সমরেন্দ্র বিশ্বশর্মা, কেন্দুয়া : রশিদা  তার ডান পিঠের উপরের অংশে গুলি বহন করে চলছেন ৫০ বছর ধরে। কেন্দুয়া উপজেলার গোপালাশ্রম গ্রামের (চক্রকান্দি) মৃত মারফত আলীর স্ত্রী রশিদা আক্তার সেদিন বলছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সময় দুঃখের দিনের স্মৃতিকথা।

১৯৭১ সনে মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে জীবন বাঁচাতে শিশু সন্তানকে কোলে নিয়ে শ্রাবন মাসের কোন একদিন ঘর থেকে বের হন তিনি। সেদিন গোপালাশ্রম গ্রামের ডাক্তার বাড়িতে (ডা.ধীরেন্দ্রনাথ সরকারের বাড়িতে) আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল পাক হানাদার বাহিনী ও স্থানীয় রাজাকাররা। সেদিন বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়ে পাক হানাদার বাহিনী।

রশিদা আক্তার জানান, তার শিশু বাচ্চাকে কোলে নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছিলেন তিনি। এসময় বাড়ির উঠোনে হঠাৎ করে ডান পিঠের উপরের অংশে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। ঝড়তে থাকে প্রচুর রক্ত। এসময় মৃত জবান হোসেনের ছেলে রশিদ নামের ওই গ্রামের এক ব্যক্তি আরো কয়েকজন মহিলাকে নৌকায় তোলে মনাং গ্রামের দিকে নিয়ে যাচ্ছিলেন।

রশিদা বলেন, তার কান্দের গামছা দিয়া আমার পিডের রক্ত মুছতাছে। এমন সময় তার মাথায় একটি গুলি পইরা মাথার খুলডা উড়াইয়া লইয়া গেছে। নাওয়ের মধ্যে রশিদ মিয়া আমরার চোখের সামনে ধরফরাইয়া মইরা গেছে। আমরা সব মেয়েরা কানতাছি। পরে মনাং এর লোকেরা নাও দিয়া আমরারের পার করছে।

এই দিনের গুলিতে চক্রকান্দি গ্রামের আফতাব হোসেনের ছেলে মেশিদ মিয়া মারা গেছে। তিনি গোয়াল ঘরে গরু বানতেছিলেন। এছাড়া মনার বাপ বারান্দায় বসে পাট দিয়ে সুতলি পাকাইতেছিলেন। গুলিতে তিনিও ঘটনাস্থলে নিহত হন। এছাড়া ইসলাম উদ্দিনের মা রূপবানু এবং জহুর উদ্দিনের ছেলে সাইব আলী আহত হয়ে মুক্তিযুদ্ধের অনেক পরে মারা গেছেন।

রশিদা আক্তার বলেন, আমারে আমার আত্মীয় স্বজনরা ময়মনসিংহ হাসপাতালে নিয়া গেছে। সেখানে একজন বেডি ডাক্তার আমার রক্তডা, ধুইয়া মুইছা একটু ঔষধ লাগাইয়া আমারে বলতেছে, এইখানে আর বেশিক্ষন তাহন যাইবনা। পাকবাহিনীর গুলিতে আহত ব্যক্তিরা এখানে আছে জানতে পারলে আমরার খুব অসুবিধা ওইব। এই কথা বলে আমারে তারাতারি হাসপাতাল থাইকা বাইর কইরা দিয়া কয় লুকাইয়া লুকাইয়া বাড়িতে চইলা যাইন। আমি বাড়িতে চইলা আইছি। দেশ স্বাধীন ওইছে। কিন্তু টেহার অভাবে আমার অপারেশন ওইতাছেনা। এই জাগাডার মধ্যে মাঝে মাঝে ঝিনঝিন করে ব্যাথা আসে। কোন সময় অবস ওইয়া যায়। আবার কোন সময় বেদনায় অস্থির অইয়া যাই। আমি জীবিত থাকতে এই জাগাডার অপারেশন কইরা গুলি বাইর করতে পারতামনা। গুলি লইয়াই আমার কয়বরে যাইতে অইব। আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে অনুরোধ করি, তিনি যেন, ডাক্তারের মাধ্যমে আমার এই জাগাডা অপারেশন কইরা গুলিডে বাইর কইরা দেন।

এই গ্রামের নাজিম উদ্দিন বলেন, এই দিনের গুলিতে রশিদা সহ আরো ২ জন আহত হয়েছিলেন এবং ৩ জন মারা গিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর অতিবাহিত হলেও এদের কোন খোঁজ খবর কেউ নিলনা। আহত অবস্থায় রশিদা পিঠে গুলি বহন করেই চলছে ৫০ বছর। তার অরাপেশন করে পিঠ থেকে গুলি বের করার প্রয়োজন থাকলেও টাকার অভাবে তিনি তা করতে পারছেন না। আমি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারের নিকট জোর দাবি জানাব, যারা পাকহানাদার বাহিনীর গুলিতে নিহত হয়েছেন, তাদের পরিবারের খোঁজ খবর নেয়ার জন্য। সেই সঙ্গে রশিদার অপারেশন করে গুলি বের করার জন্য। উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ মইন উদ্দিন খন্দকার বলেন, গুলিতে আহত হওয়ার বিষয়টি জানা ছিলনা। ১৬ ডিসেম্বরের আগে হলে একটা সহযোগিতা করা যেত, এর পরও জেলা প্রশাসনের সাথে উনার বিষয়ে কথা বলে একটা পদক্ষেপ নেব।

(এসবি/এসপি/ডিসেম্বর ২৫, ২০২১)