ সালের ১০ অক্টোবর অনেক চড়াই উৎরাইয়ের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধের ময়দানে জন্ম নিয়েছিল। নবগঠিত ইউনিট হিসেবে এই চার্জিং নাইন মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন অপারেশনে সক্রিয় অংশ নিয়ে পেশাগত দক্ষতা ও সফলতার মাধ্যমে বিজয়কে ত্বরান্বিত করেছিল।

মুক্তিযুদ্ধে সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন সেক্টরে দায়িত্ব পালন এবং বীরশ্রেষ্ঠ উপাধি প্রাপ্তরা হলেন, ল্যান্স নায়েক মুন্সি আব্দুর রউফ, সিপাহী মোস্তফা কামাল, ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর, সিপাহী হামিদুর রহমান, নূর মোহাম্মদ শেখ, রুহুল আমিন প্রমূখ। ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে বিদ্রোহের অব্যহতি পরই চট্রগ্রামের ইপিআর-এর বাঙালি অফিসার ও জওয়ানরা অস্ত্র তুলে নিয়ে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালাতে থাকে। এর ক’দিন আগে পূর্ব পাকিস্তানে বিভিন্ন স্থানে বাঙালি সেনা, ইপিআর ও পুলিশ সদস্যরা পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন স্থাপনাতে আক্রমণ পরিচালনা করে। প্রতিত্তুরে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীও পাল্টা আক্রমণ চালায়। এতে বাঙালি সেনাদের আওতাধীন চট্রগ্রামের কালুরঘাট, যেখানে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ছিল, তা আক্রমণ করে সেনা সদস্য মুক্তিযোদ্ধাদের হটিয়ে দেয় পাক বাহিনী। এভাবে সীমানার অভ্যন্তরে বিভিন্ন স্থানে আক্রমণ চালিয়ে দখল করে পাক বাহিনী। ফলে কৌশলগত কারণে সেক্টর কমান্ডাররা মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের অভ্যন্তরে আশ্রয় নেন।

পরবর্তীতে তাদের একটি অংশ পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরে এসে ঝটিকা আক্রমণের মধ্য দিয়ে শুরু করেন মুক্তিযুদ্ধ। এতে একদিকে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর সদস্যরা পরাজিত হচ্ছিল, অন্যদিকে পাকিস্তানী অস্ত্রশস্ত্র গোলা বারুদ, রসদপাতি কেড়ে নেয়া সম্ভব হচ্ছিল। এভাবেই মুক্তিবাহিনীর সেনা কর্মকর্তারা অনুধাবনে সক্ষম হন যে, এরকম বিচ্ছিন্ন আক্রমণ ও প্রতিআক্রমণের মধ্য দিয়ে সুসজ্জিত পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর পতন ঘটনো সম্ভব হবে না। আর তাই তারা সুসংগঠিতভাবে যুদ্ধ পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এর উদ্দেশ্য ছিল প্রথমত, দেশটিকে বিভিন্ন এলাকায় ভাগ করে সামরিক নেতা নির্বাচন, মুক্তিবাহিনীর সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি, উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ সংগ্রহ এবং সর্বপরি যথাযথ প্রস্তুতি নিয়ে পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করা। এভাবেই জয় বাংলা ধ্বণিতে মুক্তিযুদ্ধে সামরিক সেক্টরগুলোর দু:সাহসিক ভূমিকায় এবং স্বাধীনতা প্রিয় কয়েক লাখ মানুষের প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত হয় আমাদের প্রিয় এই স্বাধীন বাংলাদেশ।


লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক কর্মী।